শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

পরকীয়ার প্রতিকারে ইসলামের দিকনির্দেশনা

মুফতি সাদেকুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২৭ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

পরকীয়া হলো ব্যাক্তির চারিত্রিক ও নৈতিক অবক্ষয়। কিন্তু বর্তমানে তা এক সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এক মারাত্মক মহামারী আকার ধারণ করেছে। প্রযুক্তির কল্যাণে শহর- নগর, গ্রাম -গঞ্জ সব জায়গায় একই চিত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে।আর এই পরকীয়ার বিষাক্ত ছোবলে একটি সুন্দর সংসার তছনছ হয়ে যাচ্ছে নিমিষেই, এর ফলাফল, কোন সন্তান হারায় তার প্রিয় মা/বাবাকে, কোন স্বামী হারায় তার স্ত্রীকে এবং কোন মা হারায় তার সন্তানকে নিয়ে স্বপ্ন দেখা একটি পরিবার। পরকীয়া থেকে মুক্তির উপায় খুঁজছে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, গুণীজন এবং গোটা রাষ্ট্র। কিন্তু কোনভাবেই তা দমানো যাচ্ছে না। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন,এখনই যদি এর লাগাম টেনে না ধরা যায় তবে মুসলিম সমাজ ভেঙ্গে খানখান হয়ে যাবে। মুসলিম সমাজ হারাবে তার ইতিহাস- ঐতিহ্য, সভ্যতা- সংস্কৃতি। পশ্চিমার আদলে এক নতুন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। আর তখন অবস্থা কতটা ভয়াবহ হবে তা যে কোন সচেতন ব্যক্তি পশ্চিমাদের দিকে তাকালেই বুঝতে পারে।

পরকীয়া বলতে কি বুঝায়?
পরকীয়া প্রেম হচ্ছে, বিবাহিত জীবন থাকা স্বত্ত্বেও অন্য কোনো নারী বা পুরুষের সঙ্গে বিবাহবহির্ভূত প্রেম করা অর্থাৎ সরাসরি সাক্ষাতে অথবা মোবাইল- ফোনে অডিও- ভিডিওতে কথা বলা, মেসেঞ্জার,হোয়াটসঅ্যাপ,টেলিগ্রাম টুইটার ইত্যাদিতে চ্যাটিং করা, মেসেজ আদান - প্রদান করা ,যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা অর্থাৎ একে অপরের দেহ টাচ করা,আলিঙ্গন করা, চুমু দেওয়া ও যৌন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়া অর্থাৎ অবৈধ সঙ্গম করা।

পরকীয়ার কারণ:
বিভিন্ন কারণে পরকীয়া সম্পর্ক হতে পারে তবে আমরা মোটাদাগে পাঁচটি কারণ কে চিহ্নিত করতে পারি।
১। শারীরিক কারণ: অনেক স্বামী বা স্ত্রীর যৌন সমস্যা থাকে, যার কারণে অপূর্ণ যৌন চাহিদা মেটানোর তাগিদ থেকে তারা পরকীয়ায় জড়ায়।

কোন কোন স্বামী বা স্ত্রীর যৌন চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশী থাকে যা অনেক সময়৪ তার সঙ্গী মেটাতে পারেনা। ফলে তারা পরকীয়ায় জড়ায়।

অনেক সময় বিয়ের অল্পদিন পরেই স্বামী বিদেশে চলে যায় অথবা চাকরী বা পেশা, বা অন্যকোন কারণে দীর্ঘ দিন স্বামী- স্ত্রী আলাদা বসবাস করার ফলে অপূর্ণ শারীরিক চাহিদা থেকে তারা পরকীয়ায় জড়ায়।

২।মানসিক কারণঃ মানসিক সমস্যার কারণেও মানুষ বাড়তি সম্পর্কে জড়ায়। বাইপোলার মুড ডিজর্ডার রোগে আক্রান্ত রোগীরা কোনকিছুর মধ্যে স্থিরতা খুঁজে পায়না। এরোগে আক্রান্ত স্বামী বা স্ত্রীরা সহজেই একাধিক প্রেমে জড়ায়।

আমাদের দেশের অধিকাংশ ছেলেমেয়েদের কাছে মনের সৌন্দর্যের চেয়ে শারাীরিক সৌন্দর্য বেশী প্রিয়। তাই স্বামী বা স্ত্রী অসুন্দর বা মনের মত না হলে তারা তেমন কারো সাথে পরকীয়ায় জড়ায়। কেউ স্লিম বৌ পছন্দ করে। বাচ্চা হবার পর মেয়েরা মুটিয়ে গেলে তা অনেক স্বামীর ভাল না লাগার কারণে তারা পরকীয়ায় জড়ায়।

অবাধ মেলামেশার কারণে পরকীয়া সম্পর্ক হয়।যেমন দেবর- ভাবি, চাচাতো,মামাতো,ফুফাতো ও খালাতো ভাই-বোন পরস্পর অবাধে সাক্ষাৎ করে, কথাবার্তা বলে ফলে একে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যায়। বিবাহিত নারী পুরুষদের সামাজিক লোকনিন্দার ভয় কম থাকে, তারা কারো সাথে মিশলে লোকে সহজে সেটাকে খারাপ বা সন্দেহের চোখে দেখেনা । এ সুযোগে তারা পরকীয়ায় জড়িয়ে যায়।

স্বামী -স্ত্রীর সম্পর্ক টা এমন, যে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই উভয় উভয়ের সম্পর্কে প্রায় সবকিছুই জেনে যায়। ফলে তাদের সম্পর্কের উষ্ণতা, আকর্ষণ কমে যায় বা থাকেনা। তখন দাম্পত্য জীবন দ্বায়িত্ব নির্ভর, একঘেঁয়ে হয়ে যায়। কেউ কেউ দাম্পত্য জীবনের এই একঘেঁয়েমী কাটাতে পরকীয়ায় জড়ায় বা পতিতাদের সাথে যৌন সম্পর্ক করে।

সাংসারিক বা পেশাগত ব্যস্ততার কারণে স্বামী বা স্ত্রীরা মনে করেন যে, তার সঙ্গী তার বিষয়ে উদাসীন, আগের মত প্রশংসা করেনা, তার কোনকিছুতে আর মুগ্ধ হয়না, আগের মত ভালবাসেনা, আদর করেনা, যত্ন নেয়না,.. ইত্যাদি। এই শূন্যতার সুযোগে অন্য কেউ তাদের প্রতি মনোযোগ দিলে তারাও তার প্রতি আকর্ষিত হয়ে পরকীয়ায় জড়ায়।

অনেক পুরুষ পরকীয়াকে অন্যায় মনে করেনা। তাই তারা স্ত্রীকে তার জায়গায় রেখে অন্য কারো সাথে সখের বসে সম্পর্ক করে।

আবার কোন কোন পুরুষ একইসাথে একাধিক প্রেম, রেপ বা পরকীয়া করতে পারাকে ‹যোগ্যতা› মনে করে। কৌতুহল মেটাতে, বিয়ে না করেই যৌনসুখ লাভ বা নিজের স্বক্ষমতা যাচাই করার জন্য ও অনেক ছেলে পরকীয়া করে বা বিবাহিতা মেয়েদের সাথে সম্পর্কে জড়ায়। অনেক পুরুষ ডিভোর্সের পর পুনরায় বিয়ে না করে দৈহিক-মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্য পরকীয়া করে।

দাম্পত্য জীবনের নানা দ্বন্দ্ব, সমস্যা, মতের অমিল, কষ্ট ইত্যাদি কারো সাথে শেয়ার করতে গিয়ে একসময় তার প্রতি নির্ভরতা থেকে অনেকে পরকীয়ায় জড়ায়। আত্মীয়তা, বন্ধুত্ব, পেশা বা অন্য কোন প্রয়োজনে দীর্ঘ সময় একসাথে থাকা বা মেলামেশা করা থেকে তৈরী হয় আন্তরিকতা যা কখনও কখনও পরকীয়ায় গড়ায়।

কখনো কখনো প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকাকে ভুলতে না পারার কারণে বিয়ের পরে অনেকে প্রাক্তন প্রেমিক বা প্রেমিকার সাথে পরকীয়ায় জড়ায়।

৩। আর্থিক কারণঃ কখনো কখনো আর্থিক লোভের কারণে লোকে পরকীয়ায় জড়ায়। যেমন কেউ কেউ প্রবাসী স্বামীর পাঠানো টাকায় আরামে জীবন কাটানোর লোভে প্রবাসীর সুন্দরী বউয়ের সাথে পরকীয়া করে। কখনও কখনও মেয়েরাও বড়লোক কোন প্রেমিক পেলে গরীব স্বামী ছাড়তে দ্বিধা করেনা।

ডিভোর্স হলে বা বিধবা হলে মেয়েরা শারীরিক ও মানসিক কারণে পরকীয়ায় জড়ায় কখনও গরীব ঘরের সুন্দরী মেয়েরা আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্যের লোভে বিবাহিত ধনী পুরুষদের সাথে পরকীয়ায় জড়ায়।

৪। সামাজিক কারণঃ যেসব সমাজে অবাধ যৌন সম্পর্ককে ( যেমন- ফ্রি সেক্স, লিভ টুগেদার, পতিতাবৃত্তি, ইত্যাদি) খারাপ চোখে দেখা হয়না, সেসব সমাজের লোকেরা বেশী পরকীয়ায় জড়ায়।

৫। প্রযুক্তিগত কারণঃ সোশাল মিডিয়া, প্রযুক্তির উন্নতি ও তা ব্যবহারের সহজলভ্যতার কারণে যোগাযোগের সুযোগ বেড়েছে। আবার মিডিয়াতে সবসময় পরকীয়া দেখতে দেখতে মানুষ এটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নিতে শুরু করেছ। এন্দুটি কারণও পরকীয়ায় জড়ানোর জন্য দায়ী।

প্রতিকার: এটা স্বীকৃত কথা যে, ইসলাম একটি সার্বজনীন,যুগোপযোগী ও বাস্তব ভিত্তিক ধর্ম। ইসলাম পরকিয়ার প্রতিকারে যেসব নীতিমালা এবং দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে তা অন্য যেকোন মতবাদ ও তন্ত্র-মন্ত্র থেকে অধিক শক্তিশালী,বিজ্ঞানসম্মত ও বাস্তবধর্মী। তবে তার কাঙ্খিত উপকারিতা পেতে হলে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সবাই সে নীতিমালা বাস্তবায়নের প্রতি সচেষ্ট হতে হবে।

চলুন এবার আমরা জেনে নেই ইসলাম পরকীয়ার প্রতিকারের ক্ষেত্রে কী কী দিক নির্দেশনা ও নীতিমালা প্রদান করেছে। পরকীয়ার দুই অবস্থা , ১, স্বামী-স্ত্রী এখনো পরকীয়ায় জড়ায়নি তবে জড়ানোর সম্ভাবনা আছে।

২. তারা পরকীয়ায় গভীরভাবে জড়িয়ে গিয়েছে। আজকের লেখায় আমরা শুধু প্রথম বিষয়টি তুলে ধরব। আর দ্বিতীয় বিষয়টি পরবর্তীতে লেখার প্রয়াস চালাবো ইনশাআল্লাহ।

আমরা কুরআন-সুন্নাহয় গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা করলে বুঝতে পারি যে, ইসলাম পরকীয়ার প্রতিকার প্রধানত দুই ভাবে করেছে।

এক, ইসলাম সর্বপ্রথম স্বামী-স্ত্রীকে খোদাভীরুতা, আখেরাতমুখীতা, দুনিয়াবিমুখতা ও কৃতকর্মের জবাবদিহিতা অর্জনের প্রতি জোর তাকিদ করেছে অর্থাৎ স্বামী- স্ত্রী যদি তাদের ব্যক্তিগত জীবনে সর্বক্ষেত্রে আল্লাহর ভয়কে দিলে জাগরুক রাখে, দুনিয়া ক্ষণস্থায়ী আর আখিরাত চিরস্থায়ী ,দুনিয়া আমলের ক্ষেত্র ,আখিরাত ভোগের স্থান এই চিন্তা- ভাবনা লালন করে এবং তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, দুনিয়াতে তারা যা করবে তাদের প্রভুর কাছে অবশ্যই এর জবাব দিতে হবে এই ভয় তাদের অন্তরে বদ্ধমূল থাকে তাহলে তারা দাম্পত্য জীবনে আল্লাহর বিধানকে কখনো লংঘন করবে না। পরনারী কিংবা পরপুরুষে আসক্ত হবে না। (চলবে)


মুফতি ও মুহাদ্দিস, শেখ জনুরুদ্দীন র. দারুল কুরআন মাদরাসা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন