বার আউলিয়ার পুণ্যভূমি চট্টগ্রামের বাকলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণকারী আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী রহমাতুল্লাহি আলায়হি এক ক্ষণজন্মা মহান ব্যক্তিত্ব। জন্মসূত্রে তাঁর মধ্যে ছিলো অসাধারণ মেধা ও প্রতিভা। তিনি তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের অগণিত অবদানের মাঝে অমর, স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন ও থাকবেন। উল্লেখ্য, তাঁর ওইসব গুণের সাথে সংযুক্ত হয়েছে তাঁর প্রতি আপন মুর্শিদ ও গাউসে যমানের কৃপাদৃষ্টি, যা তাঁর জীবনে এনে দেয় অকল্পনীয় পূর্ণতা।
১৯১৭ ইংরেজি আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী বাকলিয়ার এক মধ্যবিত্ত সম্ভ্রান্ত ও ধার্মিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি পৈত্রিক ক্ষুদ্র ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়াসী হন। সুতরাং অল্প সময়ে তিনি পুরো চট্টগ্রামে এক সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। তিনি বক্সিরহাট মার্চেন্ট ডিফেন্স কমিটির সভাপতি, চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সমিতির সম্মানিু সদস্য, চট্টগ্রামের ভোজ্য তৈল ও তুলা আমদানিকারক সমিতির সভাপতি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ট্রাস্ট সদস্য হিসেবে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ী পরিমন্ডলে খ্যাত হন। এমনকি তিনি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট থেকে পূর্ব পাকিস্তানের ব্যবসায়ীদের দাবী-দাওয়া আদায়ে মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, রাজনীতির অঙ্গনেও তিনি এক বিশেষ পদমর্যাদায় আসীন হন। তিনি ছিলেন জন দরদী, প্রসিদ্ধ সমাজ সেবকও। তিনি জমিয়াতুল ফালাহ্ জাতীয় মসজিদের বোর্ড অফ গভর্নরস্ এর সদস্য ও হজ্জ্ব কমিটির সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী নিজে যেমন জ্ঞানপিপাসু ছিলেন, তেমনি সমাজে জ্ঞান ও শিক্ষার প্রসারের গুরুত্বকে যথাযথভাবে অনুভব করেছেন। সুতরাং তিনি চট্টগ্রাম শহর এলাকায় প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উদ্যোগী হন। তিনি লামাবাজার, চরচাক্তাই বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুলজার বেগম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় এবং বাকলিয়ার প্রসিদ্ধ ফোরক্বানিয়া মাদরাসা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মূল ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। সর্বোপরি এশিয়া বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া (চট্টগ্রাম), জামেয়া ক্বাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া আলিয়া (ঢাকা) এবং হালিশহর ও চন্দ্রঘোনা মাদ্রাসাসহ বহু দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কায়েমের ক্ষেত্রে সর্বাধিক অবদান রাখেন বর্তমানে সারাদেশে শতাধিক মাদ্রাসার পরিচালনাকারী, বহু আধ্যাত্মিক সংগঠন, যেমন ‘গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ, অনেক ধর্মীয় যুগোপযোগী গ্রন্থ ও আহলে সুন্নাতের একমাত্র মাসিক মুখপত্র ‘তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত’ ইণ্যাদির পরিচালক ও প্রকাশক সংগঠন আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার আজীবন সহ-সভাপতি ছিলেন আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলক্বাদেরী। তিনি স্ব-উদ্যোগে যে জ্ঞান-ভান্ডার আয়ত্ব করেছিলেন তা সত্যি বিস্ময়কর। তাঁর কথাবার্তা, বক্তব্য ও যেকোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত প্রদান ইণ্যাদির মাধ্যমে এ স্যু প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি উপমহাদেশের সুপ্রসিদ্ধ মুর্শিদে বরহক্ব আওলাদ-ই রসূল হযরতুল আল্লামা হাফেয ক্বারী সৈয়দ আহমদ শাহ্ সিরিকোটি (ওরফে হযরত পেশোয়ারী সাহেব) আলায়হির রাহমাহর হাতে বায়’আত গ্রহণ করেন এবং তাঁর সান্নিধ্যে অতি অল্প সময়ে ‘ফানাফিশ্ শায়খের’ মর্যাদায় উন্নীত হন। ইতোমধ্যে তিনি শরীয়ত, ত্বরীকত, বিশেষত আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের নিষ্ঠাপূর্ণ খিদমতে আত্মনিয়োগ করেন। সিলসিলাহ্-ই আলিয়া ক্বাদেরিয়া সিরিকোটিয়ার জন্য তিনি যে অসাধারণ অবদান রাখেন, তা চিরদিন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। এরই অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায় এতে যে, তাঁর মহান মুর্শিদের সুযোগ্য উত্তরসূরী মাদারাযাদ ওলী মুর্শিদে বরহক্ব সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রাহমাতুল্লাহি আলাইহি তা’আলা আলাইহি) তাঁকে খিলাফতের মহা মর্যাদায় আসীন করেছিলেন। তাছাড়া তাঁর নামের সাথে ‘সওদাগর’ -এর স্থলে ‘আলক্বাদেরী’ও শোভা পেতে থাকে। আলহাজ নূর মুহাম্মদ আলকাদেরী আপন মুর্শিদে বরহক্বের আনুগণ্য তথা ত্বরীকত জগতের এক অনন্য উদাহরণ। মুরীদ আপন মুর্শিদের আনুগণ্য কীভাবে করতে হয় এবং এ ক্ষেত্রে কত নিষ্ঠার সাথে অনুশীলন করলে আপন কামিল মুর্শিদের কৃপাদৃষ্টি লাভ করা যায়, একজন মুরীদ আল্লাহ ও তাঁর রসূলের নিকট কিভাবে প্রিয় হতে পারে তার সমুজ্জ্বল উদাহরণ হলেন আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী।
একটি পুণ্যময় মিশনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য মজবুত সংস্থা-সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। শাহেনশাহে সিরিকোটের সুদূর প্রসারী ও যুগান্তকারী দ্বীনী মিশন ছিলো শরীয়ত ও ত্বরীকতের আলোয় গণ-মানুষের অন্তরাত্মাকে ব্যাপকভাবে আলোকিত করা। এ গুরুত্বপূর্ণ ধারার সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য শাহেনশাহে সিরিকোট ‘আনজুমান-ই- শূরা-ই রহমানিয়া (পরবর্তীতে আন্জুমান -ই রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট) প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি আন্জুমানের সর্বপ্রথম সহ-সভাপতি নিযুক্ত হন। তিনি বলুয়ারদীঘি পাড়স্থ নিজ বাসভবনের পূর্ণ এক তলা খানক্বাহ্ শরীফের জন্য ওয়াক্বফ করে দেন ও নিজ খরচে পরিচালনা করেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার সময়ও তিনি আপন মহান মুর্শিদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটানোর ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। জামেয়া প্রতিষ্ঠার এমন পরামর্শ সভায় বাঁশ-বেড়া ও টিনের ছাউনী কিংবা সেমি পাকা ঘর তৈরীর প্রস্তাবাবলী উপস্থাপিত হলে হুযূর ক্বেবলা তাতে রাজি হননি। হুযূর ক্বেবলার ইচ্ছা যে প্রথম থেকেই জামেয়া একটি মনোরম পাকা দালানেই প্রতিষ্ঠিত হোক সেটা আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন এবং তিনি সাথে সাথে প্রস্তাব দিয়েছিলেন জামেয়ার জন্য পাকা দালানই হবে আর যাবতীয় রড-সিমেন্ট তিনিই প্রদান করবেন মর্মে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করলেন। এতে হুযুর কেবলা অত্যন্ত খুশী হন এবং বিশেষভাবে দো’আ করেন।
এভাবে জামেয়া প্রতিষ্ঠা লাভ করলো। আর আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরী আজীবন জামেয়া-আন্জুমানের সর্বোচ্চ খিদমু আঞ্জাম দিয়ে যান। মোটকথা হযূর কেবলার শরীয়ত ও ত্বরীকত সমন্বিত অনন্য সুন্দর এ মিশনকে দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যান এ নিষ্ঠাবান ব্যক্তিত্ব। তাছাড়া হুযূর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত জামেয়া কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া (ঢাকা)’র প্রতিষ্ঠা এবং মুসলিম বিশ্বের বৃহত্তর জশনে জুলুসের প্রবর্তনের গোড়ায়ও আলহাজ নূর মোহাম্মদ আলকাদেরীর ভূমিকা চির ভাস্বর হয়ে থাকবে। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রর্বতিত বিশাল জশনে জুলুসের প্রথম দু’বছর তিনিই নেতৃত্ব দেন।
তিনি হুযূর ক্বেবলাগণের সান্নিধ্যে ছায়ার মতোই থাকতেন। হজব্রত পালনসহ দেশ-বিদেশ সফরে হুযূর ক্বেবলার সাথে ছিলেন। তিনি হুযুর ক্বেবলা সৈয়দ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্’র সাথে বাগদাদ শরীফ, আজমীর শরীফ, ইয়াঙ্গুনসহ বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সফর করেন। এ মহান ওলীগণের সান্নিধ্যের ফলে বেলায়তের বহু রহস্য প্রত্যক্ষ করতে তিনি সক্ষম হন। যার সুপ্রভা তাঁর ব্যক্তিজীবনের উপর প্রতিফলিত হয়েছিল।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও তিনি অকৃত্রিম দেশ প্রেমের পরিচয় দেন। তদানীন্তনকালীন দেশে যেই রাজনৈতিক মোর্চারই তিনি সমর্থক থাকুন না কেন, কল্যাণমুখী রাজনীতি সমাজসেবা ও দেশপ্রেমই তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় সুষ্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছিলো। বাংলাদেশের স্বাধীনুা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁর পরিচালনাধীন আন্জুমানের অধীনে জামেয়া সহ যু প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছিলো কোন প্রতিষ্ঠানের কোন ছাত্র-শিক্ষক স্বাধীনুা বিরোধী কোন কর্মকান্ডে জড়িত হয়নি; বরং জামেয়ায় তখন কঠোরভাবে নোটিশ জারী করা হয়েছিলো যেন কেউ তদানীন্তন তথাকথিত শান্তি কমিটির আহ্বানে সাড়া দিয়ে কিংবা অন্য কোনভাবে স্বাধীনুাবিরোধী সংগঠনে ও কর্মকান্ডে জড়িত না হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে মাদ্রাসা থেকে বহিস্কার করার নির্দেশ ও দেয়া হয়েছিলো। উল্লেখ্য, স্বাধীনুাত্তোরকালে জামেয়া পরিদর্শনে এসে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী ও আওয়ামী ওলামা পরিষদের সভাপতি মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগিশ প্রমুখ এসব রের্কড দেখে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। জামেয়া ও আন্জুমানের ভূয়সী প্রশংসা করে পরিদর্শন বইতে স্বাক্ষর করেন। [সূত্র: বাঙ্গাল কেন যুদ্ধে গেল: কৃত সিরু বাঙ্গালী ও জামেয়ার রেকর্ডপত্র] (চলবে)
লেখক: মহাপরিচালক-আনজুমান রিসার্চ সেন্টার, চট্টগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন