জাতিসংঘের শিশু তহবিল ‘ইউনিসেফের’ অর্থ ব্যয়ে করে জাকজমকপূর্ণ সম্বর্ধনা দেয়া হলো সদ্য সচিব পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ড. মুশফিকর রহমানকে। গতকাল সোমবার আগারগাাঁও ইসলামিক ফাউন্ডেশন অডিটোরিয়ামে এ রাজসিক সম্বর্ধনা দেয়া হয়। এতে বক্তৃতা করেন সদ্য সচিব পদে পদোন্নতি প্রাপÍ মহাপরিচালক ড. মুশফিকর রহমান এবং ইফার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. মুনিম হাসান (অতিরিক্ত সচিব), সমন্বয় বিভাগের পরিচালক মহিউদ্দিন মজুমদার, পরিচালক হাজেরা খাতুনসহ অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ।
তবে আয়োজকরা একে পুরাতন মহাপরিচালকের বিদায় এবং অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত নতুন মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ উপলক্ষে সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান বলে অভিহিত করেন। এতে আয়োজকদের জন্য ভুরিভোজ এবং সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত সচিবের জন্য লক্ষাধিক টাকার পুরস্কার দেয়া হয়। ইউনিসেফের অর্থ কোন অনুষ্ঠান না করে ভূয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে খরচ দেখিয়ে এ অর্থ সম্বর্ধনায় ব্যয় করা হয়। ইউনিসেফের অর্থ শিশুদের কল্যাণে ব্যয় না করে সরকারি কর্মকর্তার সম্বর্ধনায় ব্যয় করা নিয়ে খোদ ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান বিশ্ব প্রেক্ষাপট এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নীতিমালায় এ ধরণের জমকালো সম্বর্ধনা এবং ভুরিভোজের যৌক্তিকতা কতটুকু তাই নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইউনিসেফের অর্থে ইফার বিদায়ী ডিজি ও নতুন ভারপ্রাপ্ত ডিজির সম্বর্ধনা বিধি সম্মত হয়েছে কী না এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল রাতে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম ট্রেনিং একাডেমীর পরিচালক আনিসুজ্জামান সিকদার এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে ইনকিলাবকে বলেন, ইউনিসেফের ২ হাজার টাকা যখন স্বাক্ষর করে আমার হাতে আসে তখন তা’ ইউনিসেফের থাকে না। আমরা (প্রতিনিধিরা) ১৮শ’ টাকা করে পেয়েছি। এ টাকা আমরা স্বেচ্ছায় সম্বর্ধনায় দিয়েছি। এ নিয়ে কোনো বিতর্ক টেনে আনা উচিৎ নয়। কেউ এটা অনিয়ম বললেও বলতে পারে। কিন্ত স্যার ইফাকে পরিচ্ছন্ন করেছেন।
ধর্ম মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়,প্রায় দেড় বছর ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক ছিলেন ড. মুশফিকুর রহমান। এ সময়ে প্রতিষ্ঠানটিতে দৃশ্যমান কোন উন্নতি হয়নি। বায়তুল মোকাররমের পূর্বগেটের রাস্তা দখল করে নিয়েছিল জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ। সচিব পদে পদোন্নতিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে এ কারণে মহাপরিচালক এ বিষয়ে নীরব থাকেন। পরে বায়তুল মোকাররম মুসল্লি পরিষদের আন্দোলনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সেখানে পার্ক নির্মাণ থেকে সরে আসে। সেটি মুসল্লিদের চলাচলের জন্য রাস্তা নির্মাণে তারা সন্মত হয়। কিন্তু উক্ত স্থানে রাস্তা নির্মাণের সামান্যতম উদ্যোগও নেননি ড. মুশফিকুর রহমান। ফলে রাস্তাটি এখনো পরিত্যাক্ত অবস্থায় রয়েছে এবং তা ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়েছে। এ ব্যাপারে ইফার সহকারী প্রকৌশলী মিজানুর রহমান ইনকিলাবকে জানান, বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব পার্শ্বের রাস্তা সংস্কারের জন্য প্রায় সাড়ে ৫ কোটি টাকার অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব ধর্ম মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়েছে। এখনো কোনো অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অধীনে বায়তুল মোকাররমের মার্কেটে প্রায় সাড়ে ৮শ’ দোকান রয়েছে। ১৯৬২ সাল থেকে এসব দোকান বিভিন্ন সময়ে প্রতি স্কয়ার ফিট মাত্র ৭ টাকা হারে ভাড়া দেয়া হয়। সে ক্ষেত্রে প্রতি দোকান ৩/৪শ’ টাকা ভাড়া হয়। ইফার কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও ডিজির চরম উদাসিনতায় এসব দোকানের ন্যূনতম ভাড়া আদায়ে চরম ব্যর্থতা পরিচয় দিচ্ছে ইফা কর্তৃপক্ষ। অসমর্থিত সূত্র জানায়, ইফার অসাধু কর্মকর্তা ও মার্কেটের দোকানদারদের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠায় যুগ যুগ ধরে দোকানের প্রায় আড়াই কোটি টাকা বকেয়া ঝুলছে। এসব কর্মকর্তারা তাদের কাছ থেকে নিয়মিত সুযোগ সুবিধা গ্রহণেরও গল্প গুজব রয়েছে। মার্কেটের দোকান ভাড়া বর্তমান বাজার মূল্য হারে বর্ধিত করার জন্য ইফার বোর্ড সভায় প্রস্তাব তোলার উদ্যোগ নেয়া হলেও অজ্ঞাত কারণে ডিজি প্রস্তাব উঠাননি।
ইসলামিক ফাউন্ডেশনে অর্ধশতাধিক কর্মকর্তার পদ খালি। কর্মচারীর পদও খালি রয়েছে আরো বেশি। কিন্তু তার সচিব পদে পদোন্নতিতে বিঘ্ন ঘটতে পারে এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির কোন নিয়োগ-পদোন্নতি তিনি দেননি। ফলে মাঠ পর্যায়ে অফিস কার্যক্রম প্রায় বন্ধের উপক্রম। এ বিষয়ে কোন ভ্রুক্ষেপ ছিলা না সদ্যবিদায়ী মহাপরিচালক ড. মুশফিকুর রহমানের। সোমবারের সম্বর্ধনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অর্ধশতাধিক কর্মকর্তা কর্মচারীকে কোন প্রশিক্ষণ ভাতা না দিয়ে ইউনিসেফের প্রশিক্ষণের অর্থ গ্রহণের কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হয়। আর এ টাকা সম্বর্ধনায় ব্যয় হয়। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়।
অপরদিকে ইউনিসেফ বাংলাদেশ মূলত সুবিধা থেকে বঞ্চিত শিশুদের নিয়ে কাজ করার কথা থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে তাদের কর্মকাণ্ড নানা বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। অভিযোগ উঠেছে ইউনিসেফের অর্থ শিশুদের কল্যাণের পরিবর্তে একশ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তাদের পকেটে যাচ্ছে। ইমামদের মাধ্যমে শিশুদের টিকাদনে উদ্ধুদ্ধ করতে অর্থ বরাদ্দ দিয়েছে ইউনিসেফ বাংলাদেশ । সে অর্থের একটি অংশ গিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের আনুষ্ঠানিকতা , ভ্রমন এবং আপ্যায়নে। এর মাধ্যমে শিশুরা কতটুকু উপকৃত হয়েছে তার কোন মূল্যায়ন হয়নি।
দেশে মসজিদ জরীপের কাজ ইউনিসেফের কোন কাজ নয়। এটি ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম মৌলিক কাজ। ইতিপূর্বে এ ধরণের জরীপ ইসলামিক ফাউন্ডেশন নিজস্ব অর্থে অনেকবার সম্পন্ন করে তা বই আকারে বের করেছে। কিন্ত কিছুদিন আগে ইউনিসেফ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একশ্রেণীর কর্মকর্তাদের যোগসাজোসে মসজিদ জরীপের জন্য দৌঁড় ঝাপ শুরু করে। জানা গেছে, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের বিদায়ী মহাপরিচালক ড. মুশফিকুর রহমান মসজিদ জরীপের কাজটি ইউনিসেফকে দিয়ে করাতে ধর্ম সচিবের কাছে প্রস্তাব পাঠান। ধর্ম সচিব প্রস্তাবটি নাকচ করে দেন এবং ইউনিসেফকে শিশুদের নিয়ে কাজ করার পরামর্শ দেন। ধর্ম সচিব মহাপরিচালককে এরূপ প্রস্তাবের জন্য ভৎসনা করেন এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নিজস্ব অর্থে তা পরিচালনা করার নির্দেশ প্রদান করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন