ক্রয়ক্ষমতা কমাকেই দুষছেন অর্থনীতিবিদরা
পুরনো পাওনা আদয়ের পরামর্শ
লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে পরিকল্পনার অভাব
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থবিরতার বিরূপ প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আয়ে। দিনে দিনে বেড়েই চলেছে রাজস্ব ঘাটতি। ডলারের দাম বাড়া এবং বৈশ্বিক পণ্যের উচ্চ মূল্যের কারণে আমদানি-রফতানিতে ভালো প্রবৃদ্ধি হলেও বেহাল অবস্থা আয়কর এবং ভ্যাট আদায়ে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) গড় প্রবৃদ্ধি দুই অঙ্কের কোটা ছাড়ালেও আয়কর ও ভ্যাটে রাজস্ব প্রবৃদ্ধি দুই শতাংশের কোটায় ঘুরপাক খাচ্ছে। বিশাল অঙ্কের রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে রাজস্ব ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩১৯ দশমিক ৪৪ কোটি টাকা। এনবিআর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
তবে এনবিআরের ঘাটতি বাড়ার পেছনে বৈশ্বিক অস্থিরতার জেরে মানুষের ক্ষয়ক্ষমতা কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন অর্থনীতিবিদরা। সেই সঙ্গে পুরোনো পাওনা আদায়ে রাজস্ব বোর্ডকে পরামর্শ তাদের। সেই সঙ্গে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে এনবিআরের পরিকল্পনা অভাব আছে বলে মনে করেন তারা।
এনবিআর সূত্র জানায়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা। সেই হিসেবে চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (সাময়িক হিসেবে) এনবিআরের রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৪৩ হাজার ৫৯০ কোটি টাকা। আলোচ্য সময়ে এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছে ৪০ হাজার ২৭০ কোটি টাকা। অর্থাৎ রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৩১৯ দশমিক ৪৪ কোটি টাকা।
তবে বছরের প্রথম দুই মাসে লক্ষ্যমাত্রার ৯২ দশমিক ৩৮ শতাংশ আদায় করতে পেরেছে এনবিআর। আলোচ্য সময়ে রাজস্ব আয়ে গত অর্থবছরের (২০২১-২২) তুলনায় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২১ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে রাজস্ব আদায় হয়েছিল ৩৩ হাজার ২৪৬ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা। অবশ্য প্রথম দুই মাস শেষে চলতি অর্থবছরের মোট লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮৯ দশমিক ১২ শতাংশ পিছিয়ে আছে রাজস্ব বোর্ড।
রাজস্ব বোর্ড সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরের আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায়ে মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা। আগস্ট পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রা ১৫ হাজার ১৭২ কোটি টাকা নির্ধারিত ছিল। আদায় হয়েছে ১৪ হাজার ৮৬৩ দশমিক ৬০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই খাতে আদায় কম হয়েছে ৩০৮ দশমিক ৪০ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৯৭ দশমিক ৯৭ শতাংশ। গত অর্থবছর একই সময়ে ১১ হাজার ৫৬১ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর। সে হিসেবে গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ২৮ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এ খাতে মোট লক্ষ্যমাত্রা থেকে অবশ্য এখনও ৮৬ দশমিক ৬১ শতাংশ পিছিয়ে রাজস্ব বোর্ড।
স্থানীয় পর্যায়ে মূসকে চলতি অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। আগস্ট পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রা ১৬ হাজার ৪২৮ কোটি টাকা নির্ধারিত ছিল। আদায় হয়েছে ১৫ হাজার ৩৩ দশমিক শূন্য ৭ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই খাতে আদায় কম হয়েছে ১ হাজার ৩৯৪ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৯১ দশমিক ৫১ শতাংশ। গত অর্থবছর একই সময়ে ১২ হাজার ৯৬৫ দশমিক ৬২ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর। সে হিসেবে গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ১৫ দশমিক ৯৫ শতাংশ। এ খাতে মোট লক্ষ্যমাত্রা থেকে অবশ্য এখনও ৮৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ পিছিয়ে রাজস্ব বোর্ড।
রাজস্ব আদায়ের আরেক খাত আয়কর ও ভ্রমন কর আদায়ে চলতি অর্থবছরে মোট লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ লাখ ২২ হাজার ১০০ কোটি টাকা। আগস্ট পর্যন্ত এই লক্ষ্যমাত্রা ১১ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা নির্ধারিত ছিল। আদায় হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৩ দশমিক ৮৯ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় এই খাতে আদায় কম হয়েছে ১ হাজার ৬১৬ দশমিক ১১ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের হার ৮৬ দশমিক ৫২ শতাংশ। গত অর্থবছর একই সময়ে ৮ হাজার ৭১৯ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করেছিল এনবিআর। সে হিসেবে গত অর্থবছরের তুলনায় প্রবৃদ্ধি ১৮ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ খাতে মোট লক্ষ্যমাত্রা থেকে অবশ্য এখনও ৮৯ দশমিক ১২ শতাংশ পিছিয়ে আছে এনবিআর।
গত অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছিল ১৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ। যার মধ্যে কাস্টমসের ১৫ দশমিক ৫২ শতাংশ। মূসকে ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ ও আয়করে ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই রাজস্ব আদায়ে মাসে ৩ হাজার ৩১৯ দশমিক ৪৪ কোটি টাকা ঘাটতি থাকলেও আগস্ট মাসে ঘাটতি ছিল ৫৩১ দশমিক ৬০ কোটি টাকা। আগস্টে ২৩ হাজার ৪ কোটি টাকা আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ২২ হাজার ৪৭২ দশমিক ৪০ কোটি টাকা আদায় করেছে এনবিআর। অর্থবছরের দ্বিতীয় মাসে আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে রাজস্ব আদায়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ হাজার ৪৬৮ কোটি টাকা। আদায় হয়েছে ৮ হাজার ৯৬ দশমিক ৯২ কোটি টাকা। পিছিয়ে আছে ৩৭১ দশমিক শূন্য ৮ কোটি টাকা। লক্ষ্যমাত্রার ৯৫ দশমিক ৬২ শতাংশই পূরণ করতে পেরেছে রাজস্ব বোর্ড। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৬ হাজার ৬৪৭ দশমিক ১৮ কোটি টাকা আদায় করতে পেরেছিল প্রতিষ্ঠানটি। গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবৃদ্ধিার হার ২১ দশমিক ৮১ শতাংশ।
আগস্টে স্থানীয় পর্যায়ে মূসক আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫১৯ দশমিক ৭৪ কোটি টাকা বেশি আদায় করেছে এনবিআর। যা শতাংশের হিসেবে ১০৬ দশমিক ৩৩ শতাংশ। ৮ হাজার ২১৪ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে ৮ হাজার ৭৩৩ দশমিক ৭৪ কোটি টাকায় আদায় হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে আদায় হয়েছিল ৭ হাজার ২৬৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ। প্রবৃদ্ধির হার ২০ দশমিক ১৭ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয় মাসে আয়কর ও ভ্রমন কর আদায়ে লক্ষ্যমাত্রার ৮৯ দশমিক ২৪ শতাংশ আদায়ে সক্ষম হয়েছে রাজস্ব বোর্ড। ৬ হাজার ৩২২ কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে আদায় হয়েছে ৫ হাজার ৬৪১ দশমিক ৭৪ কোটি টাকা। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৬৮০ দশমিক ২৬ কোটি টাকা কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে ৪ হাজার ৯৪৯ দশমিক ৩৭ কোটি টাকা আদায় করেছিল এনবিআর। সে হিসেবে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ খাত বিশেষ করে এনবিআরের শুল্ক-কর আদায় বাড়ানোর জন্য সরকারের উচ্চ মহল থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। রাজস্ব আদায় পরিস্থিতি নিয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম একাধিকবার সব শুল্ক-কর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার শুল্ক কর আদায় করেছে এনবিআর। লক্ষ্য অর্জনে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হবে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি প্রকল্প থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। বিশেষ করে সরকারি প্রকল্পে উৎসে কর থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব আসে। বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে প্রকল্প কমে যাওয়ার একটা প্রভাব পড়েছে সার্বিক রাজস্ব আয়ে। এছাড়া পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন ভ্যাট আদায় কমেছে, অন্যদিকে আমদানি-রফতানিতে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে। এই কারণে রাজস্ব আয়ে আমদানি-রফতানি খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। অর্থনৈতিক এমন পরিস্থিতিতে এনবিআরের পক্ষে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব। তবে একটা যৌক্তিক পর্যায়ে রাজস্ব আহরণ হবে বলেও আশাবাদ এনবিআরের কর্মকর্তাদের।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আগের তুলনায় কমে গেছে। যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে রাজস্ব আদায়ে। সেই সঙ্গে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণে পরিকল্পনার অভাব আছে বলেও মনে করেন তারা। এই বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ ইনকিলাবকে বলেন, অর্থনীতি যদি সচল না থাকে, ব্যবসা-বাণিজ্য যদি না হয়, কেনাকাটা যদি না হয়-তাহলেতো রেভিনিউ কম হবেই। সুতরাং প্রথম পয়েন্ট হচ্ছে, সরকার যতই বলুক আর এনবিআর বলুক যে আমরা চেষ্টা করছি; চেষ্টাকে কার্যকর ও ফলপ্রসূ করতে হলে অর্থনীতিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকে বাড়াতে হবে। আর আন্তর্জাতিক বাজারের কারণে জিনিসপত্র আমদানি কমে যাচ্ছে, কমাতে হচ্ছে; পলে আমদানি শুল্কও কমে যাবে। জিনিপত্রের দাম বাড়াতে মানুষজনের ক্রয়ক্ষমতা কমায় মানুষ ক্রয় করছে না এটাও একটি কারণ। এজন্য এনবিআর তার পুরোনো যেসব টাকাপয়সা পাওনা আছে, সেগুলোর দিকে যদি মনযোগ দেয়; অথবা তার খাত-ক্ষেত্র বাড়ায় তাহলে ইতিবাচক ফল আসতে পারে। কিন্তু এনবিআরতো পেরে উঠছে না।
তিনি বলেন, লক্ষ্যমাত্রাটাও একটু বেশি বেশি করে দেয়া হচ্ছে। তাদের কোন কর্মসূচী নেই। লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয় যেটা সে অর্জণ করতে পারবে। কিন্তু এনবিআর কি করতে পারবে, নাকি করতে পারবে না-সেটা নিয়ে তার কোন পরিকল্পনা নেই। পরিকল্পনা ছাড়া লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলে তা অর্জণ করাতো সম্ভব হবে না। এসব বিষয় জোর দিয়ে দেখা উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন