তাফাক্কুর আরবি শব্দ। এ শব্দের বাংলা শাব্দিক অর্থ হলো চিন্তাশীলতা, চিন্তাভাবনা, বিবেচনা, গবেষণা ইত্যাদী। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষকে সৃষ্টিরাজির মধ্যে বিবেচনা, চিন্তাশীলতা ও গবেষণার মতো শ্রেষ্ঠ গুণের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। চিন্তাশীলতা, সৃজনশীলতা, সৃষ্টিশীলতা মানবজাতিকে সকল প্রাণির চাইতে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে সমাসীন করেছে। মানুষের বাকশক্তির সঠিক প্রয়োগ, চিত্তাকর্ষক কল্যাণমুখি বক্তব্য, বুদ্ধিভিত্তিক আলোচনা, কার্যকর গবেষণার পেছনেই চিন্তাশীলতাই মূখ্য। চিন্তাবিদগণের চিন্তা অমুল্য সম্পদ। তাঁরা তাঁদের চিন্তার সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে গবেষণা পূর্বক জাতির কল্যাণে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন।
চিন্তাশীলতা ও প্রাজ্ঞজন বাস্তবতার নিরিখে তাঁদের গবেষণালব্দ জ্ঞানের মাধ্যমে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র এর প্রভূত কল্যাণ সাধন করেন। ইহলৌকিক জীবনে ব্যক্তির উন্নতি, সামাজিক কল্যাণ ও রাষ্ট্রের সমৃদ্ধি, এ সকল কিছুর পেছনে চিন্তাশীলতার বিশাল ভূমিকা রয়েছে। মানুষের স্বভাবজাত অভ্যাস হলো যে কোন বিষয়ে ধারণা পোষণ করা। কেউ সুধারণা করে আবার কেউ কুধারণা করে। ধারণার উপর ভিত্তি করে মানুষ চিন্তা করে। স্বাভাবিক চিন্তা দুধরণের, একটি সুচিন্তা অপরটি হলো কুচিন্তা। সুচিন্তা কল্যাণকর আর কুচিন্তা ক্ষতিকর। সুচিন্তা ইবাদাতও বটে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, ‘সুধারণা সুন্দর ইবাদতের অংশ’। (সুনানে আবি দাউদ: হাদিস: ৪৯৯৩)।
চিন্তা ও চিন্তাশীলতা বিষয়ে কোরআন সুন্নাহ ও মনীষীগণের বক্তব্যঃ চিন্তা ও চিন্তাশীলতা বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, ‘যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শুয়ে আল্লাহ্র স্মরণ করে এবং আসমানসমূহ ও যমীনের সৃষ্টি সম্বন্ধে চিন্তা করে, আর বলে, ‘হে আমাদের রব! আপনি এগুলো অনর্থক সৃষ্টি করেননি। আপনি অত্যন্ত পবিত্র, অতএব আপনি আমাদেরকে আগুনের শাস্তি হতে রক্ষা করুন।’ (সুরা আলে ইমরান: আয়াত: ১৯১)। তিনি আরো বলেন, আর আপনার প্রতি আমরা কুরআন নাযিল করেছি, যাতে আপনি মানুষকে যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে তা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেন এবং যাতে তারা চিন্তা করে। (সুরা আন নাহল: আয়াত: ৪৪)। তিনি আরো বলেন, তারা কি নিজেদের অন্তরে চিন্তা করে (ভেবে) দেখে না? আল্লাহ্ আসমানসমূহ, যমীন ও এতদুভয়ের মধ্যবর্তী সবকিছু সৃষ্টি করেছেন যথাযথভাবে এবং এক নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। কিন্তু মানুষের মধ্যে অনেকেই তো তাদের রবের সাক্ষাতের ব্যাপারে কাফির। (সুরা আর রূম: আয়াত: ০৮)।
চিন্তাশীলতার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে হাদিসে এসেছে, আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, এক রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেন, ‘হে আয়েশা, আমাকে আমার রবের ইবাদাত করতে দাও’। আমি বললাম, হে রাসূল, আমি আপনার পাশে থাকতে ভালবাসি এবং যা আপনাকে খুশি করে তা করতে ভালবাসি। তারপর আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বললেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম ওযু করলেন এবং সালাত আদায়ে নিবিষ্ট হলেন ও কাঁদতে থাকলেন। আমি বললাম, হে আল্লাহ্র রাসূল, আপনি কাঁদছেন অথচ আল্লাহ আপনার পূর্বাপর সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন? উত্তরে তিনি বললেনঃ আমি কি কৃতজ্ঞ বান্দা হব না? এ রাতে আমার উপর একটি আয়াত নাযিল হয়েছে,“যে ব্যক্তি তা তেলাওয়াত করল এবং চিন্তা-গবেষণা করল না, তার ধ্বংস অনিবার্য।” তারপর তিনি এ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন। (সহীহ ইবনে হিব্বান: হাদিস: ৬২০)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো ইরশাদ করেন, তোমরা আল্লাহর নেয়ামতরাজি সম্পর্কে চিন্তা করো, আর আল্লাহর ব্যাপারে চিন্তা করো, অর্থ্যাৎ আল্লাহর বিধান মানার বিষয়ে ভাবো। (সুনানে বায়হাকি)।
প্রখ্যাত সাহাবি আবু দারদা (রাঃ) বলেন, একঘন্টার চিন্তা সাররাতের ইবাদাতের চেয়েও উত্তম। ফুযাইল (রহ:) বলেন, ফিকর তথা চিন্তাশীলতা অনেকটা আয়নার মতো, চিন্তা তোমাকে কোনটি ভালো কোনটি মন্দ তা দেখাবে। ইবরাহিম আন নাখয়ি বলেন, ‘আল ফিকর মুখখুল আকল’ তথা চিন্তাশীলতা আকল তথা বিবেক বিবেচনার মুল। আবু সুলাইমান বলেন, তোমরা কান্নার মাধ্যমে চোখের পরিচর্যা করো আর চিন্তার মাধ্যমে আত্মার পরিচর্যা করো। বিশর আল হাফি (রহ:) বলেন, মানুষ যদি আল্লাহর আযমত তথা বড়ত্ব সম্পর্কে চিন্তা ভাবনা করতো তাহলে সে কখনো অবাধ্য হতো না।
সুচিন্তার সুফলঃ সুচিন্তা মানবজীবনে প্রভূত কল্যাণ বয়ে আনে। চিন্তশীলতার সুফল অত্যধিক। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সুফল হলো: ১. এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদাত, এর সাওয়াবের পরিসর অনেক বড়। ২. চিন্তাশীলতার মাধ্যমে মানুষর মহান প্রভূ সম্পর্কে নির্ভেজাল ও বিশুদ্ধ ধারণা পায়। ৩. মানুষ নিজের প্রকৃত পরিচয় পায়, শ্রেষ্ঠসৃষ্টি হিসেবে নিজের করণীয় সম্পর্কে সচেতন হয়। ৪. চিন্তাশীলতার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য ও সন্তুষ্টি লাভ করে। ৫. চিন্তাশীলতা মানুষকে ইহলৌকিক জীবনে সমৃদ্ধি ও কল্যাণের পথে পরিচালিত করে। ৬. সামষ্টিক চিন্তাশীলতা জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য মাইলফলক। ৭. চিন্তাশীলতা ব্যক্তিকে গবেষণার প্রতি উদ্বুদ্ধ করে। ৮. সুচিন্তা ব্যক্তিকে উদার ও পরোপকারী হতে সাহায্য করে। ৯. সুচিন্তা মানুষকে যাবতীয় অপরাধ ও পাপাচার থেকে সুরক্ষা দেয়। ১০. সুচিন্তা ব্যক্তিকে পরমপ্রিয় ও জনপ্রিয় করে তোলে।
পরিশেষে, মহান আল্লাহপাক আমাদের সকলকে সুচিন্তা ও সুন্দর মননের অভ্যাস গড়ে তুলে উভয়জাহানের কল্যাণ লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
লেখকঃ মোঃ আবদুল গনী শিব্বীর, মুহাদ্দিস, নোয়াখালী কারামাতিয়া কামিল মাদরাসা, সোনাপুর, সদর, নোয়াখালী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন