ল্যাংড়ার ভাসমান জীবন। খুনের দায় এড়াতে সে এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। যেখানেই যায় সেখানেই সে নতুন মানুষের সঙ্গে নতুন স¤পর্কে জড়ায়। একদিন টঙ্গী রেলওয়ে স্টেশনে কালা এবং কালার স্ত্রী সোহাগীর সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে। যে পরিচয় ল্যাংড়ার জীবনে নানারকম জটিলতার জন্ম দেয়। এটাই আদিম সিনেমার গল্পের সারসংক্ষেপ। ‘আদিম’ সিনেমাটি মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের ৪৪তম আসরে জিতে নিয়েছে ‘নেটপ্যাক জুরি অ্যাওয়ার্ড’। আদিমের গল্পে টানাপড়েন আছে বটে, তবে এর গল্পের মতই এর নির্মাণ প্রক্রিয়ায় জটিলতা, বাধা, তিরস্কার, মানুষের হামলা, নিন্দা, লজ্জা, নির্ঘুম রাত কাটানো, অর্থাভাবসহ নানা প্রতিকূলতার বাস্তব ঘটনা রয়েছে। এই সিনেমা নির্মাণে কতটা প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, তা সিনেমাটির পরিচালক ও শিল্পীদের মুখ থেকে উঠে এসেছে এর সংবাদ সম্মেলনে। গত ৮ সেপ্টেম্বর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত ফিল্ম আর্কাইভের সেমিনার হলে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন অভিজ্ঞতার কথাই তুলে ধরলেন ‘আদিম’ সিনেমার পরিচালক যুবরাজ শামীম ও শিল্পীরা। ২০১৬ সালে ‘আদিম’ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন শামীম। কিন্তু একটি সিনেমা বানাতে অর্থসহ যা প্রয়োজন বলতে গেলে তার কিছুই তার ছিল না। তবে হাল ছাড়েননি। ২০১৭ সালে নেদারল্যান্ডসের এক নির্মাতা আদিমের গল্প শুনে সেটি নির্মাণের জন্য ২০০ ইউরো দিয়ে যায়। সেই থেকে শামীম আদিম নির্মাণের অনুপ্রেরণা পান। সিনেমাটির কাজ স¤পন্ন করতে অনেক টাকার দরকার ছিল। টাকা যোগাড় করতে সিনেমার শেয়ার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। ফেসবুকে শেয়ার বিক্রির ঘোষণা দেন। সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে নির্মাণ শুরু করেন সিনেমাটির। রেলওয়ে বস্তিকে ঘিরে সিনেমাটির গল্প। পরিচালক চিন্তা করলেন চরিত্রগুলোও বস্তির হলেই ভালো হবে। সেই চিন্তা থেকেই আবিষ্কার করেন বাদশা, দুলাল সোহাগীদের মত একেবারে আনকোড়া ও অভিনয় অজানা মানুষদের, যাদের জীবন কেটেছে অভাব আর হতাশায় টঙ্গী বস্তিতে। তাদেরকে নিয়েই নির্মিত হয়েছে আদিম। সত্যিকার অর্থে এই মানুষগুলোর কি কোন লাভ হয়েছে? এমন প্রশ্নের জবাবে যুবরাজ শামীম বলেন, সত্যিকার অর্থে লাভ আমারই হয়েছে। মস্কোতে আদিম দেখানো হয়েছে, অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে। সবাই কিন্তু আমাকেই চিনছে। তাদের কেউ ওইভাবে চিনছে না। আমি চাই তাদেরও লাভ হোক। তাদেরকে সবাই চিনুক। তারা কাজ করুক। অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে সিনেমাটিতে অভিনয় করা শিল্পীরা বলেন, শামীম ভাই যখন আমাদের বস্তিতে এসে থাকা শুরু করলেন আমরা তাকে পাগল ভেবেছি। তারপর যখন উনি আমাদের একটা সিনেমার কথা বললেন তখন অনেক হেসেছি । আমরা বস্তির মানুষ। কি করে সিনেমায় অভিনয় করব! শামীম ভাই আমাদের বোঝালেন। তার কথা ভালো লাগায় রাজী হয়ে যাই। তার সাথে কাজ করতে গিয়ে আমাদেরকে মানুষের অনেক কথা শুনতে হয়েছে। শুটিং এর সময়ও পুলিশ আমাদের অনেক সমস্যা করেছে। শামীম ভাইকে ধরেও নিয়ে গেয়েছিল, পরে ছেড়ে দিয়েছে। বস্তির লোকজন বলত, আমরা নাকি পাগলের সাথে চলি। এসব টিভির পিছনে দেখা যাবে, আমরা ইউটিউব করি। এসব নানা কথাবার্তা বলে লজ্জা দিত, অপমান করত। আজ যখন আমাদের সিনেমাটা বিদেশে পুরষ্কার পেয়েছে, তখন তারাই নিজ থেকে এসে আমাদের কাছে জানতে চায় সিনেমাটা কোথায় দেখা যাবে। এখন সবাই আমাদের সাথে মিশে, আমাদেরকে অন্যরকম ভাবে দেখে। এটা খুব ভালো লাগছে। সবকিছুই হয়েছে যুবরাজ শামীম ভাইয়ের জন্য। আমরা তার কাছে কৃতজ্ঞ। আমাদের সিনেমা বিদেশে পুরস্কার পাওয়ায় আমরা অনেক আনন্দিত। আমরা আরও ভালো ভালো কাজ করতে চাই । সংবাদ সম্মেলনে ‘আদিম’ সিনেমার অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির কথা বলতে গিয়ে যুবরাজ শামীম বলেন, পাঁচটা বছর অনেক বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলায় দুলেছি। যখন মস্কো থেকে আমন্ত্রণ পেলাম মনে হলো, কিছু একটা করতে পেরেছি। তবে আমি ভাবিনি সেখানে পুরস্কার পাব, সিনেমাটি প্রশংসিত হবে। আজ আমার সব পরিশ্রম ও কষ্ট সার্থক হয়েছে। তিনি জানান, আদিম নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৫ লাখ টাকা। তবে এর মধ্যে পরিচালক, শিল্পী, এডিটিং ব্যয়সহ আনুষাঙ্গিক খরচসহ অনেক কিছুই অন্তর্ভুক্ত নয়। গণঅর্থায়নে আমার নিজস্ব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান রসায়ন-এর ব্যানারে নির্মিত এবং সহ প্রযোজক হিসেবে সিনেমাকার ও লোটাস ফিল্ম যুক্ত রয়েছে। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণে ছিলেন আমির হামযা এবং সাউন্ড ও কালার করেছেন সুজন মাহমুদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন