কিছুদিন আগে একটি নাটকে খাঁচাবন্দী পাখি দেখানোর জন্য বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট নির্মাতার বিরুদ্ধে ১৫ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা দায়ের করে। এ নিয়ে নাট্যাঙ্গণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনা হয়। নাট্যনির্মাতা এর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, যে বাড়িতে শুটিং করেছিলেন সে বাড়িতে একটি খাঁচাবন্দি পাখি ছিল। দৃশ্যের প্রয়োজনে সেটি রাখা হয়। এখন বন বিভাগ যে ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে তা আমি সারাজীবনেও শোধ করতে পারব না। এ ঘটনার পরপর সম্প্রতি মুক্তি পাওয়া ‘হাওয়া’ সিনেমায় একই দৃশ্য দেখানোর অভিযোগে বন বিভাগ ‘বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘনে’র অভিযোগ এনে নির্মাতার বিরুদ্ধে ২০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা করেছে এবং এর প্রদর্শনী বন্ধে গত সোমবার সেন্সর বোর্ডে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খন্দকার হাসান শাহরিয়ার। এ নিয়ে অভিনয় শিল্পীরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছেন। তারা ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠেছেন। অভিনয় শিল্পী সংঘের পক্ষ থেকে গত মঙ্গলবার ‘হোক প্রতিবাদ’ শিরোনামে একটি চিঠির মাধ্যমে তারা এই প্রতিবাদের সূচনা করে। টেলিভিশন মিডিয়ার সাথে জড়িত সকল অভিনেতা-অভিনেত্রী এই প্রতিবাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন। প্রায় প্রত্যেকের ফেসবুক টাইমলাইনেই দেখা যাচ্ছে, অভিনয় শিল্পী সংঘে’র সভাপতি আহসান হাবীব নাসিম ও সাধারক স¤পাদক রওনক হাসান স্বাক্ষরিত ‘হোক প্রতিবাদ’ নিয়ে লেখা। শিল্পী সংঘের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র যখন কয়েকজন তরুণ, মেধাবী, শিক্ষিত শিল্পী, নির্মাতার হাত ধরে ধ্বংসস্তুপ থেকে আবার নতুনভাবে একটু একটু করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে শুরু করেছে, যখন সিনেমা হলে মানুষের জোয়ার নেমেছে, মানুষ দলে দলে সিনেমা দেখতে আসছে, ঠিক তখনি এ জোয়ার বন্ধ করার ষড়যন্ত্র নিয়ে অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে এই অশুভ শক্তি বাংলাদেশের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতিকে ধ্বংস করবার জন্য জঘন্যতম তৎপরতা চালিয়ে আসছে। এবার তারা আইনের ধারা উপধারাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে যে হাওয়ায় পুরো বাংলাদেশ ভাসছে, সেই হাওয়াকে রুদ্ধ করার ষড়যন্ত্রের নকশা নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, হাওয়া চলচ্চিত্রের সকল রকম প্রদর্শনী বন্ধ করতে হবে। বলা হচ্ছে, বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘন হয়েছে। আমরা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। শিল্পী সাহিত্যিক সংস্কৃতিকর্মী মানেই তারা সমাজের সবচেয়ে সচেতন জনগোষ্ঠীর অংশ। আমরা কখনোই আমাদের সমাজ, পরিবেশ ও প্রকৃতি বিরুদ্ধ কোনো কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করিনা। বরং সকল প্রকার সমাজ সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে শিল্পীরাই সর্বাগ্রে সবসময় ভূমিকা পালন করে আসছে। নাটক চলচ্চিত্র নির্মাণে কখনোই শিল্পী নির্মাতারা পশু-পাখি প্রাণী হত্যা ও নির্যাতন করেন না। গল্পের প্রয়োজনে কখনো কখনো পশু-পাখিদের দেখানো হয়ে থাকে। যা হাওয়া চলচ্চিত্রে ঘটেছে। জেলেরা গভীর সমুদ্রে হারিয়ে গেলে পাখি ছেড়ে দিয়ে দেখেন কাছাকাছি কোনো স্থলভূমি আছে কিনা! যা এই চলচ্চিত্রে দেখানো হয়েছে। এটি জীবনেরই অংশ। এবং চলচ্চিত্রে ঘোষণাই দেয়া হয়েছে এখানে কোনো বন্যপ্রাণীর ক্ষতিসাধন করা হয়নি। তারা বলেন, জন্মলগ্ন থেকে আমরা বিভিন্ন নাটক-চলচ্চিত্রে দেখে আসছি এমন কতো দৃশ্য। সেগুলো নিয়ে আপত্তি উঠলো না কেন? সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশন প্রযোজিত ভীষণ জনপ্রিয় নাটক প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক হূমায়ুন আহমেদের ধারাবাহিক ‘বহুব্রীহি’র সেই খাঁচাবন্দী টিয়া পাখির ‘তুই রাজাকার’ সংলাপ এখনো আমাদের স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করছে। এমন হাজারো ঘটনায় কর্তৃপক্ষ তখন কোথায় ছিলো! তারা বলেন, এ ঘটনায় চলচ্চিত্রের প্রযোজক ও পরিচালককে ডেকে কথা বলা যেতো। আইন লঙ্ঘন হয়ে থাকলে কিভাবে তা শুধরানো যায় সেই আলোচনা ও পদক্ষেপ নেয়া যেতো। তা না করে ২০ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ মামলা, চলচ্চিত্র প্রদর্শনী বন্ধের জন্য আইনী তলব এসবই আমাদের শিল্প-সংস্কৃতির কণ্ঠ রুদ্ধ করার, শিল্প-সাহিত্য চর্চাকে নিরুৎসাহিত করবার ষড়যন্ত্র হিসেবেই আমরা দেখছি। ‘হাওয়া’ সিনেমা প্রদর্শনী বন্ধের ষড়ষন্ত্রের বিরুদ্ধে আমরা তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। আমাদের সংস্কৃতি চর্চার পথকে রুদ্ধ করার সকল অপচেষ্টাকে রুখে দেয়ার জন্য আমরাও বদ্ধ পরিকর। উল্লেখ্য, মেজবাউর রহমান সুমন পরিচালিত ‘হাওয়া’ সিনেমায় একটি শালিক পাখিকে খাঁচায় আটকে রাখা এবং রান্না করে খাওয়ার দৃশ্য নিয়ে পরিবেশবাদীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। এরপর গত ১১ আগস্ট বিকেলে রাজধানীর স্টার সিনেপ্লেক্সের বসুন্ধরা শাখায় সিনেমাটি দেখেন বন বিভাগের অপরাধ দমন ইউনিটের চার সদস্যবিশিষ্ট একটি দল। তারা সিনেমা দেখে ‘বন্যপ্রাণী আইন লঙ্ঘন করা হয়েছে’ বলে অভিমত দেন। এরপরই নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলা করে বন বিভাগের বন্যপ্রাণী অপরাধ দমন ইউনিট।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন