বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, আমরা আর পিছিয়ে যাবো না। পিছিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। সারাদেশে যে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তাতে এ স্বৈরাচারী সরকার ভেসে যাবে। গণআন্দোলনের মাধ্যমে নিশিরাতের ভোট-ডাকাত সরকারের পতন হবে।
আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা নতুন দিনের সূর্যকে ছিনিয়ে আনবো। নতুন আলোয়ে উদ্ভাসিত হবে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। আমাদের এখন এক দফা দাবি, এ সরকারের পদত্যাগ। এ দাবি আদেয়ের পথ একটাই, সেটা হলো রাজপথ। গতকাল শনিবার ফরিদপুরের কোমরপুর এম এ আজিজ ইনস্টিটিউশন মাঠে অনুষ্ঠিত বিএনপির ফরিদপুর বিভাগীয় গণসমাবেশে প্রধান অথিতির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিসহ বিভিন্ন দাবিতে বিএনপি এ বিভাগীয় গণসমাবেশের আয়োজন করে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের সেøাগান এখন একটাই, ‘ট্র্যাক ব্যাক বাংলাদেশ’। আমাদেরকে রুখে দাঁড়াতে হবে। অন্যায়-অত্যাচার আর সহ্য করবো না। এ সরকারের হাতে দেশ, গণতন্ত্র কোনোটাই নিরাপদ নয়। আমরা চাই এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ। এরপর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হবে। তারা নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবেন। তাদের মাধ্যমে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আমরা জাতীয় সরকার গঠন করবো।
নির্বাচনে যারাই অংশগ্রহণ করবেন তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা জাতীয় সরকার গঠন করবো। আর সেই জাতীয় সরকার রাষ্ট্রের মেরামতের কাজ শুরু করবে। সে মেরামত হলো বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা ফিরিয়ে এনে দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা। প্রশাসনকে দলীয়করণমুক্ত করে সুশাসনের ব্যবস্থা করা এবং দুর্নীতিরমুক্ত বাংলাদেশ গড়া, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা করা।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, আমাদের এ সংগ্রাম অধিকার আদায়ের সংগ্রাম, ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার সর্বোপরি গণতন্ত্রের অধিকার ফিরে পাওয়ার সংগ্রাম। গত শুক্রবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক সভায় প্রাধানমন্ত্রী বলেছেন, তারা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। প্রাধানমন্ত্রীর এ বক্তব্য শুনে ঘোড়ারও হাসি পায়। আমি প্রাধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চাই, তাদের কাছে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কী? মধ্যরাতে ভোট ডাকাতি করে ক্ষমতায় আসা জনগণের ভোট দেওয়ার অধিকারই কি গণতন্ত্র? গুম, খুন, হত্যার মাধ্যমে বিরোধী দলকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার নামই কি গণতন্ত্র? সভা-সমাবেশে বাধা দেওয়ার নামই কি গণতন্ত্র? আসলে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করেন না। ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’ এ সেøাগানে তারা বিশ্বাসী নয়। আওয়ামী লীগের সেøাগান আমার ভোট আমি দেব, তোমার ভোটও আমি দেব।
মির্জা ফখরুল বলেন, ক্যাসিনো সম্রাটকে মুক্তি দেওয়া হয়, অথচ বেগম খালেদা জিয়াকে আটকে রাখা হয়। তারেক রহমানের নামে মিথ্যা মামলা দিয়ে সাজিয়ে-গুছিয়ে সাজা দেওয়া হয়। তাকে দেশে আসতে দেওয়া হয় না, এটাই তাদের গণতন্ত্রের নমুনা।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালে বাকশাল কায়েমের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র চালু করেন। আপনারা সংবিধানের কথা বলেন, এ সংবিধান আপনারাই প্রথম সংশোধন করেছেন।
সংবিধানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল, আপনারা নিজেদের সুবিধা, ক্ষমতায় ঠিকে থাকার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছেন। আজ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছে। এ দাবি অবশ্যই মানতে হবে। জনগণের দাবি উপেক্ষা করে কেউ কোনোদিন ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ফেরাউন পারেনি, নমরুদ পারেনি, হিটলার-মুসেলিনি কেউ পারেনি, আপনিও পারবেন না।
বর্তমান সরকারের লুটপাট ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী লীগ মানেই চুরি ডাকাতি হত্যা খুন দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি। তাদের দলের নেতা মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, আমার চার পাশে সব চোরের দল, আমরা এখন তারই ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি। বড় বড় মেগা প্রজেক্টে হাজার হাজার কোটি লুটপাট হয়েছে। শেয়ার বাজার, ব্যাংক, সব লুটেরারা লুট করে খাচ্ছে। শুধু তাই নয়, দুস্থ মানুষের টাকাও চুরি করে খাচ্ছে। দেশের টাকা লুট করে নির্বিঘ্নে বিদেশে পাচার করছে। দেশ আজ অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হয়ে গেছে। রিজার্ভের টাকাও সরকার গিলে খাচ্ছে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দেশে এখন ৪২ শতাংশ মানুষ দরিদ্র। কৃষকরা তাদের পণ্যের ন্যায্য মজুরি পাচ্ছে না, তাই তারা চাষ করতে আগ্রহী হচ্ছে না। সার, ডিজেল, এসবের যে দাম বেড়েছে তাতে কৃষকের কৃষিপণ্যের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ সরকার বলেছিল, ১০ টাকা সের চাল খাওয়াবে, এখন সে চালের মূল্য ৮০/৯০ টাকার কাছাকাছি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষের জীবন আজ দুর্বিষহ। চাল, ডাল, তেল, নুনসহ প্রতিটি জিনিসের দামই এখন সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার বাইরে।
বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। মানুষ এ অবস্থা থেকে আজ মুক্তি চায়। তাইতো আজ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষ আন্দোলনে নেমেছে। আর এ গণআন্দোলনের মাধ্যমেই স্বৈরাচারী সরকারের পতন হবে ইন শা-আল্লাহ।
বিএনপি মহাসচিব বৃহত্তর ফরিদপুরবাসীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, আপনারা আজ তিনদিন যাবৎ গণসমাবেশস্থলে খেয়ে না খেয়ে কষ্ট করছেন। কিন্তু আমি জানি, এ কষ্ট আপনাদের কাছে কষ্ট মনে হচ্ছে না। কারণ, এই ফরিদপুরবাসীর রয়েছে আন্দোলন-সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস।
সেই ব্রিটিশবিরোধী লড়াই থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম পর্যন্ত ফরিদপুরের মানুষ নেতৃত্ব দিয়েছে। তাদের নেতা ছিলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ, দুদু মিয়া, শেখ মুজিবুর রহমান, মোহন মিয়া, কে এম ওবায়দুর রহমান, চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। সেই ফরিদপুরবাসী এবার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আনন্দোলনে নেমেছে। এ আন্দোলনে ইতোমধ্যেই আমাদের ৫ ভাই শহীদ হয়েছেন। তাদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। আমরা আন্দোলনের মাধ্যমে আমাদের ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার আদায় করবো। আমাদের হাতে স্বাধীনতার পতাকা আর ওদের হাতে পরাধিনতার শৃঙ্খল। আমরা আমার দেশকে শৃঙ্খলে বন্দি হতে দেব না। এবার আমরা আমাদের অধিকার আদায় করেই ঘরে ফিরবো ইন শা-আল্লাহ।
ফরিদপুর মহানগর বিএনপির আহবায়ক এ এফ এম কাইয়ুম জঙ্গির সভাপতিত্বে, জেলা বিএনপির সদস্য সচিব কিবরিয়া স্বপনের সঞ্চালনায় সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর, চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন, জহুরুল হক শাহাজাদা মিয়া, যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দীন খোকন, ফরিদপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শামা ওবায়েদ, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার মাশুকুর রহমান, সেলিমুজ্জামান সেলিম ভুঁইয়া, কেন্দ্রীয় যুবদলের সভাপতি সুলতান সালাউদ্দীন টুকু, কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শাহীদুল ইসলাম বাবুল, জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য তাবিথ আওয়াল, সাবেক সংসদ সদস্য ইয়াসমিন আরা হক, সাবেক সংসদ সদস্য খন্দকার নাসিরুল হক, কেন্দ্রীয় যুবদল নেতা মাহবুবুল হাসান পিংকু, ফরিদপুর জেলা বিএনপি আহবায়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মেদারেছ আলী ইছা, ঢাকা মহানগর উত্তর মহিলা দলের আহ্বায়ক নায়াব ইউসুফ, ফরিদপুর জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক আফজাল হোসেন খান পলাশ, জুলফিকর হোসেন জুয়েল, ফরিদপুর থানা বিএনপির সভাপতি রাউফুন্নবী।
বিএনপির সমাবেশেকে ঘিরে বৃহত্তর ফরিদপুরে চলে ২ দিনব্যাপী পরিবহন ধর্মঘট। রাজবাড়ী, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জসহ সারাদেশের সাথেই ফরিদপুরের যোগাযোগ সম্পূর্ণই বিছিন্ন হয়ে পড়ে। বাস, লঞ্চসহ অন্যান্য ছোটো খাটো যান চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে এসব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করেই গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে হাজার হাজার নেতাকর্মী ফরিদপুরের কোমরপুরে অবস্থিত এম এ আজিজ ইনস্টিটিউশন মাঠে অবস্থান করেন। মাঠের চারপাশে উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। আশপাশে বসে অস্থায়ী নানা রকমের দোকানপাট। গোটা এলাকা যেন একটি গ্রাম্য মেলায় পরিণত হয়।
সমাবেশস্থলে নেতাকর্মীরা হোগলার পাটি বিছিয়ে, চিড়া-মুড়ি খেয়ে শুয়ে থাকেন। কেউ বা বেগম খালেদা জিয়ার, তারেক রহমানের ছবিসম্বলিত ফেস্টুন হাতে নিয়ে সেøাগান তোলেন। আবার অনেকে মিছিল করে মাঠ প্রদক্ষিণ করেন। সব মিলিয়ে নির্ধারিত সময়ের দু’দিন আগেই সমাবেশস্থলে উৎসবমুখর পরিবেশ পরিলক্ষিত হয়। শুক্রবার সন্ধ্যায় সমাবেশস্থল কানায় কানায় ভরে যায়।
পথে পথে পুলিশি বাধা :
বিএনপির সমাবেশকে ঘিরে পুলিশ বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে টহল দেয়। রাস্তায় গাড়ী তল্লাশি করে। এতে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তিতে পড়েন। বৃহত্তর ফরিদপুরের অন্যান্য জেলা সদর যেমন- শরীয়তপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ জেলা থেকেও কোনো যানবাহন আসতে দেয়া হয়নি।
ছোটো-খাটো অটো, নছিমন-করিমন রাস্তায় চলতে দেখলেই পুলিশ সেগুলোকে তল্লাশির নামে থামিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেয়। এভাবেই পথে পথে বিএনপির নেতাকর্মীদের সমাবেশেস্থলে আসতে বাধা দেয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে ভাঙ্গা বিশ্বরোড মোড়, গোয়ালন্দ মোড়, মাঝকান্দির মোড়, তালমার মোড়, পুকুরিয়ার মোড়, শিবরামপুর মোড়, বসন্তপুর মোড়। এসব মোড় ছাড়াও বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশের ব্যাপক তল্লাশি চলে। তবে আটকের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন