ইউক্রেন যুদ্ধ পরবর্তী বিশ্বে রাশিয়ার উপর পশ্চিমা নিষেধজ্ঞার প্রেক্ষাপটে বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় অস্থিরতা ও মূল্য উল্লম্ফন দেখা দিয়েছে। ডিজেল, এলএনজি ও ফার্নেস অয়েলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এসব জ্বালানির উপর নির্ভরশীল আমাদের অনেক বিদ্যুতকেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। দেশের মানুষ এখন বিদ্যুতের রুটিন লোডশেডিং বা রেশনিং মানতে বাধ্য হচ্ছে। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে বিদ্যুতহীন বাসাবাড়িতে গ্যাসের লাইনে গ্যাস না থাকায় শহুরে নাগরিকদের অশেষ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। দেশে বিদ্যুত ঘাটতি চরম আকার ধারণের অনেক আগে থেকেই গ্যাসের সংকট চললেও এ সংকট মোকাবেলায় গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিগুলো তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বছরের পর বছর ধরে শিল্পকারখানা ও আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ রাখা হলেও অবস্থার উন্নয়নে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিস্কার ও পুরনো গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উন্নয়ন ও গ্যাসলাইনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের প্রত্যাশিত কার্যক্রম অগ্রাহ্য করা হয়েছে। গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন ও সেবার মানোন্নয়নে তেমন কোনো পদক্ষেপ না থাকলেও দেশের প্রধান গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি তিতাস গ্যাসের সর্বোচ্চ পদ থেকে মাঠ পর্যায়ের কর্মচারীদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত দুর্নীতি-স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগগুলো কখনোই স্বচ্ছতার ভিত্তিতে বিচারের আলোয় আনা হয়নি। এ কারণে কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে তিতাস গ্যাসের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের আকণ্ঠ দুর্নীতির খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
দেশের অধিকাংশ এলাকায় আবাসিক খাতে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধ রয়েছে। গ্যাসের অভাবে কিছু বিদ্যুতকেন্দ্রে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় সামগ্রিক বিদ্যুত উৎপাদনে বিরুপ প্রভাব পড়েছে। ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকায় দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়ে গ্যাসের চুলা জ্বলে না। এতে পেশাজীবী মানুষের জীবনযাত্রার উপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়েছে। দিনের বেশিরভাগ সময় গ্যাস সরবরাহ না থাকলেও বার বার বাড়ানো হচ্ছে গ্যাসের দাম। দুই চুলার গ্যাসলাইনের মাসিক বিল সম্প্রতি ৯৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০৮০ টাকা করা হয়েছে। মানুষ গ্যাস পাচ্ছে না, অনেকে ক্যারোসিনের স্টোভ অথবা এলপিজি সিলিন্ডার কিনে রান্নাবান্নার কাজ চালানোর পাশাপাশি অকেজো গ্যাস লাইনের জন্য প্রতিমাসে বর্ধিত হারে বিল দিতে বাধ্য হচ্ছে। অন্যদিকে তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির প্রতিটি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের বেশিরভাগই নানা রকম দুর্নীর্তির মাধ্যমে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে গেছে। পত্রপত্রিকায় উঠে আসা তথ্যের ভিত্তিতে মাঝে মাঝে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তের খবর প্রকাশিত হলেও আদতে কারোই কিছু হয়না। গত বছরও তিতাস গ্যাস মতিঝিল শাখার একজন ব্যবস্থাপকসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে তদন্তে নামে দুদক। তদন্তে অবৈধ সম্পদের খতিয়ান বেরিয়ে আসার পর কারো কারো নামে মামলা হলেও এ পর্যন্ত কারোই কিছ্ ুহয়নি। এভাবেই দুর্নীতিবাজ তিতাস কর্মকর্তারা বেপরোয়া কর্মকান্ড অব্যাহত রেখেছে।
গতকাল ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনে তিতাস কর্মকর্তাদের বেপরোয়া দুর্নীতির যে সব চিত্র বেরিয়ে এসেছে তা কোনো নতুন বিষয় নয়। বছরের পর বছর ধরে জনসম্মুখে, প্রশাসন ও দুর্নীতিদমন কমিশনের সংশ্লিষ্টদের চোখের সামনেই এসব ঘটছে। যেখানে গ্যাসের অভাবে বাসাবাড়িতে চুলা জ্বলছে না, বিদ্যুতকেন্দ্রে ও সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে, সেখানে তিতাস গ্যাস কর্মকর্তারা ব্যক্তিগত যোগসাজশে অসংখ্য অবৈধ গ্যাসসংযোগ দিয়ে মাসে কোটি কোটি টাকা আদায় করে নিজেদের পকেটে ভরছেন। তিতাস গ্যাস কর্মকর্তাদের ঘুষবাণিজ্য ও মাসোহারার ভিত্তিতে লাইসেন্সবিহিন ও অবৈধ সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনের তথ্যও বেরিয়ে এসেছে ইনকিলাবের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে। এসব অবৈধ সংযোগ বন্ধে এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন থেকে ৮দফায় চিঠি দেয়ার পরও তিতাস গ্যাসের এমডি বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের অনুমোদন ছাড়াই প্রি-পেইড মিটারের মাসিক ভাড়া ৬০ থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা নেয়া হচ্ছে। ৫-১০ হাজার টাকা মূল্যের প্রি-পেইড মিটার পেতে ২৩ হাজার টাকায় ক্রয় করার তথ্যও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গ্যাসনির্ভর শিল্প কারখানার মালিকরা প্রকারান্তরে তিতাস গ্যাসের একশ্রেণীর দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার কাছে জিম্মি হয়ে আছেন। সাধারণ আবাসিক গ্রাহক থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা এবং সার-বিদ্যুতের মত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান পর্যন্ত ভোগান্তির শিকার। অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে আবাসিক খাতে নিরিবচ্ছিন্ন গ্যাস রবরাহ নিশ্চিত করা সম্ভব। গ্যাসের চুরি অপচয় বন্ধ করা গেলে মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না। চুরি, অপচয়, সিস্টেমলস বন্ধ করার পাশাপাশি গ্যাসলাইনের সংস্কারের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির উদ্যোগ নিতে হবে। বিভিন্ন সময়ে দুদকের অনুসন্ধানে যে সব তথ্য বেরিয়ে এসেছে এবং সুপারিশমালা গৃহিত হয়েছে সে সব সুপারিশমালা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তিতাস গ্যাসসহ দেশের গ্যাস-বিদ্যুত খাতকে দুর্নীতিমুৃক্ত করার বাস্তব পদক্ষেপ নিতে হবে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার পাশাপাশি তাদেরকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন