আলহাজ মুহাম্মদ আলী ইমাম : বছর ঘুরে আবার আমাদের মাঝে এসেছে রহমত ও বরকতের মাস, নেয়ামতের মাস, অফুরন্ত খুশী উদযাপনের মাস এবং আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলার দরবারে বেহদ শুকরিয়া আদায় করার মাস- মাহে রবিউল আউয়াল। মাহে রবিউল আউয়াল হিজরী বর্ষের তৃতীয় মাস কিন্তু গুরুত্ব এবং মর্যাদার দিক থেকে এই মাস ঈমানদার মুসলমানদের অন্তরে এক মহাসম্মানিত আসন অধিকার করে রয়েছে। এই মাসের শুভাগমন হলেই দুনিয়ার ঈমানদার মুসলমানদের অন্তরে প্রবাহিত হতে থাকে এক মহব্বতের ফল্গুধারা। সবাই অনুভব করে এক অনাবিল প্রশান্তি। তৃষ্ণার্ত চাতক যেমন পানি দেখলেই তার অন্তরে এক আনন্দমিশ্রিত শিহরণ খেলে যায় এ যেন সে রকমের অনুভূতি। সারা বছরের অপেক্ষার অবসান হয় আনন্দের অশ্রুতে।
এই সেই রবিউল আউয়াল মাস, যেই মাসে তশরীফ এনেছেন আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলার প্রিয় বন্ধু, প্রিয় হাবীব, আল্লাহর সমস্ত সৃষ্টি জগতের জন্য রহমত বরকত ও মানব জাতির কল্যাণকামী এবং মুক্তিদাতা আখেরী নবী হুজুর সারোয়ারে কায়েনাত, আকায়ে নামদার রহমতুিল্লল আলামিন, শফিউল মুজনেবিন হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা আহম্মদ মোজতবা সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম। ১২ই রবিউল আউয়াল রোজ সোমবার ছোবহে ছাদেকের সময় পবিত্র মক্কা মোয়াজ্জামায় হযরত মা আমেনার (রা.) পবিত্র শেকমে পাক থেকে দুনিয়ার বুকে তশরীফ আনলেন হুজুর পুরনূর সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহে ওয়া সাল্লাম। হাদীছে পাক এবং অন্যান্য কেতাবের রেওয়ায়েত মতে কোন রকম অপবিত্রতা ব্যতিরেকে সম্পূর্ণ পাক পবিত্র অবস্থায় বেহেশতি পোশাক পরিহিত, চোখে সুরমা দেওয়া আল্লাহর পেয়ারা হাবীব (সা.) তশরীফ আনলেন। দুনিয়ার জমিনে তশরীফ এনেই তিনি আল্লাহর দরবারে সেজদায় পড়লেন এবং শাহাদাত অঙ্গুলী উপরে তুলে আল্লাহর একাত্মতা এবং স্বীয় নবুওতের ঘোষণা দিলেন এবং উম্মতের জন্য দোয়া করলেন “রাব্বি হাবলী উম্মতি, রাব্বি হাবলী উম্মতি”।
বিভিন্ন রেওয়ায়েত মতে, হযরত মা আমেনা (রা.) বর্ণনা করেন, “আমার শিশু সন্তান যখন ভূমিষ্ঠ হচ্ছিল তখন আমি শুনতে পাচ্ছিলাম অনেক লোকের আওয়াজ। তারা সালাম দিতে দিতে আমার ঘরের দিকে আসছিল।” রেওয়াতে রয়েছে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল (আ.) এর নেতৃত্বে ঝান্ডা নিয়ে মিছিল বা জুুলুস সহকারে হাজার হাজার ফেরেস্তা আখেরী নবী ইমামুল আম্বিয়া নবী করীম (সা.) কে মোবারকবাদ ও সালাম আরজ করতে করতে হযরত মা আমেনার (রা.) গৃহের দিকে আসছিলেন এবং এই ঝান্ডা পবিত্র কাবা শরীফের উপরে স্থাপন করেন। এই বিষয়টিই চতুর্দশ শতাব্দীর মোজাদ্দেদ আ’লা হযরত আহমদ রেজা খাঁন ফাজেলে বেরলভী (র.) আলাইহে তাঁর কিতাবে উল্লেখ করেছেন- “ফেরেশতোঁ কী সালামী দেনে ওয়ালী ফৌজ গাতি থী, হযরতে মা আমেনা ছুনতি থী আওয়াজ আতি থী”। আল্লাহর পেয়ারা হাবীব হযরত রাসুলে করিম (সা.) এর দুনিয়ার জমিনে শুভাগমনে এই পবিত্র দিনটিকে উপলক্ষ করে সারা দুনিয়ার ধর্মপ্রাণ নবী প্রেমিক মুসলমানগণ উদ্যাপন করেন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহে ওয়া সাল্লাম। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তাআলা আলাইহে ওয়া সাল্লাম সাধারণত ‘ঈদ’ অর্থ আনন্দ বা আরো একটু বিশ্লেষণ করলে আনন্দ উদযাপন করা। ‘মিলাদুন্নবী (সা.)’ আরবী শব্দ। আভিধানিক অর্থ হচ্ছে নবী (সা.) এর শুভাগমন। সুতরাং ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)’ এর সার্বিক অর্থ দাঁড়ায় নবী করীম (সা.) এর শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ বা খুশী উদযাপন করা। এখানে একটি প্রশ্ন আসতে পারে আমাদের আরো দুটি ঈদ রয়েছে। একটি পবিত্র রমজানুল মোবারক শেষ হওয়ার পরের দিন অর্থাৎ শাওয়াল মাসের প্রথম দিন ঈদুল ফেতর এবং জিলহজ্ব মাসের ১০ তারিখে ঈদুল আজহা বা পবিত্র কোরবানীর ঈদ। এই দুইটা ঈদ আমরা প্রতি বছর উদযাপন করে থাকি। আল্লাহ তাআলার নির্দেশে একমাস সিয়াম সাধনার পর শাওয়াল মাসের চাঁদ উদিত হলেই পর দিন রোজা রাখা নিষিদ্ধ হয়ে যায় এবং ঈদ উদযাপন করতে হয়। এই ঈদ আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে রোজাদারদের জন্য একটি পুরষ্কার বা সওগাত। একটি পূণ্য কাজের ফলাফল। ঈদুল আজহা ও ঠিক এমনিই আল্লাহ তাআলার নির্দেশে নবী হযরত ইসমাঈল (আ.) কে স্মরণ করে আল্লাহর রাস্তায় পশু কোরবানী দেয়া। এটি একটি কর্মের অনুসরণ বা নির্দেশ পালন। এই দুটি ঈদ দুনিয়ার ধর্মপ্রাণ মুসলমান অতি মর্যাদা সহকারে পালন করে থাকেন। তাহলে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কেমন ঈদ। আর পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) এমন একটি অনুষ্ঠানের নাম, একটি দিবসের নাম, একটি কর্মকা-ের নাম যার সাথে জড়িয়ে আছে কুল কায়েনাতের বিশ্বাস, অবস্থান এবং বর্তমান ভবিষ্যৎ। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলার পক্ষ থেকে এমন এক নেয়ামত যা গ্রহণ, পালন এবং যার শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করে থাকে। পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) কেন এত গুরুত্বপূর্ণ। আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা হাদীসে কুদসীতে নবী করিম (সা.) কে উদ্দেশ্য করে এরশাদ করেন- “লাওলাকা লামা খালাকতুল আফলাক।” অর্থাৎ ‘‘(হে নবী), আমি যদি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে আমি কিছুই সৃষ্টি করতাম না।” এই হাদীসে কুদসীতে আল্লাহ তবারক তাআলা পরিষ্কার করে স্বীয় রসুল (সা.) এর সৃষ্টির উদ্দেশ্য বর্ণনা করেছেন। এই বিশ্ব জগৎ, আসমান-জমিন, বেহেশত-দোজখ, আরশ-কুরসী সব কিছু সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর প্রিয় হাবীবকে (সা.) আঠার হাজার মাখলুকাতের সামনে প্রকাশ করা। শুধু প্রকাশ করা নয় আল্লাহর রহমত স্বরূপ মানবজাতির কল্যাণে দুনিয়ার জমিনে প্রেরণ করা। যেমন, আল্লাহ তাআলা কোরআনে করিমে এরশাদ করেন, “ওয়ামা আরছালনাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন”। অর্থাৎ (হে রাসুল), আমি আপনাকে সমস্ত সৃষ্টির জন্য শুধুমাত্র রহমত স্বরূপ প্রেরণ করেছি।” এই জন্যে বলা হয়, সকল ঈদের সেরা ঈদ- ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)।
আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা মানব জাতির জন্য অফুরন্ত রহমত ও নি’মাতের ভান্ডার খুলে দিয়েছেন। সুরা আর রাহমানে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা এমন অনেক নেয়ামতের কথা উল্লেখ করেছেন এবং সে সব নেয়ামতের কথা বান্দাগণ যাতে অস্বীকার না করে তার জন্য সতর্ক করে দিয়েছেন। আল্লাহ তাআলা আরেক আয়াতে নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার জন্য মানব জাতিকে নির্দেশ দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তাআলা এরশাদ করেন, “ফায্কুরূনী আযকুরকুম, ওয়াশকুরূলী ওলা তাকফুরুন”। অর্থাৎ, আল্লাহ বান্দাদেরকে উদ্দেশ করে বলেন, “যদি তোমরা আমাকে স্মরণ কর আমিও তোমাদেরকে স্মরণ করব এবং আমার শোকরগোজারী কর এবং না শুকরী করোনা”। বুঝা গেল যে, আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতের বা রহমতের শুকরগুজার হওয়া আমাদের জন্য কত গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্য কর্তব্য। আরেক আয়াতে করিমায় আল্লাহ তবারক তাআলা স্বীয় হাবীব (সা.) কে উদ্দেশ করে বলেন, “কুুল ইয়া এবাদিয়াল্লাজিনা আছরাফু আলা আনফুছেহিম, লা তাকনাতু মির রাহমাতিল্লাহ্। ইন্নাল্লাহা ইয়াগ ফেরুজ জুনুবা জামিয়া, ইন্নাহু হুয়াল গাফুরুর রাহীম”। এই আয়াতে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা স্বীয় হাবীব (সা.) এর মাধ্যমে তার গোনাহগার বান্দাদেরকে গোনাহের কারণে তাঁর রহমত থেকে নিরাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং বলেছেন তাদের সব গুনাহ আল্লাহ ক্ষমা করে দিবেন। যে রহমতের কথা আল্লাহ তাআলা ঘোষণা করেছেন সে রহমত তো উপরে উল্লেখিত অপর এক আয়াতে করিমা মতে রাসূলুল্লাহ (সা.) স্বয়ং। অর্থাৎ, আল্লাহ তাআলা তার গুনাহগার বান্দাদেরকে নবী করিম (সা.)- নেগাহে করম লাভ করা থেকে নিরাশ বা হতাশ না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। এমনি অপর এক আয়াতে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা তাঁর প্রিয় হাবীবকে উদ্দেশ্য করে এরশাদ করেন- “যদি গুনাহে লিপ্ত আমার বান্দাগণ (হে রসূল) আপনার দরবারে যায় এবং আল্লাহর দরবারে নিজ গুনাহ মাফের জন্য আরজ করে এবং আপনি তার গুনাহ মাফের জন্য দোয়া (সুপারিশ) করেন, তাহলে ঐ গুনাহগার বান্দা আল্লাহ তাআলাকে তাওবা কবুলকারী দয়ালু হিসেবেই পাবে”। এই আয়াতে করিমার মাধ্যমে আল্লাহ তবারক তাআলা নবী করিম (সা.) কে মানব জাতির মুক্তির জন্য এক মহা নেয়ামত হিসাবে বর্ণনা করেছেন। উপরোক্ত আয়াতে করিমা সমূহের আলোকে একথা ষ্পষ্ট যে, নবী করিম (সা.) ই হচ্ছেন আল্লাহর তবারকা ওয়া তাআলা প্রদত্ত নেয়ামত গুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নেয়ামত। কারণ হাদীসে কুদসী মতে রাসূলে করিম (সা.) কে সৃষ্টি না করলে আল্লাহ কোন কিছুই সৃষ্টি করতেন না। বাকী সব নেয়ামত আমরা পাই রাসূলে করিম (সা.) এর মাধ্যমে। এক হাদীছে পাকে রাসূলে করিম (সা.) এরশাদ করেন, “আনা কাছেমুন ওয়াল্লাহ ইয়ুতি”। অর্থাৎ, “আল্লাহ দান করেন আর আমি বন্টনকারী”। সুতরাং উপরের বিস্তৃত আলোচনার আলোকে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় করা সকল মানব জাতির জন্য বিশেষ করে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য অপরিহার্য যদি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে হয়। শুকরিয়া আদায় করার একটি উল্লেখযোগ্য মাধ্যম হলো বেশী পরিমাণে নবী করিম (সা.) এর উপর দরুদ ও সালাম পাঠ করা যা কোরানে করিমের ঘোষণা মতে আল্লাহ তার সমুদয় ফেরেশতাগণসহ প্রতিনিয়ত বিরতিহীনভাবে দরুদ পাঠ করে থাকেন এবং আমাদেরকে নবী (সা.) -এর প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
নেয়ামতের শুকরীয়া আদায়ের আরেকটি এবং বড় এবাদত হলো খুশী উদযাপন করা। কোরানে করিমে আল্লাহ তবারকা ওয়া তাআলা এরশাদ করেন, “কুল বেফাদলিল্লাহে ওয়া বেরাহমাতিহি ফাবেজালেকা ফাল ইয়াফরাহু” অর্থাৎ, (হে রাসূল) আপনি বলুন, (সবকিছু) আল্লাহর দয়া ও মেহেরবানীতে। সুতরাং এরই প্রতি তারা (মুসলমানগণ) যেন খুশী উদযাপন করে। তারা যা সঞ্চয় করছে তা থেকে এটিই শ্রেষ্ঠতর”। এই আয়াতে করিমার তফসির করতে গিয়ে বিশ্ববিখ্যাত তাফসির বিশারদগণ যেমন, আল্লামা মাহমুদ আলুসী, আল্লামা ইমাম জালালুদ্দিন ছুয়ুতি, ইমাম আবু হাইয়ান আনদালুসী রাহমাতুল্লাহে আলাইহিম বলেন, “তোমাদের প্রতি হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লামকে প্রেরণ করে এবং কোরআন অবতীর্ণ করে আল্লাহ তোমাদের উপর যে দয়া ও করুণা করেছেন তাতে তোমরা খুশী উদযাপন কর। (চলবে)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন