বরকতময় রবিউল আউয়াল মাস সমাগত। এ মাসেই পৃথিবীপৃষ্ঠে শুভাগমন করেছিলেন সৃষ্টিজগতের প্রতি মহান স্রষ্টার সবচেয়ে বড় রহমত, আমাদের প্রিয় নবী সায়্যিদুনা মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ। তাই এ মাস মুমিনের জন্য পরম আনন্দের। এ মাসে আমরা হৃদয়ের সব আবেগ, অনুভূতি ঢেলে ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করি। যারা মিলাদুন্নবী উদযাপন করার বিপক্ষে, তাদের কাছ থেকে প্রত্যেক রবিউল আউয়ালে আমাদের সামনে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়। আমরা প্রশ্নগুলো একত্রিত করে কুরআন-সুন্নাহ ও ইনসাফপূর্ণ যুক্তির আলোকে জবাব দেয়ার প্রয়াস পেয়েছি। উক্ত নিবন্ধে হাদীসের সাথে মাকতাবাতুশ শামিলা অনুসারে হাদীসের নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।
ঈদে মিলাদুন্নবী কেন উদযাপন করা হয়?
ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা হয় নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা, নিয়ামতকে স্মরণ করা এবং খুশি প্রকাশ করার জন্য। আলাহ যখন তাঁর বান্দাদের প্রতি নিয়ামত দান করেন, তখন নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা বান্দার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়। কুরআন মাজিদে আল্লাহ আমাদেরকে শুকরিয়া আদায় করার তাগিদ দিয়েছেন। বলেছেন, “যে শুকরিয়া আদায় করল, সে তার নিজের (কল্যাণের) জন্যই শুকরিয়া আদায় করল। আর যে অকৃতজ্ঞ হলো (সে জেনে রাখুক) আমার রব অভাবমুক্ত, মহানুভব।” (সুরা নামল, আয়াত-৪০)
আল্লাহ কেবল শুকরিয়া আদায় করার নির্দেশ-ই দেননি, বরং এর প্রতিদান ও শুকরিয়া আদায় না করার শাস্তিও ঘোষণা করেছেন। বলেছেন, “স্মরণ করো, যখন তোমাদের রব ঘোষণা করেন, যদি তোমরা শুকরিয়া আদায় করো তাহলে আমি অবশ্যই তোমাদের জন্য আমার নিয়ামত বৃদ্ধি করে দেব। আর তোমরা যদি অকৃতজ্ঞ হও, (তবে) আমার আযাব অত্যন্ত কঠোর।” (সুরা ইবরাহীম, আয়াত-৭)
যে কোনো নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য প্রথমে ওই নিয়ামতকে স্মরণ রাখা আবশ্যক। আমাদের পূর্ববর্তী উম্মাহ বনী ইসরাইলকে আলাহ এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন, এবং আমাদেরকেও দিয়েছেন। আলাহ বলেছেন, “হে মুমিনগণ, তোমাদের প্রতি আলাহর নিয়ামতকে স্মরণ করো।” (সংক্ষেপিত, সুরা মায়িদা, আয়াত-১১; সুরা আহযাব, আয়াত-৯)
কেবল স্মরণ করাই যথেষ্ট নয়, বরং আল্লাহ আমাদেরকে নিয়ামত প্রাপ্তির জন্য আনন্দিত হওয়ার অনুপ্রেরণাও দিয়েছেন। বলেছেন, “বলুন, আলাহর করুণা ও রহমতের বদৌলতেই (কুরআন এসেছে)। অতএব এর প্রতি সবার আনন্দিত হওয়া উচিৎ।” (সুরা ইউনুস, আয়াত-৫৮)
আমাদের প্রতি আল্লাহ সবচেয়ে বড় নিয়ামত কী, সেটি স্বয়ং আল্লাহ আমাদেরকে জানিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন,
“নিশ্চয় আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অত্যন্ত করুণা করেছেন, যখন তাদের নিকট তাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল পাঠিয়েছেন।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১৬৪)
উপরোক্ত আয়াত থেকে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আমাদের জন্য আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিয়ামত হচ্ছেন আমাদের নবী। বাকি সব নিয়ামত আমরা পেয়েছি এই নিয়ামতের ওয়াসীলায়। যেহেতু আমাদেরকে নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা, নিয়ামতকে স্মরণ করা এবং খুশি প্রকাশ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাই আমরা ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করার মাধ্যমে আমাদের প্রতি আল্লাহর সবচেয়ে বড় নিয়ামতকে স্মরণ করি, খুশি প্রকাশ করি এবং নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করি।
রাসূলুল্লাহ কি তাঁর নিজের মিলাদ পালন করেছেন?
আমরা ইতোপূর্বে উল্লেখ করেছি যে, ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করা হয় আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য। আমরা দেখি, রাসূলুল্লাহ নিজের মিলাদ তথা জন্মের শুকরিয়া আদায়স্বরূপ প্রতি সোমবার রোযা রাখতেন। আবু কাতাদাহ আনসারী রা. বলেছেন, “রাসূল-কে সোমবারের রোযা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। তিনি বলেছেন, সোমবার দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি এবং এ দিনে আমার প্রতি (প্রথম) ওহী নাযিল হয়েছে।” (সংক্ষেপিত, সহীহ মুসলিম, ১১৬২)
ঈদে মিলাদুন্নবী যে পদ্ধতিতে উদযাপন করা হয়, শরীয়াতে কি এর কোনো দলিল আছে?
প্রথমত, আমরা ঈদে মিলাদুন্নবী উদযাপন করাকে শারঈ ইবাদাত মনে করি না। শারঈ ইবাদাত কেবল সেগুলোই, যা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সুস্পষ্টভাবে আমাদের জন্য আবশ্যক করেছেন এবং নিয়মকানুন শিখিয়ে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত, যদি পদ্ধতির কথা বলতে হয়, তাহলে ঈদে মি লাদুন্নবী উদযাপন করার সুন্নাহ-সমর্থিত পদ্ধতি হচ্ছে রোযা রাখা, যেহেতু রাসূল এ দিনে রোযা রেখেছেন। এছাড়া কুরআন শরীফে নিয়ামতকে স্মরণ করা এবং খুশি প্রকাশ করার নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে, যা আমরা প্রথম প্রশ্নের জবাবে উলেখ করেছি। অতএব রোযা রাখা, রাসূলুল্লাহ এর জন্মবৃত্তান্ত জীবনাদর্শ ও মানাকিব আলোচনা করার মাধ্যমে নিয়ামতকে স্মরণ করা এবং হালাল পন্থায় খুশি প্রকাশ করার দলিল রয়েছে। এবার যদি কেউ খুশি প্রকাশ করতে গিয়ে হারাম পন্থা অবলম্বন করে, তাহলে সেটি অবশ্যই বর্জনীয়। তো এটি কেবল মিলাদুন্নবীর ক্ষেত্রে নয়। বরং যে কোনো নামে, যে কোনো অনুষ্ঠান বা উদযাপন করার ক্ষেত্রে এ মূলনীতি কার্যকর হয়। উদাহরণস্বরূপ, ওয়াজ করা সুন্নাত। রাসূলুল্লাহ জীবনভর সাহাবিদেরকে ওয়াজ করেছেন। এবার কেউ যদি ওয়াজের জন্য জনসমাগম ঘটায় এবং শামিয়ানা টানিয়ে মাহফিলের আয়োজন করে, তাহলে সেটি একটি পদ্ধতিগত ইজতিহাদ হবে। যদি পদ্ধতি হালাল পন্থায় হয়, তাহলে তা মুবাহ অর্থাৎ গ্রহণযোগ্য। আর পদ্ধতির মধ্যে হারাম কিছু প্রবেশ করলে তা অবশ্যই বর্জনীয়। কেউ যদি বলেন, সাহাবায়ে কেরাম এভাবে ঘটা করে মিলাদুন্নবী পালন করেননি, তাহলে সেটি ঠিক কথা। তবে সাহাবিরা ঘটা করে সীরাত কনফারেন্স, ওয়াজ মাহফিল কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানও পালন করেননি। অথচ আমাদের সময়ে প্রত্যেক দল ও গোষ্ঠী যার যার অনুষ্ঠানগুলো অত্যন্ত আড়ম্বর সহকারে পালন করে। এটি একটি পদ্ধতিগত ইজতিহাদ ব্যতীত আর কিছুই নয়। চলবে....
লেখকঃ ইসলামি চিন্তাবিদ, অধ্যয়ণরত- (মাস্টার্স) রিলিজিয়াস স্টাডিজের অধীনস্থ ইসলামিক স্টাডিজ, এয়ারফোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানী
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন