শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

সাহাবায়ে কেরামের রাসূলপ্রেম

মুন্সি আব্দুল কাদির | প্রকাশের সময় : ১ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

ইসলাম চির শান্তির, চির স্বস্তির, চির নির্ভরতার, চির কল্যাণের, চির তৃপ্তির। এই চির তৃপ্তি আর স্বস্থি আসে নির্ভরতা থেকে। যার নির্ভরতা তথা আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল যত মজবুত যে তত উদ্বেগহীন, পরোয়াহীন। দুখ নামক কোন কিছুই তাকে স্পর্শ করে না। দুখ নামক কোন কিছুই তার অনুভবে কাবু করতে পারে না। দুখের মাঝে শান্তি খুঁজে পায়, খুঁজে নেয়। দুখের অনুভুতি তার এক্কেবারে ভুতা হয়ে যায়। তাদের দৃষ্টি শক্তি অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আধ্মাতিকতার উঁচু মার্গে তারা অবস্থান করে। এক কথায় তারা হয় দূর দৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ।

হুদায়বিয়ার সন্ধি হয়ে গেল। সাহাবাগনের মধ্যে অস্থিরতা। আপাত দৃষ্টিতে সন্ধির শর্তগুলো মুসলমানদের জন্য অবমাননাকর মনে হয়। কিন্তু মহান রব একে ফাতহে মুবিন বলেছেন। দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মানুষ ছাড়া তা অনুধাবন করা কঠিন। অনেক সাহাবার মধ্যে হদায়বিয়ার সন্ধির শর্তে বিচলতা থাকলেও আবু বকর রাঃ ছিলেন নির্বিকার। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ভালবাসা, আল্লাহর উপর নির্ভরতা তাকে বিচলিত হতে দেয় নি। তিনি বিশ্বাস করেছেন যে কাজ আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম করেছেন, তার মধ্যেই রয়েছে সমূহ কল্যাণ। আবু রকর রাঃ বলতেন, হুদায়বিয়ার থেকে বড় বিজয় ইসলামে আর একটিও ছিল না। কিন্ত সন্ধির দিন মানুষজন এই মহা বিজয়ের নিগুড় বাস্তবতা অনুধাবন করতে পারেনি। মানুষ সব সময় তাড়াহুড়া করে। কিন্তু মহান রব তাড়াহুড়া করেন না।

আবু বকর রাঃ বলেন, আমি বিদায় হজের দিন সুহাইল রাঃ কে দেখলাম, কুরবানীর উটগুলো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিকে এগিয়ে দিচ্ছেন আর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম উটগুলো কুরবানী করছেন। এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাথার চুল কর্তনকারীকে ডেকে মাথা মুন্ডন করেন। আমি দেখলাম সুহাইল প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াল্লামের বরকতময় চুলগুলো নিয়ে চোখে লাগাচ্ছেন অথচ এই সুহাইলই হুদায়বিয়ার সন্ধির দিন চুক্তি পত্রে বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম লিখতে বাধা প্রদান করে এবং মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ লেখার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে। তিনি কোনভাবেই এ দুটি বিষয় মানতে রাজি হন নি। পরে তা না লিখেই সন্ধি স্থাপিত হয়। আমি সুহাইলের বর্তমান অবস্থা দেখে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করি। যিনি তাকে ইসলামের সুমহান ছায়াতলে আশ্রয় দিয়ে ধন্য করেছেন।

দুঃখের ঘটনা ঘটলে কে এমন আছে যে দুঃখ পায় না। কম বেশি সকলেই দুঃখ বোধ করে। কাউকে দুঃখ কাবু করে হতাশার অতল তলে ডুবিয়ে দেয়। আবার কেউ দুঃখ পেলেও হতাশ না হয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। ভেঙ্গে পড়ে না। আবু বকর রাঃ ছিলেন এমন ব্যক্তি। অন্যদিকে যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসুলের সন্তষ্টিকেই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য বানিয়ে নিয়েছে। তার দুঃখকে তো পরোয়া নেই। তার আদরের ছেলে আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকর তায়েফের যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সেই যুদ্ধে তিনি তীরের আঘাতে আহত হন। এই আহত হওয়াই তার মৃত্যুর কারন হয়। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওফাতের ৪০ দিন পর আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকরের মৃত্যু হয়। তার উপর নিক্ষিপ্ত তীরটি আবু বকর রাঃ এর নিকট ছিল। আব্দুল্লাহ ইবনে আবু বকরের মৃত্যুর পর আবু বকর রাঃ তায়েফের বনু সাকিফ গোত্রের নিকট যান। তারপর তিনি এই তীরটি দেখিয়ে বলেন, তোমরা কি কেউ এই তীরটি চিন? তখন সাইদ বিন ওবায়েদ রাঃ বললেন, আমি এই তীরটি নিক্ষেপ করেছিলাম। তখন আবু বকর রাঃ বলেন, এই তীরের আঘাতে আমার ছেলে আব্দুল্লাহ শাহাদাত বরণ করেছে। প্রশংসা শুধু সেই মহান আল্লাহর যিনি তোমার হাতে তাকে শাহাদাতের মর্যাদা দিয়েছেন। তুমি তার তার হাতে কাফের অবস্থায় মৃত্যু বরণ করনি। অর্থাৎ পরবর্তীতে তুমিও মুসলমান হয়ে গিয়েছ। আল্লাহর দয়া দু জনের প্রতিই রয়েছে।

তাবুক যুদ্ধ। কঠিন গরমের সময়। পিপাসায় প্রাণ উষ্ঠাগত। ওমর রাঃ বলেন, এই কঠিন গরমের সময় আমরা তাবুকে রওয়ানা হলাম। পথিমধ্যে আমরা এক যায়গায় যাত্রা বিরতী করি। আমাদের পিপাসা এত বেশি লেগেছিল যে, মনে হয়েছিল, আমাদের শরীরের সব শক্তি শেষ হয়ে গেছে। আমরা আর চলতে পারব না। তখন আবু বকর রাঃ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ তায়ালা আপনার সব দোয়া কবুল করেন। আপনি আল্লাহর নিকট পানির জন্য দোয়া করুন। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আবু বকর রাঃ কে বললেন, তুমি কি এটি পছন্দ কর। আবু বকর রাঃ জবাব দিলেন হ্যাঁ আল্লাহর রাসুল সাঃ। তারপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুটো হাত উঠালেন। হাত নামানোর আগেই আকাশে মেঘ দেখা গেল। প্রচুর বৃষ্টি হল। সাহাবাগনের সাথে যেসব পাত্র ছিল সব পাত্র পানিতে পূর্ণ করে নিলেন।

আবু বকর রাঃ এর দূর দৃষ্টি অনেক দূর পর্যন্ত প্রসারিত। তিনি অনেক দূরে চিন্তা করতেন। খায়বার যুদ্ধ। ইয়াহুদীরা খুব পাকাপোক্ত হয়ে খায়বারে অবস্থান করছে। কেল্লা খুব মজবুত। খায়বারের পাশে তাদের খেজুর বাগান। মুসলমানগন খায়বার অবরোধ করে বসে আছে। কেল্লা জয় করা একটু কঠিন বৈ কি। কিন্তু রাসুলে আরাবীর বিজয় নিশ্চিত। যদিও একটু বিলম্ব হয়। শেষের দিকে কয়েজন সাহাবা পরামর্শ দিলেন। তাদের শক্তি খেজুর গাছের বাগানগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। সাহাবাগনকে বললেন গাছগুলো কেটে ফেলার জন্য। সাহাবাগন দ্রুত গাছগুলো কাটতে লাগলেন। এমতাবস্থায় আবু বকর রাঃ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে গাছগুলো না কাটার জন্য পরামর্শ দিলেন। আবু বকর রাঃ বলেন, শক্তি প্রয়োগ কিংবা সন্ধি যেভাবেই খায়বার বিজিত হোক। তাতে এই গাছগুলো কাটা মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর হবে বলে মনে হয়। কেননা এগুলো বিজিত মুসলামনদের সম্পদ। তখন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবাগনকে গাছ কাটা বন্ধ করার নির্দেশ প্রদান করেন। আল্লাহ এবং রাসুলের ভালবাসা যার যত মজবুত তার অন্তর দৃষ্টি তত প্রখর। তার প্রজ্ঞা, বুদ্ধিমত্তা, বিচক্ষনতা, চিন্তাশীলতা তত প্রখর। এগুলোতে আবু বকর রাঃ কে ছাড়িয়ে যেতে পারে মুসলমানদের মধ্যে এমন কেউ নেই।

লেখক : শিক্ষাবিদ, গবেষক।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন