পূর্ব প্রকাশিতের পর
মূলতঃ দরূদ শরীফ পাঠ ভালবাসার বিষয়। প্রেম-ভালবাসা রূহানী ও পবিত্র। আর সুন্দরকে কেনা ভালবাসে। সে ভালবাসার সূত্রপাত-আল্লাহ (আহাদ) কর্তৃক আহমদ বা মোহাম্মদ (সাঃ) কে। আর আহ্মদ বা মোহাম্মদ (সাঃ) কর্তৃক আহাদ বা পরমাত্মা প্রভু আল্লাহকে।
এ আধ্যাত্মিক প্রেম উর্দ্ধালোকে সমগ্র সৃষ্টিতে ছড়িয়ে পড়লো। আল্লাহর ইচ্ছায় তা নেমে এলো মর্তলোকে আদমএর মাধ্যমে। কাম আর নিষ্কাম বা রূহানী ভাবে। শুরু হলো নফস্ আর পবিত্র আত্মার রূহানী যুদ্ধ। তাই, আদম (আঃ) কেবলা হয়েছিল পৃথিবী থেকে পবিত্র হয়ে আত্মার মুক্তির ব্যবস্থা করে আসতে। তাই সাধকদের সাধনা এটাই। তাদের ভালবাসা রূহানী বা নিস্কাম। মূলে আল্লাহ ও রাসূল প্রেম। দরূদ শরীফ হ’ল এর গলার মালা, আর হৃদয়ে প্রেমের জ্বালা। আল্লাহ ও এর বাইরে নন কারণ তিনিই তো এর সূচনাকারি। সালাত (নামাজ এর পর অর্থাৎ আল্লাহকে প্রভু বলে মেনে নিয়ে সেজদা ও তাঁর প্রশংসার পর এটাই বড় এবাদত। প্রেম কত জটিল, এ নামাজ ও পরিপূর্ণ হবে না দরূদ তথা রাসূল প্রেম ছাড়া।
বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের (রঃ) তার বই ‘গুনিয়াতু ত-তালে-বীনে-উল্লেখ করেছেন, উম্মত কর্তৃক প্রিয় নবী (সাঃ) এর উপর দরূদ-সালাম পাঠ করার অর্থ হচ্ছে-নবীর শাফায়াত তলব করা। গাউস পাক আরো বলেন; দরূদ শরীফের তাৎপর্য হচ্ছে-নবীর আনুগত্য করা ও নবীর প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা প্রদর্শনা করা। বলেছেন; “দরূদ শরীফ পাঠের জন্য আমি ‘গাওছুল আযম’ হয়েছি।” আরও বলেছেন ঃ “কবরে আমার দেহ যখন ধুলিকনায় পরিণত হবে; তুমি সেই প্রত্যেকটি ধুলি কনা থেকে দরূদ শুনতে পাবে।”
বারো শরীফ দরবার কোর্টপাড়া; কুষ্টিয়ায় প্রতি সোমবার সাপ্তাহিক মিলাদ মাহ্ফিলের দিনে বারো শরীফের মহান ইমাম হযরত শাহ্ সূফী মীর মাস্উদ হেলাল (রঃ) দরূদ ও সালাম আরম্ভ করার পূর্বে বলতেন, “খুব শান্তির সাথে লয় ঠিক রেখে আমরা মাহ্ফির করবো। লয় ঠিক না থাকলে প্রেম আসে না। আল্লাহর রহমত ও আসে না। আল্লাহর রহমত পেতে হলে ভক্তি ও প্রেমের সাথে দরূদ ও সালাম পাঠ করতে হবে। মনে করতে হবে মদীনা শরীফে বসে মদীনাকে খেয়াল করে নিবিষ্ট মনে পড়তে হবে। জিকির করার সময় বলতেন আস্তে আস্তে ওঠবে, ফট করে উঠে ফট করে নেমে না যায়। এতে জিকির হয় না। সালাম এর সময় বলতেন, সুন্দর করে ভক্তি সহকারে দিতে।”
ইমাম (রঃ)বলেছিলেন, হযরত ইউনুস নবী যখন মাছের পেট হতে উদ্ধার পাচ্ছিলেন না; তখন বিপদ মুক্তির জন্য পড়েছিলেন-“লা-ইলাহা-ইল্লা-আনতা-সুবহানাকা-ইন্নি-কুনতু-মিনায যালেমীন।” কিন্তু এতে ও কাজ হচ্ছিল না। তখন তিনি পড়লেন-লা-ইলাহা-ইল্লা-আনতা-সুবহানাকা-ইন্নি-কুন্তু- মিনায-যালেমীন ওয়াশিলাতু-মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ-সাল্লাল্লাহু আলাই হে ওয়াসাল্লাম।” অর্থাৎ তিনি মোহাম্মদ (সাঃ) এর পবিত্র নাম নিয়ে দরূদ ও সালাম পাঠ করেছিলেন। দোহাই দিয়েছিলেন। এর পরপরই তিনি মাছের পেট হতে উদ্ধার পান।
নামাজ ও অন্যান্য ফরয এবাদত গুলো সৃষ্টি হয়েছে আল্লাহর প্রতি বান্দার প্রেম ও অনুগত্য হতে। আর দরূদ শরীফ আল্লাহর হাবীব (দঃ) এর প্রতি আল্লাহর প্রেম এর উপর। নামাজ বান্দার উপর একটা ফরয এবাদত। আর দরূদ শরীফ এমন একটা জরুরী আমল বা এবাদত যা স্বয়ং আল্লাহ্ তায়ালা ও তার ফেরেশ্তারা আমল করেন যা আমাদের নবী-ও রাসূল শাফায়েতকারী মহান দরদী বন্ধু হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) এর নিজস্ব বিষয়। নামাজ, রোজা, হজ্ব, যাকাত এর সূচনা এ দুনিয়াতে মানুষ আসার পর। আর দরূদ শরীফের সূচনা সে এক অজানা জগতে অজানা সময়ে আহাদ আল্লাহ কর্তৃক আহ্মদের প্রেমে। যখন কোন কিছুই সৃষ্টি হয় নাই।
এ দুনিয়া রোজ কেয়ামতে ধ্বংস প্রাপ্ত হবার পর শরীয়তি এ সব এবাদত বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু আল্লাহর হাবীবের প্রতি আল্লাহর দরূদ পাঠ চলতে থাকবে। নবী প্রেমিক জান্নাতবাসী বান্দাদেরকে ও আল্লাহ এতে শরীক হবার সৌভাগ্য দিবেন কিনা আল্লাহ জানেন। আল্লাহ বলেছেন ঃ “আমার সম্মান ও মর্যাদার শপথ! আমি নিশ্চয়ই আমার হাবীবকে, আমার খলীল (ইব্রাহীম) ও আমার নাজীর (মূসা) এর উপর অগ্রাধিকার দান করবো।” (দ্রঃ হাকিম; তিরমিযী, তিবরানী; দায়লামী)
আমরা কি পারছি-আল্লাহর হাবীব কে সর্ব কিছুর উপরে স্থান দিতে। আল্লামা তকী উছ্মানী তাই বলেছেন ঃ প্রেমিক প্রেমের গভীরতার জ্ঞানে যা বলতে সাহস দেখায় এক আলেম তা পারেন না-নবী প্রেমিক ইমাম মালেক এর মতে ঃ মাস্জিদে হারামের চেয়ে মসজিদে নব্বীতে নামাজ পড়া উত্তম।” (দ্রঃ দরসে-তিরমিযীÑ২/১১১)
মদীনার ইমাম এবং হাদীস তত্ত্ববিদদের মাথার তাজ হযরত মালেক ইবনে আনাস সমগ্র জীবন মদীনা শরীফে কাটান। তার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল মদীনা শরীফের পাক মাটিতে মৃত্যুবরণ করা। এজন্য তিনি পারত পক্ষে কখনও মদীনার বাইরে কোথাও যেতেন না। একই কারণে তিনি জীবনে একবার মাত্র হজ্ব করেন। (দ্রঃ রওজা শরীফের ইতিকথা মুহিউদ্দীন খান)
আল্লামাশামী (রাঃ) মোল্লাজামী সম্পর্কে লিখেছেন যে; “তিনি একবার শুধুমাত্র রওজা শরীফ জিয়ারত করার জন্য মদীনা শরীফ যান। হজ্ব বা অন্য কোন নিয়ত তার সাথে ছিল না।” (দ্রঃ ফাযায়েলে হজ্ব; রওজা শরীফের ইতি কথা) প্রেমিক বারো শরীফের ইমাম হযরত শাহ সূফী মীর মাসউদ হেলাল (রঃ) একবার শুধু রাসূল (সাঃ) কে দেখা করতে যাবার জন্য পাসপোর্ট করেছিলেন।
ইমাম বুসাইরী তার ক্বাসিদাতে বলেন ঃ “হে মহানবী (সাঃ)! যিনি সৃষ্টিতে সবচেয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ ও সবচেয়ে বেশী দয়াবান। আমার নিঃশ্বাসের শেষ মুহুর্তে আপনি ছাড়া কে আছে যার মাঝে আমি আশ্রয় নিতে পারি।” জ্ঞান পেয়ে তারীখে মদীনা মুনাওয়ারা” কিতাবের সঙকলক মাওলানা আব্দুল মা’বুদ লেখেন ঃ “দুনিয়াতে এমন কে আছে, যে হাশরের সেই ভয়াবহ ময়দানে রাসূলে মক্বুলের (সাঃ) একটু খানি কৃপা দৃষ্টির মুখাপেক্ষী হবে না।”
বায়হাকী শরীফে হযরত ওমর (রাঃ) কর্তৃক একটা হাদীসে আছে রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেছেন ঃ আদম (আঃ) আল্লাহর হুকুমের বিপরীত কাজ করার পর একদা তিনি এভাবে দোয়া করলেন ঃ “হে পরওয়ারদেগার! মোহাম্মদের ওছিলা দিয়ে আপনার নিকট মোনাজাত করছি, আপনি অবশ্যই আমাকে ক্ষমা করবেন।
তখন আল্লাহতায়ালা জিজ্ঞাসা করলে হে আদম! তুমি, মোহাম্মদকে চিনলে কিভাবে? আমি তো এখনো তাকে প্রকাশ করিনি। আদম বললেন, হে পরওয়ারদেগার! আপনি যখন আমাকে আপনার বিশেষ কুদরতে সৃষ্টি করে আপনার সৃষ্ট রূহ ফুকেন তখনই আমি মাথা ওঠানোর সাথে সাথে দেখতে পেলাম যে, আপনার আরস আজিমের গায়ে লিখা আছে - “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ।” আমি তখনই চিন্তা করলাম যে, আপনার প্রেমের সৃষ্টি না হলে আপনার নামের সাথে এ নাম যুক্ত হতো না। মহান আল্লাহ বলেন, “হে আদম! তোমার ধারনা সত্য। নিশ্চয়ই মোহাম্মদ আমার সর্বাধিক প্রিয় সৃষ্টি। তুমি তার ওছিলা ধরেছ। অতএব আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম। মোহাম্মদ না হলে তোমাকেও সৃষ্টি করতাম না।” (যুরকানী)
রাসূলকে ভালবাসা আমাদের অবশ্য কর্তব্য। আল্লাহ বলেন, “হে আমার বান্দা! তোমরা আমার প্রিয় হাবীব কে প্রাণ দিয়ে ভালবাসো। উপযুক্ত সম্মান দেখাও এবং হুশিয়ার তার সাথে বিন্দুমাত্র বেয়াদবী করো না। কেননা; এতে তোমাদের সমুদয় আমল বরবাদ হয়ে যাবে। অথচ তোমরা তা উপলব্ধি করতে পারবে না।”
একদা হযরত ওমর (রাঃ) বলেন ঃ হে আল্লাহর রাসূল! আমার জীবন ব্যতীত সকল কিছু অপেক্ষা আপনি আমার কাছে প্রিয়। রাসূল (সাঃ) বলেন, না। সে সত্তার কসম যাঁর হাতে আমার জীবন, যতক্ষণ না আমি, তোমার জীবন থেকেও প্রিয় হব, ততক্ষণ তুমি পূর্ণ-মুমিন হতে পারবে না। ওমর (রাঃ) একটু চিন্তা করে বলেন, নিশ্চয় এখন আপনি আমার জীবন থেকেও অধিক প্রিয়। রাসূল বলেন, এখন হয়েছে হে ওমর।” (সহীহ বুখারী)
লেখক : গবেষক, ইসলামী চিন্তাবিদ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন