নেতার নেতৃত্ব একটি শিল্প। একজন নেতাকে সৎ ও আত্মসচেতন হতে হবে। সৎ ও দক্ষ নেতৃত্বের গুণে কুসংস্কার ও সামাজিক অনাচারকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে সমাজ। আর নেতৃত্ব বিকাশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের। এ ছাড়া প্রয়োজন রয়েছে সাংস্কৃতিক আন্দোলনেরও। একজন যোগ্য নেতা ও তাঁর নেতৃত্বের হাত ধরে একটি নতুন সমাজ বিনির্মাণ হতে পারে। তাই সৎ, যোগ্য, সাহসী এবং সহানুভূতিশীল নেতৃত্বের জন্য নেতৃত্ব চর্চার বিকল্প নেই। নেতার নেতৃত্ব হলো বুদ্ধিমত্তা, বিশ্বাসযোগ্যতা, মানবিকতা, সাহস ও শৃঙ্খলাবোধের বিষয়। যার মধ্যে এসব গুণের সমন্বয় ঘটবে, তাঁর মধ্যে সঠিক নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে।
নেতৃত্বের কারণে অনেক অসাধ্য সাধন করা যায়, অনেক ক্ষতি থেকেও নেতৃত্বের গুণেই টিকে থাকা যায়। দেশ ও জাতির সকল উন্নয়ন নির্ভর করে নেতার কার্যক্রমকে কেন্দ্র করেই। নেতার নেতৃত্বের মাধ্যমেই দেশ ও জাতি বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ায়। এর জন্য সেই নেতাকে নীতিবান হওয়া অতি প্রয়োজন। নেতা অসৎ ও আদর্শহীন হলে জনতা অনৈতিকতা ও পাপের সাগরে নিমজ্জিত হয়ে যাবে। ফলে গজব-মহামারী দেশ ও জাতির জন্য অবশ্যম্ভাবী হয়ে যাবে। কারণ গজব-মহামারী তো অসৎ নেতৃত্বেরই ফল। নেতা-নেত্রী তথা ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির কারণেই আল্লাহর গজব আসে। সঠিক নেতৃত্ব ছাড়া কোনো জাতি, দেশ, কোনো সংগঠন চলতে পারে না। জাতির উত্থান-পতন অনেকাংশে নির্ভর করে নেতৃত্বের ওপর।
সমাজের উন্নয়নের জন্য সামাজিক নেতৃত্ব প্রয়োজন। সমাজে যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ ও ইভ টিজিংয়ের মতো অনেক সমস্যা রয়ে গেছে। এসবের বিরুদ্ধে তরুণ প্রজন্মকে কাজ করতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে নেতৃত্বে নিয়ে আসতে হবে। তরুণ সমাজ ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে, তারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের নেতৃত্বে আমরা গণতন্ত্র পেয়েছি। নেতৃত্বের অনেক গুণের মধ্যে প্রথমেই নিজের মধ্যে রাষ্ট্র ও মানুষের কল্যাণে কাজ করার তাগিদ থাকতে হবে। নেতাকে সমাজের উপকারে উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। প্রত্যেক সংগঠনে অবশ্যই একজন নেতা থাকবেন। তাঁকে অন্যদের প্রেরণা দিতে হবে। তাঁর এমন কাজ করা উচিত, যাতে সমাজের ১০ জন মানুষ তাঁকে অনুসরণ করবে। আর একজন নেতার অন্যকে উৎসাহী করার ক্ষমতা থাকতে হবে। যদিও আমাদের এখানে নেতা আছেন; কিন্তু উৎসাহ দেওয়ার মতো মন-মানসিকতা নেই। সমাজে যিনি নেতৃত্ব দেবেন, তাঁর প্রভাবিত করার ক্ষমতা থাকতে হবে। তাঁকে বুদ্ধিমান, আত্মবিশ্বাসী, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সর্বোপরি সামাজিক নেতা হতে হবে। তাঁর মধ্যে যদি যোগাযোগ দক্ষতা না থাকে তাহলে তাঁর কাজ অপ্রকাশিত থেকে যাবে। তাই দেশ ও জাতির অস্তিত্ব রক্ষার্থে সৎ নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম।
সৎ নেতৃত্ব সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে লক্ষ্য অর্জনের একটি মহান পন্থা। কোন দেশ ও জাতিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে এটা বিশেষ ভূমিকা পালন করে। গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জন ও বাস্তবায়নের জন্যে সৎ নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন ব্যবস্থা যৌথ কর্মপ্রচেষ্টার ফসল। কিন্তু কোন যৌথ প্রচেষ্টাকে সার্থক করতে হলে সৎ নেতৃত্বের অতিব প্রয়োজন। সৎ নেতৃত্ব সফলতার চাবিকাঠি। সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বের গুণে একটি জাতি উচ্চ শিখরে আরোহণ করতে পারে। আবার অসৎ ও অযোগ্য নেতৃত্বের কারণে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনে নেমে আসে সীমাহীন অভিশাপ। সমাজ ও রাজনৈতিক জীবনের প্রতিটি স্তর যেমন- পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, কলকারখানা, অফিস- আদালত, খেলার মাঠ সর্বত্রই সৎ নেতৃত্বের অবদান অনস্বীকার্য। বিভিন্ন সমস্যা ও সংকটে জর্জরিত সমাজ ও রাষ্ট্রে সুযোগ্য নেতৃত্ব প্রয়োজন। কেননা সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বই জাতিকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে দেয়। সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানগুলো নেতৃত্বের গুণেই সুনিয়ন্ত্রিত ও সুচারুভাবে পরিচালিত হয়। পরিবর্তনশীল সমাজকে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্বই প্রগতির পথে এগিয়ে নিতে পারে। নেতৃত্বের গুণেই একটি সংগঠন, প্রতিষ্ঠান ও দেশ বা জাতি উত্তরোত্তর উন্নতির চূড়ায় পৌঁছে যেতে পারে। সুতরাং সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সৎ নেতৃত্বের ভূমিকা অনন্য। সৎ নেতৃত্ববিহীন জাতি অকূল সাগরে নাবিকবিহীন জাহাজের মতো।
সমাজ বিনির্মাণ ও পরিবর্তনের প্রথম শর্ত সঠিক নেতৃত্ব। দেশ, জাতি ও রাষ্ট্রীয় নৈতিক অধঃপতনের মূল কারণ হচ্ছে অসৎ ও অযোগ্য নেতৃত্ব। অসৎ নেতৃত্বের কারণে দেশ ও জাতি তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে। সঠিক নেতৃত্ব না থাকলে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় থাকে না। নেতৃত্বের অভাবে হানাহানি, মারামারি, সহিংসতা দেখা দেয়। এসবই অসৎ নেতৃত্বের কুফল। অত্যন্ত দুঃখজনক বাস্তব ঘটনা এই যে, সমাজে সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হোক- এটা আমরা কেউই চাই না। দলীয় স্বার্থে সব ধরনের দোষে দুষ্ট ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচন করতেও আমরা কুন্ঠাবোধ করি না। আর এটা আমরা করে থাকি জেনে শুনে স্বজ্ঞানে সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায়। প্রশ্ন হল- আমরা জেনেশুনে স্বজ্ঞানে ঠান্ডা মাথায় অসৎ ও অযোগ্য ব্যক্তিকে নেতা নির্বাচনের পর এদের মাধ্যমে দেশ ও জাতির সুনাম আশা করি কোন বিবেকে? মোট কথা, নেতা নির্বাচনে আমরা সব সময়ই ভুল করে থাকি। আর এই ভুলের মাশুল দেই আমরা পদে পদে। এই অসৎ নেতৃত্বের মাশুল দেব আর কতকাল? বাস্তবতা হচ্ছে, আমাদের দেশে প্রায় সব ক্ষেত্রে অভাব রয়েছে যোগ্য ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দক্ষ নেতৃত্বের।
সৎ ও যোগ্য নেতা নির্বাচনে ধার্মিকতাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। কারণ যিনি ধার্মিক তিনিই সৎ, মহৎ ও সৎ চরিত্রবান হয়ে থাকেন। প্রকৃত ধার্মিক কখনও অন্যায় অপকর্মে লিপ্ত হতে পারে না, অন্যায় অপকর্মে সহযোগিতা করতে পারে না। ধার্মিক ও চরিত্রবান মানুষই দেশ ও জাতির সম্পদ। ছাত্রজীবন থেকেই নেতৃত্বের চর্চা করা দরকার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন এবং লিডারশিপ ট্রেনিংগুলোতে যোগদানের মাধ্যমে আমরা নেতৃত্বের চর্চা করতে পারি। দেশ ও জাতির উন্নয়নে অবদান রাখতে চাইলে নেতৃত্ব চর্চার বিকল্প নেই। সৎ, যোগ্য, দক্ষ নেতৃত্ব না থাকলে এবং এ রকম নেতা উঠে না এলে, সন্তান ও সম্পদ কোনোটিই রক্ষা করা যাবে না। সামাজিক নেতৃত্ব বিকাশের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। তাই সৎ ও যোগ্য লোকদেরকে নেতা নির্বাচন করা আমাদের সকলের উচিত।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও মুদ্রণ ব্যবস্থাপক দৈনিক সিলেটের ডাক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন