হজরত আদম (আ:) আমাদের আদি পিতা এবং তিনি আল্লাহর কুদরতের এক অনন্য নিদর্শন। মহান আল্লাহ তাঁর কুদরতি হাতে হজরত আদম (আ:) কে সৃষ্টি করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে দিয়েছেন আশরাফুল মাখলুকাতের মর্যাদা। ফেরেশতাদেরকে সেজদার নির্দেশ দিয়ে জিন ও ফেরেশতাদের ওপর আদম (আ:) কে শ্রেষ্ঠত্ব প্রদানের মাধ্যমে মানবজাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করেছেন। সকলে আদেশ মান্য করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের সুযোগ গ্রহণ করে কিন্তু ইবলিস আদেশ অমান্য করে অভিশপ্ত হলো। আল্লাহতায়ালা হজরত আদম (আ:) কে আল্লাহর প্রতিনিধি হিসেবে মনোনীত করেছেন এবং মানুষের হেদায়তের উদ্দেশ্যে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। আজকের প্রবন্ধে হজরত আদম (আ:) এর জীবনী আলোচনা করা হলো।
হজরত আদম (আ:) এর সৃষ্টি: হজরত আদম (আ:) কে সৃষ্টি করার জন্য ফেরেশতাদের মাধ্যমে পৃথিবী থেকে মাটি নিয়ে আসা হলো। অতঃপর আদেশ হলো যে, সে মাটিকে বর্তমান খানায়ে কাবা যেখানে অবস্থিত সেখানে রাখা হোক। ফেরেশতাদেরকে আদেশ দেয়া হলো যেন বিভিন্ন প্রকারের পানি দ্বারা সেই মাটিকে খামির করা হয়। ফলে সেই মাটির উপর চল্লিশ দিন পর্যন্ত বৃষ্টি হতে লাগলো। উনচল্লিশ দিন পর্যন্ত দুঃখ-চিন্তার বারিপাত হলো আর মাত্র একদিন আনন্দের বারিপাত হলো। এ কারণেই মানুষের জীবনে সুখের চেয়ে দুঃখ- কষ্ট বেশি। এরপর ওই খামিরকে বিভিন্ন ধরনের বাতাস দ্বারা ভালোভাবে শুকানো হলো। অতঃপর ফেরেশতাদেরকে আদেশ দেওয়া হলো যেন পরিশোধিত মাটিকে মক্কা এবং তায়েফের মধ্যবর্তী ‘ওয়াদিয়ে নু’মান’ এ আরাফাতের পাহাড়ের নিকটে রাখে। তারপর স্বয়ং আল্লাহ নিজ কুদরতি হাতে সেই মাটি থেকে হজরত আদম (আ:) এর শরীর তৈরি করে আকৃতি প্রদান করলেন। অতঃপর ‘রুহ’ কে আদেশ দেয়া হলো যেন সেই শরীরে প্রবিষ্ট হয়ে যায়। রুহ শরীরে প্রবেশ করতে চাইলে দেখল ভিতরে অন্ধকার এবং সংকীর্ণ। ফলে রুহ ভিতরে প্রবেশ করা থেকে বিরত রইলো। তখন নুরে মুহাম্মদ (সা:) দ্বারা সেই শরীর আলোকিত করা হলো। অর্থাৎ নূরে মুহাম্মদী (সা:) কে হজরত আদম (আ:) এর কপালে আমানত রাখা হলো। তখন রুহ ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলো। (তাফসীরে নাইমী, খন্ড-১, পৃষ্ঠা-২৫৩, আল্লামা ইবনে কাসীর (রহ.), ৭৭৪ হি, কাসাসুল আম্বীয়া, আরবি,খন্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৭-৩৮)
হজরত হাওয়া (আ:) এর সৃষ্টি: হজরত আদম (আ:) কে বর্তমান কাবা শরীফের অবস্থান স্থলে জুমার দিন সৃষ্টি করা হয়। এরপর তিনি পৃথিবীতে একাকী চলাফেরা করতেন আর পৃথিবীর প্রত্যেক প্রাণীকে ভিন্ন জাতি দেখে ভয় পেয়ে যেতেন এবং প্রার্থনা করতেন যদি স্বজাতি থাকতো তবে তাদের সাথে সম্পর্ক ও বন্ধুত্ব হতো। পরবর্তী জুমার দিন তিনি ঘুমাচ্ছিলেন। এ সময় ফেরেশতাগণ তার বাম পাঁজর কেটে তা থেকে মুহূর্তের মধ্যে অত্যন্ত সুশ্রী নারী হজরত হাওয়া (আ:) কে সৃষ্টি করলেন। তারপর তার কাঁটাস্থান জোড়া লাগিয়ে দেওয়া হলো। তিনি জাগ্রত হয়ে হাওয়া (আ:) কে বসাবস্থায় দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কে? উত্তর আসল, ইনি আমার বন্দিনী। তোমার ভীতি দূরীভূত করার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। আদম (আ:) তার দিকে হাত বাড়াতে চাইলে হুকুম হলো হে আদম! আগে তার মাহর আদায় করো, তারপর হাত লাগাবে। আদম (আ:) আরজ করলেন, হে আমার রব! এর মাহর কী? বলা হলো- আমার শেষ নবী মুহাম্মদ (সা:) এর উপর দশবার দুরুদ শরীফ পাঠ করো। এভাবে ফেরেশতাদের সাক্ষ্যের মাধ্যমে হজরত আদম (আ:) এর সাথে হাওয়া (আ:) এর বিবাহ সম্পন্ন হয়। ( হজরত আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ., তাফসিরে আজিজী, সূত্র: মুফতি আহমদ ইয়ার খান নঈমী, তাফসীরে নঈমী, পৃষ্ঠা-২৭৭)
হজরত আদম ও হাওয়া (আ:) জান্নাত থেকে অবতরণ: আল্লাহর নির্দেশে হজরত আদম (আ:) কে সেজদা না করে শয়তান চিরস্থায়ী অভিশপ্ত ও জাহান্নামী হয়েছে বিদায় হজরত আদম (আ:) ও বনি আদমের প্রতি তার ক্ষোভ, হিংসা ও শত্রুতা সৃষ্টি হয়। ফলে শয়তান হজরত আদম (আ:) ও বনি আদম (আ:) কে বিপদগ্রস্ত করার সুযোগ সন্ধানে লিপ্ত থাকে। শয়তান সুকৌশলে প্রথমে হাওয়া (আ:) কে নিষিদ্ধ বৃক্ষের ফল খাওয়ালেন তারপর আদম (আ:) কে খাওয়ালেন। ফলে তাঁদের শরীর থেকে জান্নাতি পোশাক চলে গেলো আর তারা বিবস্ত্র হয়ে গেলেন। লজ্জিত হয়ে ইঞ্জিন বৃক্ষের পাতা দিয়ে তাঁদের শরীর আবৃত করলেন। আওয়াজ আসল, হে আদম ও হাওয়া! আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি? তোমাদেরকে বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? তার প্রতারণায় প্রতারিত হয়ো না। তখন তাঁরা অক্ষমতা প্রকাশ করলেন আর লজ্জিত হলেন। ফেরেশতাদের প্রতি আদেশ করা হলো যেন তাদেরকে পৃথিবীতে অবতীর্ণ করা হোক। সুতরাং আদম (আ:) কে হিন্দুস্তানের চরণদ্বীপ শহরের লুদ নামক পর্বতে, হাওয়া (আ:) কে আরব সাগরের তীর জেদ্দায় অবতীর্ণ করা হয়।
হজরত আজরাইল (আ:) কে মৃত্যুদূতের দায়িত্ব: হজরত জিব্রাইল (আ:), হজরত মিকাইল (আ:), হজরত ইসরাফিল (আ:) পৃথিবী থেকে মানব সৃষ্টির জন্য মাটি আনতে অক্ষম হলে আল্লাহতাআলা হজরত আজরাইল (আ:) কে মাটি আনতে পাঠালেন। তিনি আল্লাহর আদেশ পালনে মাটির কোন কথা না শুনেই মাটি নিয়ে গেলেন। অর্থাৎ তিনি মাটি নিয়ে যেতে সক্ষম হলেন। আল্লাহতায়ালা হজরত আজরাইল (আ:) এর বুদ্ধিমত্তা, যোগ্যতা এবং কঠিন হৃদয় দেখে বললেন, হে আজরাইল! আজ তুমি মানবজাতির সৃষ্টি লগ্নে যেভাবে নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতার প্রমাণ দিলে প্রাণিকুলের ধ্বংস তথা মৃত্যুর কাজেও তুমি একইভাবে নিজের যোগ্যতা ও সক্ষমতার প্রমাণ দিতে পারবে নিশ্চয়। সুতরাং, আমি এখনই সে কাজটি তোমার জন্য নির্ধারণ করে দিলাম। সকল প্রাণীর প্রাণ তুমিই কবজ করবে।
(মাওলানা গোলাম নবী, খোলাসাতুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা-১৫-১৬, মাওলানা তাহের সুরাটী, কাসাসুল আম্বিয়া, পৃষ্ঠা-২০-২১) (চলবে)
লেখক: আরবি প্রভাষক, চরণদ্বীপ রজভীয়া ইসলামিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদরাসা, বোয়ালখালী, চট্টগ্রাম। এমফিল গবেষক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন