সুফী সাধকদের শুভাগমনের মাধ্যমে এ উপমহাদেশে পরম করুণমায় আল্লাহ্ রাব্বুল আলামিনের মনোনীত ধর্ম ‘দ্বীন ইসলাম’ এর প্রচার প্রসার ঘটেছে। আর এ মহান কর্তব্য পালনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন নায়েবে রাসুল বিশেষ করে প্রিয় নবীর পূতঃপবিত্র বংশধরগণ অর্থাৎ আওলাদে রাসূল (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম)। আমরা জানি যে, গরীবে নেওয়াজ আতা’য়ে রাসূল হযরত খাজা মঈনুদ্দিন চিশ্তি রাহমাতুল্লাহি তা‘আলা আলায়হি উপমহাদেশে প্রথম দ্বীন ইসলাম প্রচার করেন। ইতিহাস থেকে জানা যায়, আরো শতবর্ষপূর্বে ৪০০ হিজরি সনে হযরত ইমাম হুসাইন রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু’র বংশধর হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ গীসুদারাজ আওয়াল রাহমাতুল্লাহি আলায়াহি আফগানিসÍান ও পাকিসÍানের পার্বত্য সীমান্ত এলাকায় ইসলাম প্রচার শুরু করেন।
প্রিয় নবীজির ৩৮তম অধঃসÍ বংশধর উপমহাদেশের প্রখ্যাত আধ্যাত্মিক সাধক সুন্নীয়ত আন্দোলনের কান্ডারী মসলকে আ’লা হযরত এর প্রচার প্রসারের অন্যতম পথিকৃৎ গাউসে জমান কুতুবুল আউলিয়া রাহনুমায়ে শরীয়ত ও তরীক্বত হাদ্বীয়ে দ্বীন ও মিল্লাত হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সালানা ওরশ মুবারক ১১ই জিলক্বদ ১৪৪৩ হিজরি আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়ার ব্যবস্থাপনায় জামেয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হবে।
পাকিসÍানের হাজারা প্রদেশের হরিপুর জেলার (শেতালুশরীফ) ছিরিকোটি’র নবী বংশের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে ১৮৫৬ সালে আওলাদে রাসূল হযরত সৈয়্যদ মুহাম্মদ ছদর শাহ’র ঔরসে জন্ম নেন জমানার গাউস হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ, পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন আমাদের প্রাণপ্রিয় নবীয়ে পাক হযরত মুহাম্মদ মোসÍফা সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম এর বংশধর। স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কুরআনে হিফজ্ সমাপ্ত করে ভারতবর্ষের বিভিন্ন মাদ্রাসায় কুরআন-হাদিস-এর শিক্ষা গ্রহণ করেন। ১২৯৭ হিজরি মোতাবেক ১৮৮০ সালে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপনান্তে ব্যবসার উদ্দেশ্যে সুদূর দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি সেখানে অতিবাহিত করেন। এ সময় একজন সফল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন এবং দেশে তিনি ‘আফ্রিকাওয়ালা’ নামে অভিহিত হন। ড: ইব্রাহিম মাহ্দি লিখিত ‘‘অ ঝযড়ৎঃ যরংঃড়ৎু ড়ভ গঁংষরসং রহ ংড়ঁঃয অভৎরপধ’’ নামক ঐতিহাসিক গ্রন্থে দেখা যায় তিনি সফল ব্যবসায়ীই ছিলেন না, উপরন্তু, সেখানকার কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে একজন সফল ইসলাম প্রচারক ও প্রথম জামে মসজিদ নির্মাণকারী হিসেবেও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তাঁর বিদুষী সহধর্মিনী হযরত সৈয়্যদা খাতুনের অনুপ্রেরণায় ও উৎসাহে হরিপুরের বাসিন্দা তখনকার যুগের গাউসে জমান এল্মে লুদুন্নীর প্রস্রবণ হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভীর নিকট যেতে রাজি হলেন। এ মহান সাধকের সান্নিধ্য লাভের আশায় হরিপুর গমন করলেন। হরিপুর বাজারে তিনি একটি কাপড়ের দোকান খুলে ব্যবসা শুরু করেন। এক সময় হযরত চৌহরভী রাহমাতুল্লাহি আলায়হির সাক্ষাত লাভের উদ্দেশ্যে যান। পীর মুরীদ সম্পর্ক সুদৃঢ় হয়ে গেল। ফয়ুজাত পাওয়া শুরু হলো, পীরের মাদ্রাসায় কয়েক বছর পাঠদান করলেন। পীরের সোহবতে আসার অল্প দিনের মধ্যেই পীরের আদেশ হল “লঙ্গরখানার জন্য কাঠ যোগাড় করে আনতে’’। শুরু হলো সিরিকোটি হুজুরের রিয়াজতের পালা। সকলেই কানাঘুষা করতে লাগল এরকম একজন মৌলানা, ব্যবসায়ী, পন্ডিত ব্যক্তিকে হুজুর কেবলা কাঠ সংগ্রহের কাজে লাগালেন। নির্দেশদাতা ও নির্দেশ পালনকারী এর গুঢ় রহস্য বুঝতে পেরেছেন। তাই বিনা বাক্য ব্যয়ে পীরের আদেশে লঙ্গরখানার জন্য কাঠ সংগ্রহের কাজে লেগে গেলেন হুজুর সৈয়্যদ আহমদ শাহ্। দীর্ঘ সময় যাবৎ বহু দূর থেকে মাথায় কাঠের বোঝা নিয়ে লঙ্গরখানায় কাঠ সরবরাহ করেছেন এক নাগাড়ে। এভাবে কঠোর সাধনার কারণে পীরের নিকট হতে ‘তাওয়াজ্জুহ্’ লাভ করেন। পীর ছাহেব চার হাজার মাইল দূরে অবস্থিত বার্মার রাজধানী রেঙ্গুনে গিয়ে দ্বীন ইসলাম এর প্রচার করার নির্দেশ দিলেন। যে কথা সে কাজ। কোন অজুহাতে বা কোন রকম সুবিধা অসুবিধা বা পরিবার পরিজনের কথা তাঁর মনে কোন রকম দাগ কাটেনি। বিনা বাক্যব্যয়ে পুনরায় দেশান্তরিত হলেন পীরের ইচ্ছে বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে। ১৯২০ সালে তিনি রেঙ্গুন গমন করে সেখানকার বাঙালি মসজিদ নামে খ্যাত মসজিদে ইমাম ও খতিবের দায়িত্ব নেন। তাঁর আকর্ষণীয় নূরানী চেহারা শরীয়ত তরীকত হাকীকত মারেফত প্রভৃতি বিষয়ে পান্ডিত্যপূর্ণ জ্ঞান লক্ষ্য করে মুসল্লীরা ক্রমশঃ হুজুর ক্বিবলার সান্নিধ্যে আসা শুরু করলো। স্থানীয় মুসল্লীরা তাঁকে বাইয়াত করানোর জন্য পীড়াপীড়ি শুরু করে দিলে তিনি তাঁর মুর্শিদের নিকট এর একটা সমাধান চাইলেন। হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী তাঁর নিকট একটি রুমাল পাঠান। কিছুকাল পর তাঁকে খেলাফত ও ইজাজত দিয়ে বাইয়াত করানোর অনুমতি দান করা হয়। দলে দলে নবী অলি প্রেমিকরা বাইয়াত হতে থাকল। এ সময় চট্টগ্রামের বহু লোক জীবিকার সন্ধানে রেঙ্গুন তথা সমগ্র বার্মায় অবস্থান করছিল। দৈনিক আজাদী ও কোহিনূর ইলেক্ট্রিক প্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আবদুল খালেক, সুফী আবদুল গফুর, ডা. মোজাফফ্রুল ইসলাম, আবদুল মজিদ সওদাগর, মাস্টার আবদুল জলিলসহ বেশ কিছু চট্টগ্রামের লোক হুজুর ক্বিবলার হাতে বাইয়াত গ্রহণ করেন। গাউসে জমান হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি)’র একটি অলৌকিক অদ্বিতীয় ৩০ পারা দুরূদ শরীফ সম্বলিত ‘মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূল’ (সাল্লাল্লাহু আলায়হি ওয়াসাল্লাম) রচনা করেন। এই অদ্বিতীয় কিতাবখানা ছাপিয়ে প্রচার করার জন্য এবং দারুল উলুম ইসলামিয়া রহমানিয়া মাদ্রাসার উন্নতিকল্পে অর্থ সংগ্রহের নির্দেশ দিলেন। আরো বললেন, যতদিন এ কাজ সমাধা না হয় ততদিন রেঙ্গুন ত্যাগ করে কোথাও যাবে না। আপন পীরের নির্দেশ শিরোধার্য এ কথা অনুধাবন ও বিশ্বাস করতেন বলে হুজুর ক্বিবলা সৈয়্যদ আহমদ শাহ দীর্ঘ ১৬ বছর দেশে যাননি। ১৯২৫ সালে তিনি পীরের নামে ‘আন্জুমানে শুরায়ে রহমানিয়া’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। আন্জুমানের যাবতীয় কার্যাদি এর মাধ্যমেই সম্পন্ন হয়। ১৯৩৬ সালে তিনি ১৬ বছর পর স্বদেশে যান। ইতোমধ্যে হযরত খাজা আবদুর রহমান চৌহরভী (রাহমাতুল্লাহি আলায়হি) ইন্তেকাল করেন (ইন্না....রাজেউন)।
১৯৪৯ সালে হুজুর বাঁশখালী থানার শেখের খীল এলাকায় একটি মাহফিলে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে যোগদান করেন। মরহুম মৌলানা ইজহারুল হক ছাহেব ও মরহুম বজলুল করিম (দু’জনই হুজুরের খলীফা) এর ব্যবস্থাপনায় ছিলেন। ওয়াজ নসিহত শুরু করার প্রাক্কালে হুজুর ক্বিবলার সফর সাথীগণ ব্যতীত উপস্থিত জনতার কেউ দরূদ পাঠ করলেন না। এটা প্রত্যক্ষ করে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হন। ক্রোধান্বিত হয়ে সফর সংক্ষিপ্ত করে তিনি শহরে ফিরে আসেন। (চলবে)
লেখক: প্রেস এন্ড পাবলিকেশন সেক্রেটারী- আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়া ট্রাস্ট, চট্টগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন