পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ঢাকা প্রান্তে চার ধরনের কাজের বিপরীতে রেলওয়ের ৬৬ কোটি টাকার হিসাব মেলাতে পারছে না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। ২০১৯-২০২০ এবং ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ডিএসসিসি ওই প্রকল্পের কাজ করেছে।
এর সঙ্গে জড়িতরা নিয়মবহির্ভূতভাবে কাজ করে অর্থ লোপাট করেছেন। কোনো কাজ না করেই ২৭ কোটি টাকা বিল পরিশোধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ডিএসসিসির নিজস্ব তদন্তে এসব বেরিয়ে এসেছে। ঘটনার তদন্তে ৫ প্রকৌশলীর দায় চিহ্নিত হয়েছে। ইতোমধ্যে এক নির্বাহী প্রকৌশলীকে চাকরিচ্যুতও করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ যুগান্তরকে বলেন, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক ডিএসসিসি অংশের কাজের বিস্তারিত হিসাব চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। ডিএসসিসির যারা ওই কাজের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তাদেরকে বিস্তারিত তথ্য রেলওয়ে বিভাগকে দিয়ে দেওয়ার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, রেলওয়ে থেকে দেওয়া ডিপোজিট ওয়ার্কের বর্জ্য অপসারণ কাজের বিষয়ে ডিএসসিসি নিজস্বভাবে তদন্তও করেছে। সেখানে কিছু অনিয়ম পাওয়া গেছে। এজন্য একজনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। অন্য কয়েকজনও ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেওয়ার জন্য ফাইল মেয়রের কাছে পাঠানো হয়েছে।
জানা যায়, বাংলাদেশ রেলওয়ে বিভাগ থেকে পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের ডিপোজিট ওয়ার্কের আওতায় ডিএসসিসিকে ঢাকা অংশের বেশ কিছু কাজ দেয়। কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে, রেল লাইন এলাকার বৈদ্যুতিক মালামাল অপসারণ, অস্থায়ীভাবে সড়ক আলোকিত করা, ঢাকা থেকে শ্যামপুর পর্যন্ত গভীর নর্দমা রেল লাইন প্রকল্পের অ্যালাইনমেন্টের বাইরে প্রতিস্থাপন
এবং কমলাপুর টিটিপাড়া থেকে কদমতলা পর্যন্ত রেল লাইনের উভয় পাশে স্তূপকৃত বর্জ্য অপসারণ করা। এসব কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে ডিএসসিসি যথাযথ নিয়ম অনুসরণ করেনি। ফলে কোথায় কত টাকা খরচ করেছে, তারও পরিষ্কার হিসাব দিতে পারছে না। নিয়ম অনুযায়ী কাজ শেষে রেলওয়ে বিভাগ বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করার দায়িত্ব ছিল ডিএসসিসির। কিন্তু তারা সেটা করেনি। এখন রেলওয়ে বিভাগ থেকে বারবার তাগাদা দিলেও বিস্তারিত তথ্য সরবরাহ করছে না ডিএসসিসি।
গত ২৩ আগস্ট পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক মো. আফজাল হোসেন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়েছেন। সেখানে ডিএসসিসিকে দেওয়া কাজ বাস্তবায়নে ১২ খাতে ৬৬ কোটি টাকার আর্থিক অনিয়মের কথা তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে সূত্র হিসাবে বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট প্রকল্পের অডিট অধিদপ্তরের মূল্যায়ন উল্লেখ করেছেন। সেখানে ওই অডিট অধিদপ্তরের গত ২৮ মার্চ ও ১৪ অক্টোবরের চিঠির স্মারক উল্লেখ করেছেন। ওই দুটি চিঠিতে রেলওয়ে বিভাগের কাছে খরচের বিস্তারিত হিসাব চাওয়া হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত ১ জুন ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহাম্মদ পদ্মা সেতু রেলওয়ে সংযোগ প্রকল্পের পরিচলককে একটি চিঠি লেখেন। সেখানে প্রকল্পের আওতায় টিটিপাড়া থেকে কদমতলী পর্যন্ত ডিএসসিসির তত্ত্বাবধানে অপসারিত বর্জ্যরে বিল পরিশোধ এবং কাজের সাইট বুঝে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান।
চিঠিতে বলা হয়, রেল বিভাগের চাহিদার আলোকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত ডিএসসিসি প্রকল্প এলাকার ৫৩ হাজার ৯৭৮ দশমিক ৬৭৫ টন বর্জ্য অপসারণ করা প্রয়োজন। এসব বর্জ্য অপসারণে টনপ্রতি ৪ হাজার ২৫৩ টাকা ৭০ পয়সা করে পরিশোধ করতে হবে। এজন্য ২২ কোটি ৯৬ লাখ ৯ হাজার ৮৯ টাকা ৮০ পয়সা প্রয়োজন। ওই চিঠির জবাবে ২০২১ সালের ১৬ জুন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক ডিএসসিসির কাছে কাজের বিস্তারিত হিসাব চেয়ে চিঠি দেয়। কিন্তু ডিএসসিসি রেলওয়ে বিভাগকে সে হিসাব দিচ্ছে না। জানা গেছে, কাজ না করে বিল পরিশোধ করায় ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা রেলওয়েকে আইনানুগ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করতে পারছে না।
অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, রেলওয়ে বিভাগের চিঠি আসার পর ডিএসসিসি রেলওয়ে বিভাগের চারটি কাজের মধ্যে বর্জ্য অপসারণের হিসাব পর্যালোচনা করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি তদন্ত করে বর্জ্য অপসারণ কাজের বিভিন্ন অনিয়ম, বিচ্যুতি এবং অর্থ লোপাটের প্রমাণ পায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, দায়িত্বপ্রাপ্তরা পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রুলস অনুসরণ না করেই ৩ জন ঠিকাদারকে ২৭ কোটি টাকার কাজ দিয়েছে।
এছাড়া কোন ধরনের কাজ না করেই ২৭ কোটি টাকা বিল পরিশোধ করেছে। এজন্য দায়ীদের চিহ্নিত করে ডিএসসিসি মেয়রকে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এ প্রতিবেদনে নাম রয়েছে, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. আরিফুল হক, উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. জাকির হোসেন, নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ হারুন, প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী তাওহীদ সিরাজ এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. খায়রুল বাকেরের নাম।
প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী তাওহীদ সিরাজ শুক্রবার যুগান্তরকে বলেন, বিষয়টি আমি জানি। কিন্তু আমি এ কাজের টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত নই। তদন্ত প্রতিবেদনে আমার নাম দেওয়ার বিষয়টি সঠিক হয়নি। এ ছাড়া অন্যদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাদের পাওয়া যায়নি।
এদিকে এ অভিযোগে গত ২৮ ফেব্র“য়ারি ডিএসসিসির কর্মচারী চাকরি বিধিমালা ২০১৯-এর ৬৪ (২) বিধি অনুসারে ৯০ দিনের বেতন-ভাতা দিয়ে নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল্লাহ হারুনকে চাকরি হতে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অন্যদের ব্যাপারে এখনো কোনো ধরনের আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন