কিছু শিক্ষাবিদ ও প্রশাসনের কর্মকর্তা বাংলাদেশে সব সময় ভারতের আদর্শের সরকার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকুক এমনটা দেখতে চায় বলে অভিযোগ তুলেছেন, দেশের মাদরাসা শিক্ষক-কর্মচারীদের অরাজনৈতিক সংগঠন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ্ব এ এম এম বাহাউদ্দীন। তিনি বলেছেন, এ দেশের জনসংখ্যার ৯২ শতাংশই মুসলমান। অথচ দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতিতে ভারতীয় আগ্রাসন ভয়াবহভাবে চলছে। ইসলামবিদ্বেষী অপসংস্কৃতির চেতনাধারীরা এদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় মানুষের ঈমান-আকিদা, কৃষ্টি-কালচার, ইতিহাস-ঐতিহ্য ও ধর্মীয় চেতনা উঠিয়ে দিতে চায়। মোদি অনুসারী ওই নাস্তিক্যবাদীরা প্রশাসনে থেকে ইসলামী চিন্তা-চেতনার বদলে শিক্ষা-সংস্কৃতিতে সুকৌশলে অপসংস্কৃতি ঢুকিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভায় তিনি এ অভিযোগ তোলেন। গতকাল শনিবার রাজধানীর মহাখালীস্থ মসজিদে গাউসুল আযম কমপ্লেক্সে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তিনি আরো বলেন, সঙ্কটে না পড়লে মানুষ উজ্জীবিত হয় না, উজ্জীবিত হওয়া যায় না। আপনাদের (মাদরাসা শিক্ষক ও আলেম) জন্য এ সুযোগ আর আসবে না। ভারতীয় মোদি অনুসারীরাই এই সরকারের জন্য সঙ্কট তৈরি করছে। তারা ভারতের আদর্শের সরকার দেখতে চায়, আওয়ামী লীগ নয়। আলেমদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। সবাই আমাদের কথা শুনবে। কোনো অপশক্তি আগামীতে বাংলাদেশে জায়গা পাবে না। মোদি অনুসারী, নাস্তিক্যবাদী, ভারতের অনুসারী কারো কোনো সুযোগ বাংলাদেশে থাকবে না। ইসলামী লেবাসে অনেকেই আপনাদের কাছে আসবে। সকলকে সতর্ক থাকতে হবে। আলেম-ওলামার মধ্যে কোনো বিভেদ নেই।
মাদরাসা শিক্ষকদের সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক এই সংগঠনের বৈঠকে সারাদেশ থেকে আসা মাদরাসার প্রিন্সিপাল, ভাইস-প্রিন্সিপাল অংশগ্রহণ করেন। তারা ১৩ দফা দাবিনামা তুলে ধরেন। এ দাবিতে আগামী ১৪ নভেম্বর সারা দেশে স্থানীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্দন কমসূচি পালিত হবে। প্রখ্যাত ইসলামী চিন্তাবিদ এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, বিশ্ব রাজনীতির দিকে তাকালে কী দেখি? যুদ্ধ চলছে ইউক্রেন-রাশিয়ার মধ্যে, অথচ মার খাচ্ছে ইউরোপিয়ানরা। সম্পদ চলে যাচ্ছে অন্য হাতে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার প্রয়োজন আছে। তবে এ দেশে নাস্তিকদের ইসলামবিদ্বেষী মোদির তাঁবেদারের জায়গা হবে না। স্কুল-কলেজ এবং মাদরাসা কোনো শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামবিদ্বেষী কোনো কারিকুলাম এদেশে থাকবে না। দেশে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন তাদের সঙ্গে আলেম-ওলামার কোনো বিরোধ নেই। মিয়ানমারের রাখাইন অঞ্চল মুসলমানদের এলাকা। সেখানে তারাই থাকবেন। আল্লাহ আমাদের অঢেল প্রাকৃতিক সম্পদ দিয়েছেন। বিশাল সমুদ্র দিয়েছেন। আমাদের দুশ্চিন্তার কোনো বিষয় নেই।
ভারতে একের পর এক মাদরাসা বন্ধ করা এবং সে দেশের মুসলমানদের ওপর নিপীড়নের চিত্র তুলে ধরে জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি বলেন, মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ইসলামবিদ্বেষী কারিকুলাম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। একটাই দাবি তুলতে হবে। সবাইকে এ বিষয়ে একমত থাকতে হবে।
মাদরাসা শিক্ষায় বর্তমান সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের চিত্র তুলে ধরেÑ এ এম এম বাহাউদ্দীন বলেন, প্রশাসনে কর্মরত অনেকেই ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব চিন্তা-চেতনা থেকে সরকারকে বিতর্কিত করছে। এদেশে ইসলামীবিদ্বেষী কোনো কাজ হবে না, হতে দেয়া হবে না। এ জন্য আমাদের সকলের একমত থাকতে হবে। উপস্থিতি আলেমদের উদ্দেশে তিনি বলেন, গ্লোবালাইজেশনের এ যুগে সবাই সবার খবর পান। আমাদের মধ্যে কে কোথায় যায়, কার সাথে থাকেন, সব খবর রাখা হবে। কোনো সুবিধাবাদীর পাল্লায় পড়ে অস্তিত্বহীন কোনো সংগঠনের সাথে থাকবেন না, যাবেন না। দেশপ্রেমী মুসলমান হয়ে ব্যক্তি সুবিধার জন্য ইসলামবিদ্বেষী কারো কাছে যাবেন না।
শিক্ষামন্ত্রীর উদ্দেশে তিনি বলেন, সার্বিক কর্মকাণ্ডে মানুষ মনে করছেন তিনি (শিক্ষামন্ত্রী) বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে লালন-ধারণ করেন না। তার কথাবার্তায় এটা প্রকাশ পায়। যারা আলেম-ওলামার সাথে থাকেন, তাদের সাথে আমাদের থাকতে হবে।
সভায় ১৩ দফা দাবি তুলে ধরা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে, সকল স্তরের শিক্ষক-কর্মচারীগণের চাকরি জাতীয়করণ, স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতনভাতা প্রদান, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ন্যায় স্বতন্ত্র ও সংযুক্ত ইবতেদায়ী শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা প্রদান, ২০১৮ সালে প্রণীত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার নীতিমালা শতভাগ বাস্তবায়ন, মহিলা কোটা সংশোধনপূর্বক যোগ্য ও মেধাবী শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা, আরবি প্রভাষকগণের উচ্চতর পদে আসীন হওয়ার ব্যবস্থা করা, প্রিন্সিপাল-ভাইস প্রিন্সিপাল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে আরবি প্রভাষকদের জন্য পথ উন্মুক্ত করা, ইবতেদায়ী প্রধানদের সম্মানজনক স্কেলের ব্যবস্থা করা, কামিল পাস সহকারী মৌলভীদের উচ্চতর স্কেলের ব্যবস্থা করা, বিভাগীয় পর্যায়ে মাদরাসা শিক্ষকগণের জন্য প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা, মাদরাসা স্বকীয়তা বজায় রেখে কারিকুলাম প্রণয়ন, মাদরাসার জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা ২০১৮ (২৩ নভেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সংশোধিত) স্কুল ও কলেজের নীতিমালা ২০২১ এর সাথে সমন্বয় করা, প্রায় ২ হাজার শিক্ষকের ইনক্রিমেন্ট কর্তন করা হয়েছে যা অমানবিক। অনতি বিলম্বে বকেয়াসহ প্রাপ্য ইনক্রিমেন্ট প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা শাব্বীর আহমদ মোমতাজী বলেন, পাঠ্য কারিকুলামে যেসব বিকৃত লেখা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, এসব বই আমরা মাদরাসায় পড়াবো না। অবিলম্বে এসব বিকৃত লেখা পরিহার করতে হবে। সরকারের কর্মকর্তারা আমাদের অন্ধকারে রেখে এসব বাস্তবায়ন করেছেন। আমাদের প্রজন্মকে রক্ষা করার স্বার্থে ঈমানী দায়িত্ব থেকে আমাদের এ বিষয়ে সচেষ্ট হতে হবে। মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে সঠিক পথে রাখতে আমাদের ঘরে বসে থাকলে চলবে না। স্কুল-কলেজ, মাদরাসায় ধর্মীয় শিক্ষা কারিকুলাম অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় ইসলামী শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ বিষয়ে জেলায় জেলায় কর্মসূচি দেয়া হবে।
সংগঠনের সিনিয়ার সহ-সভাপতি মাওলানা কবি রুহুল আমিন খান বলেন, পাঠ্য বইয়ে ইসলামবিদ্বেষী লেখার মাধ্যমে ইসলামের ওপর আঘাত করা হয়েছে। ইসলামের ওপর আঘাত আমরা মেনে নিতে পারি না। ইসলামী শিক্ষাকে সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। সহ-সভাপতি প্রিন্সিপাল মাওলানা কাফিল উদ্দীন সরকার ছালেহী বলেন, আমরা আতঙ্কিত যে, বাংলাদেশের শিক্ষা কারিকুলামে ইসলামবিদ্বেষী লেখা পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এসব লেখার বিরুদ্ধে এক যুগে প্রতিবাদ করতে হবে। স্মারকলিপি, জনমত গড়ে তোলতে হবে। আলেম-ওলামাকে এসব বিষয় সাধারণ মানুষকে জানাতে হবে। দেশের পীর-মাশায়েখদের একসাথে করতে হবে। দেশের ইসলামী চিন্তাবিদদের একসাথে করা এবিষয়ে তাদের আহ্বান জানাতে হবে।
প্রিন্সিপাল মাওলানা খলিলুর রহমান নেছারাবাদী বলেন, বাংলাদেশের পাঠ্য বইয়ে যেসব তথ্য দেয়া হয়েছে তা ইসলামবিদ্বেষী। এটা পরিহার করতে হবে। প্রিন্সিপাল মাওলানা মোসাদ্দিক বিল্লাহ আল-মাদানী বলেন, পশ্চিমা ও ভারতীয় কালচার আমাদের উপর চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। এভাবে পাঠ্য বইেয়ে ইসলামবিরোধী লেখা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা নূরুল ইসলাম বলেন, পাঠ্য বইয়ে এভাবে ইসলামবিদ্বেষী লেখার প্রতিবাদ করতে হবে এবং সাংগঠনিকভাবে সবাইকে একসাথে প্রতিবাদ করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, কর্মসূচির মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করা দরকার। যুগ্ম মহাসচিব ড. মাওলানা এ কে এম মাহবুবুর রহমান বলেন, পাঠ্য বইয়ে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে তা ইসলামী সংস্কৃতির জন্য হুমকিস্বরূপ। তিনি পাঠ্য বইয়ে উল্লেখিত ইসলামবিদ্বেষী চিত্র তুলে ধরেন এবং সবাইকে এবিষয়ে সচেষ্ট থাকার আহ্বান জানান।
এ ছাড়াও প্রিন্সিপাল মাওলানা আ খ ম আবুবকর সিদ্দিক, প্রিন্সিপাল মাওলানা মোকাদ্দাসুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল মাওলানা এ কে এম মনোওর আলী, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাদিউজ্জামান, সাংগঠনিক সম্পাদক ড. মো. ইদ্রিছ খান, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু ইউসুফ মৃধা, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু সাঈদ মো. কামেল কাওসার, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু জাফর মো. ছাদেক হাসান, প্রিন্সিপাল মাওলানা আনছার উল্লাহ খান, সহকারী মহাসচিব ড. মাওলানা নজরুল ইসলাম আল-মারুফ, প্রিন্সিপাল মাওলানা আ খ ম জাকারিয়া, প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল মতিন, ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা মোবাশ্বিরুল হক নাঈম, প্রিন্সিপাল মাওলানা নুমান আহমদ বিশ্বনাথী, ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রাজ্জাক, প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা আতিকুর রহমান, প্রচার সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা জহিরুল ইসলাম, শিক্ষা ও সাংস্কৃতি সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা হোসাইন আহমদ ভূইয়া, ভাইস প্রিন্সিপাল মাওলানা কুতুবুল আলম, পাঠ্যক্রম পাঠ্যসূচি সম্পাদক মাওলানা স ম আব্দুল হাকিম জেহাদী, শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণ সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুল হাই বারী, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা সারওয়ারে জাহান, প্রিন্সিপাল মাওলানা জাহাঙ্গির আলম মজুমদার, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুরাফে মো. ফেরদৌস, প্রকাশনা সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা মোক্তার আহমদ, প্রশিক্ষণ সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা রফিক উদ্দীন বক্তৃতা করেন। এছাড়াও সভায় উপস্থিত ছিলেন সহ-সভাপতি প্রিন্সিপাল ড. মাওলানা সৈয়দ শরাফত আলী, প্রিন্সিপাল মাওলানা মনিরুল্লাহ আহমদী, যুগ্ম মহাসচিব প্রিন্সিপাল মাওলানা আব্দুর রব, সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল ফরাহ্ মো. ফরিদ উদ্দীন, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাসান মাসুদ, তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক প্রিন্সিপাল মাওলানা আবুল ইরশাদ মো. সিরাজুম মুনির, শিক্ষক কর্মচারী কল্যাণবিষয়ক সম্পাদ প্রিন্সিপাল মাওলানা শাহ্ মাহমুদ ওমর জিয়াদ, প্রিন্সিপাল মাওলানা মোক্তার হোসেন, প্রিন্সিপাল মাওলানা গাজী শহিদুল ইসলাম, প্রিন্সিপাল হাফেজ মাওলানা ওয়াহিদুল হক, প্রিন্সিপাল মাওলানা আবু নাঈম মো. নিজামউদ্দীনসহ সংগঠনের সকল জেলা সভাপতি সেক্রেটারী ও নির্বাহী কমিটির নেতৃবৃন্দ।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে সম্প্রতি কুয়েতে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতায় ৩য় স্থান অধিকার করায় হাফিজ আবু রাহাতকে সংবর্ধনা দেয়া হয়। এর পর তার হাতে ২৫ হাজার টাকা ও ক্রেস্ট তুলে দেন বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি ও ইনকিলাব সম্পাদক আলহাজ এ এম এম বাহাউদ্দীন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন