পূর্ব প্রকাশিতের পর
সাহাবায়ে কেরামের সমালোচনা ও তাঁদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ না করতে হাদিসে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন- সাবধান! আমার সাহাবিদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় করো। আমার পরে তোমরা তাদেরকে সমালোচনার লক্ষ্যবস্তু বানিও না। যে আমার সাহাবিদেরকে ভালবাসল, সে আমার ভালবাসার খাতিরেই তাদেরকে ভালবাসল। আর, যে আমার সাহাবিদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করল, সে আমার প্রতি হিংসা-বিদ্বেষের কারণেই তাদের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করল। যে আমার সাহাবিদেরকে কষ্ট দিল, সে আমাকে কষ্ট দিল। আর যে আমাকে কষ্ট দিল, সে আল্লাহকে কষ্ট দিল। আর যে আল্লাহকে কষ্ট দিল, আল্লাহ শীঘ্রই তাকে পাকড়াও করবেন। (জামে তিরমিযি : আবওয়াবুল মানাকিব, ৩৮৬২) দ্রষ্টব্যঃ ইমাম তিরমিযি উক্ত হাদিসের সনদকে গরিব বলেছেন।
সাহাবিদেরকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ ভেবে তাঁদের ব্যাপারে মন্দ কথা বলা গুরুতর অন্যায়। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেছেন তোমরা মুহাম্মদ (সা.)-এর সাহাবিদের ব্যাপারে বিদ্রূপ-সমালোচনা করোনা। তাঁদের একটি মুহূর্ত তোমাদের চল্লিশ বছরের ইবাদত থেকে উত্তম। (ফাদ্বায়িলুস সাহাবা : ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল, ১৫২৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সাহাবিদের মর্যাদা বর্ণনায় আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেছেন- আল্লাহ তাঁর বান্দাদের অন্তরে দৃষ্টিপাত করলেন। তিনি মুহাম্মদ (স.)-এর অন্তরকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অন্তর হিসেবে পেলেন। তিনি তাঁকে নির্বাচিত করলেন এবং রিসালাতের জন্য মনোনিত করলেন। অতপর বাকি বান্দাদের অন্তরে দৃষ্টিপাত করলেন। তিনি সাহাবিদের অন্তরকে তাঁর বান্দাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ অন্তর হিসেবে পেলেন। অতএব তিনি তাঁদেরকে তাঁর নবী (সা.)-এত সহকারী এবং দ্বীনের পথে ত্যাগ স্বীকারকারী হিসেবে মনোনিত করলেন। (মুসনাদ : ইমাম আহমদ, ১/৩৭৯)
আহলে সুন্নাত ওয়াল-জামা’আত দৃঢ়ভাবে স্বীকৃতি দেয়, সাহাবায়ে কেরাম এ উম্মতের সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তিবর্গ। তাঁরা প্রত্যেকেই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন এবং তাঁদের ঐক্যমত ইসলামি শরী’আতের অকাট্য দলিল। সাহাবিদের ঈমান ও নিয়ত, ইসলামের প্রতি তাঁদের অঙ্গীকার এবং রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি তাঁদের অকৃত্রিম ভালবাসা ও প্রতিশ্রুতির ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করা ঘোরতর অবিচার। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা’আলা এসব ব্যক্তিদেরকে তাঁর প্রিয়নবী (সা.)-এর মোবারক সাহচর্যে ধন্য করেছেন। আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সাহাবিদের দ্বীন ও জ্ঞানের পরিপক্বতা সম্পর্কে বলেছেন-সাহাবিগণ হৃদয়ের দিক থেকে এ উম্মতের সবচেয়ে উত্তম ব্যক্তিবর্গ। জ্ঞানের দিক থেকে পরিপক্ব, মতপার্থক্যের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সামান্য, হেদায়াতের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বলিষ্ঠ, চারিত্রিক অবস্থার বিচারে সবচেয়ে সুন্দর। আল্লাহ তাঁদেরকে তাঁর নবী (সা.)-এর সাহচর্য এবং তাঁর দ্বীনকে বিজয়ী করার জন্য মনোনিত করেছেন। তাঁদেরকে ভালবাসা সুন্নাত, তাঁদের জন্য দু›আ করা পূণ্যময় কাজ, তাঁদের অনুসরণ করা মুক্তির মাধ্যম এবং তাঁদের শিক্ষা গ্রহন করা মাহাত্মপূর্ণ কাজ। (আল-আকীদাহ, ১/৮১)
তবে আহলে সুন্নাত একথা বলতেও দ্বিধাবোধ করেনা যে, সাহাবায়ে কেরাম ভুলত্রুটির উর্দ্ধে নন। কেবল নবী-রাসুলগণ ভুলত্রুটির উর্দ্ধে, কারণ আল্লাহ তাঁদেরকে ওহীর দ্বারা দিক-নির্দেশনা দিয়ে থাকেন। যেহেতু সাহাবিদের প্রতি ওহী বা ঐশী দিক-নির্দেশনা অবতীর্ণ হয়না, সুতরাং তাঁদের ইজতিহাদ তথা চিন্তা ও গবেষণায় মানবিক ভুলত্রুটি হতে পারে, তথ্য বিস্মৃত হতে পারে। এজন্য কোন বিষয়ের উপর সাহাবিদের ঐক্যমত ইসলামি শরী’আতের দলিল হলেও কোন একক সাহাবির প্রতিটি ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তকে গ্রহন করা উম্মতের উপর ওয়াজিব নয়। হতে পারে, একটি আইনি জটিলতা কিংবা একটি রাজনৈতিক সমস্যায় একজন সাহাবি একটি রায় দিয়েছেন, আরেকজন ভিন্ন রায় দিয়েছেন। এক্ষেত্রে যে কোন একজনের মতামতকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। আবার, সাহাবিদের চিন্তা ও গবেষণাগত ত্রুটির জন্য তাঁদেরকে দোষী সাব্যস্ত করে সমালোচনা করা জগন্য অপরাধ। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া-তা’আলা সাহাবিদের যাবতীয় ভুলত্রুটি ক্ষমা করে দিয়েছেন এবং তাঁদের উপর সন্তুষ্ট হয়েছেন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে- আর যারা হিজরতকারীদের মধ্যে অগ্রগামী এবং আনসারদের মধ্যে এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে, আল্লাহ সে সমস্ত লোকদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছে। (সুরা তাওবাহ : ১০০)
সুতরাং আল্লাহ যাদের উপর সন্তুষ্ট হয়ে গেছেন, তাঁদের সমালোচনা করা ঈমানের লক্ষণ নয়। ইমাম আবু যার’আ বলেছেন- যখন দেখবে কোন ব্যক্তি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর একজন সাহাবিরও সমালোচনা করেছে। জেনে রাখবে, সে ধর্মদ্রোহী। (আল-ইসাবাহ ফি তামঈযিস সাহাবা : ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী)
আহলে সুন্নাত বিশ্বাস করে, সাহাবিরা সবাই সমমর্যাদার নন। কুরআনুল কারীমে ইরশাদ করা হয়েছে- তোমাদের মধ্যে যে মক্কা বিজয়ের পূর্বে (আল্লাহর পথে) ব্যয় করেছে ও জিহাদ করেছে, সে সমান নয়। এরূপ লোকদের মর্যাদা তাদের চেয়ে বেশি, যারা পরে ব্যয় করেছে এবং জিহাদ করেছে। তবে আল্লাহ উভয়কে কল্যাণের ওয়াদা দিয়েছেন। (সুরা হাদীদ : ১০)
এ আয়াতের ব্যবহারিক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনে খাত্তাব (রা.)-এর সিদ্ধান্তে। তিনি তাঁর খেলাফতকালে সাহাবিদেরকে ইসলাম গ্রহনের সময় অনুসারে ১২টি স্তর বা শ্রেণিতে বিন্যস্ত করেছিলেন। স্তর অনুযায়ী সাহাবিদেরকে বাইতুল মাল থেকে ভাতা দেয়া হতো। উক্ত বিন্যাসে উমর (রা.) সর্বাগ্রে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ এবং আহলে বায়েতকে রেখেছিলেন। এরপর অন্যান্য সাহাবিদেরকে। আহলে বায়েত শব্দটির শাব্দিক অর্থ হচ্ছে ঘর বা পরিবারের সদস্যবৃন্দ। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পরিবারবর্গকে ইসলামি পরিভাষায় আহলে বায়েত বলে আখ্যায়িত করা হয়। আহলে বায়েতের প্রথম সদস্য হচ্ছেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর পবিত্র স্ত্রীগণ। আল্লাহ তাঁদেরকে সাধারণ নারীদের থেকে পৃথক করেছেন এবং অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছেন। কুরআনে ইরশাদ করা হয়েছে- হে নবীপত্নীগন! তোমরা অন্যান্য নারীদের মতো নও। (সুরা আহযাব : ৩২) (চলবে)
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, অধ্যয়ণরত- (মাস্টার্স) রিলিজিয়াস স্টাডিজের অধীনস্থ ইসলামিক স্টাডিজ,
এয়ারফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন