আমাদের জীবন যখন আছে। দুঃখ বেদনা, রোগ শোক, বিপদ মসিবত আসবে এটাই স্বাভাবিক। দুঃখ, রোগ, বিপদ এলে প্রত্যেক মানুষ দুঃখ রোগ বিপদ থেকে মুক্তি চায়, মুক্তি পেতে চেষ্টা করে এটাও স্বাভাবিক, এটাই নিয়ম। পৃথিবীতে একজন মানুষ ঁেবচে আছে, অথচ তাকে কোন রোগ শোকে পায়নি, দুঃখ কষ্ট স্পর্শ করেনি, বিপদ ঘিরে ধরেনি এমন মানুষ পাওয়া যাবে না। সুস্থতা-রোগ, সুখ-দুখ, বিপদ-শান্তি, পেরেশানী-প্রশান্তি একটি অপরটির সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িত। একটি এসে অপরটির মূল্যায়ন বাড়িয়ে দেয়। মন্দ আর ক্ষতি, কষ্ট থেকে বাঁচার, বিপরিতটি অর্জন করার জন্য পাগল পারা হয়ে যায়।
ক্ষুধা লাগলে মানুষ খাবার সন্ধান করে, খাবার খায়। পিপাসা লাগলে পানি খোঁজ করে, পানি পান করে পিপাসা দুর করে। এটা সকল মানুষের চিরাচরিত নিয়ম। কিন্তু একজন ইমানদার আর একজন কাফের তার মধ্যে বিরাট পার্থক্য বিদ্যমান। কাফের শুধু চতুস্পদ জন্তুর মত খাবার সাবার করে, শুধু উদর পূর্তি করে। আর একজন ইমানদার খাবার নিতে তাঁর স্রস্টার নাম নেয়, খাবার গ্রহনের সময়, খাবার শেষে আল্লাহর শুকরিয়া, কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে।
মানব জীবনে দুঃখ- কষ্ট, রোগ-শোক, দুশ্চিন্তা-পেরেশানী, বিপদ-মসিবত, অভাব-অনটন বিভিন্ন কারণে ঘটে থাকে। সৃষ্টিগত কারন, ব্যক্তিগত কারন, শত্রুতাগত কারন, জ্বিনগত কারন, জাদুগত কারন ইত্যাদি। একমাত্র মৃত্যু রোগ ছাড়া, মৃত্যুগত বিপদ ছাড়া সব বিপদের, সব রোগ শোক থেকে উদ্ধারের পথ মহান রব রেখে দিয়েছেন। এমন কোন রোগ নেই যার ঔষধ মহান রব সৃষ্টি করেননি। এমন কোন পেরেশানী নেই যা দুর করার পথ দয়ালু আল্লাহ সৃষ্টি করেননি। এমন কোন অভাব অনটন নেই যা কখনো দুর হবার নয়।
ইমাম মুসলিম রাহঃ তাঁর সহিহ মুসলিমে বর্ণনা করেন, হযরত জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রত্যেক রোগের ঔষধ আছে। যখনই রোগের ঔষধ পাওয়া যায়, তখন আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় তা সুস্থ হয়ে যায়।
ইমাম বুখারী রাঃ সহিহ বুখারী তে বর্ণনা করেন, আবু হুরায়রা রাঃ বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, মহান আল্লাহ এমন কোন রোগ দেননি যার আরোগ্যের কোন ব্যবস্থা করেননি।
ইমাম আহমাদ রাহঃ মুসনাদে বর্ণনা করেন , উসামা ইবনে শারিক রাঃ বর্ণনা করেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট এস দেখলাম তাঁর সাহাবীগনের মাথার উপর যেন কোন পাখি বসে আছে। অর্থাৎ একেবারে শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছে। আমি যেখানে সালাম দিয়ে বসলাম। এমন সময় এদিক সেদিক থেকে কিছু বেদুইন এসে বলল হে আল্লাহর রাসুল আমরা কি চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহন করব। তিনি বললেন, তোমরা চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহন করো। কেননা মহান আল্লাহ বার্ধক্য ছাড়া সকল রোগের ঔষধ সৃষ্টি করেছেন।
ইমাম আহমাদ রাহঃ মুসনাদে আহমদে বর্ণনা করেন এছাড়াও সুনানে হমায়দীতে বর্ণিত আছে, আল্লাহ তায়ালা এমন কোন রোগ সৃষ্টি করেননি। যার ঔষধ তিনি সৃষ্টি করেননি। যাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তিনি জেনে গেছেন। আর যাকে অজ্ঞ রেখেছেন তিনি মুর্খ থেকেছেন।
আর খুজামা ইবনে কাব ইবনে মালিক রাঃ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নিকট আরজ করলাম, হে আল্লাহর রাসুল এই যে ঝাড়ফুঁক করানো অথবা ঔষধ ব্যবহার করা হয় অথবা সাবধানতা অবলম্বন করা হয়। আপনি কি মনে করেন এর দ্বারা আল্লাহর নির্ধারিত তাকদীরের সামান্য পরিবর্তন হতে পারে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জবাবে বললেন, এটিও (চিকিৎসা গ্রহন) আল্লাহর তাকদীরের অন্তর্ভূক্ত।
আল্লাহর সৃষ্টিতে প্রত্যেকটি সৃষ্টির প্রতিপক্ষ রয়েছে। একটি অপরটির ক্ষতি করে, বা উপকার করে, সাহায্য করে, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, সফলতা এনে দেয় বা ব্যর্থ করে দেয় বা ব্যর্থ করে দিতে চেষ্টা করে। এখানে কেউ সহযোগী কেউ প্রতিযোগী। কেউ শত্রু, কেউ মিত্র। কেউ কল্যানকামী কেউ ক্ষতিকর। এখানে সুখ দুখ, হাসি কান্না, সফলতা ব্যর্থতা, রোগ শোক, পেরেশানী প্রশান্তি, উপকার ক্ষতি সবকিছু বিদ্যমান। এই সৃষ্টি নিপুনতায় মহান রবের প্রভুত্ব, শ্রেষ্ঠত্ব, বড়ত্ব প্রকাশ পায়। প্রতিপক্ষ, শত্রু থেকে বাঁচতে চাই মহা শক্তিমানের দয়া মায়া করুনার বদৌলতে।
এই কষ্ট ক্লেষ, প্রশান্তি সুখ বিপরিত ধর্মী জীবনের বাকে বাকে আমরা সহযোগিতা, চিকিৎসা, ঝাড়ফুঁক, আমালিয়াত, দান সাদাকা বিভিন্ন পথ গ্রহন করে থাকি বা সমম্বিত পথ অবলম্বন করে থাকি। এখানে কেউ ভুল পথে অগ্রসর হই। কেউ সঠিক পথ তালাশ করি। মহান রব এত দয়ালু, এত দয়া আর মমতায় ভরা যার তুলনা শুধু তিনি নিজেই। চিকিৎসাকে মহান রব অনেক সহজলভ্য করে দিয়েছেন। তবে আজকাল টাকা কামাইর ধান্ধা হিসেবে কিছু কিছু রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয় বহুল। এখানে সেবার চেয়ে ব্যবসা অর্থাৎ টাকা মুখ্য। মহান রব আমাদের জানা চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে ইউনানী, আয়ুর্বেদীক, এ্যালুপেথিক, হোমিওপেথিক, থেরাপি, আকুপ্রেশার, আকুপাংচার, সেরাজেম, ব্যায়াম, একক ভেষজ, সমম্বিত ভেষজ, কোরআন হাদিসের আমালিয়াত, ঝাড়ফুঁক, বিভিন্ন এলাকায় প্রচলিত টুটকা ইত্যাদি চিকিৎসার ব্যবস্থা দিয়েছেন। তাছাড়া রোগ শোক বালা মসিবতে দান সাদাকাও একটি বিপদ মুক্তির মহৌষধ।
মহান রব প্রত্যেক রোগের চিকিৎসা রেখেছেন। এটা মহান মালিকের কত বড় দয়া। কোন রোগীকে, কোন বিপদ গ্রস্থকে, কোন ব্যথাতুর হৃদয়কে একা ছেড়ে দেননি। তার চিকিৎসা তার শান্তনা, তার বিপদ মুক্তি সবকিছু তিনি রেখে দিয়েছেন। মুমিন ঔষধের ক্ষমতা, আমলের শক্তি, দানের সুফল এগুলোকে মহান রবের দেওয়া শক্তি বলে জানে এবং এগুলো ব্যবহারের সাথে সাথে মহান রবের উপর তাওয়াক্কুল বা ভরসা করে। সে বিশ্বাস করে আল্লাহর দেওয়া শক্তিতেই ঔষধ কাজ করে, ঝাঁড়ফুঁক কাজ করে, দান বালা মসিবত দুর করে সফলতা আনে, মহান রবের কালাম কোরআনের আয়াত ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিখানো দোয়া শান্তির সুবাতাস বইয়ে দেয়। এই বিশ্বাস আর মহান রবের উপর পরিপূর্ণ আস্থার কারনে রোগ মুক্তির সাথে সাথে, বিপদ দুরের সাথে সাথে তার ইবাদাতও হয়ে যায়। অনেক সওয়াব, অনেক বারাকাহ তার ভান্ডারে জমা হয়ে যায়। অপর দিকে যাদের আল্লাহতে বিশ্বাস নেই, বিশ্বাস থাকলেও তাঁর প্রতি তাওয়াক্কুল নেই। শুধু ঔষধের শক্তিতে বিশ্বাস রাখে, শিরক ও কুফুরী তন্ত্র মন্ত্রে বিশ্বাস রাখে তাদের সঠিক ঔষধে কাজ হয়। রোগ থেকে মুক্তি পায়। কিন্তু ঈমানদারদের মত তারা বোনাস পায় না। দ্বিতীয় সফলতা বা চুড়ান্ত সফলতা তারা পায় না।
ঈমানদার যেমন ঔষধের ক্ষেত্রে কোন হারাম উপাদান সম্বলিত ঔষধ, একান্তই অপারগ না হলে, কিংবা ইমানদার ডাক্তার পরামর্শ না দিলে ব্যবহার করতে পারেনা। তেমনি দোয়া কালামের নামে, কোরআনী তাবিজের নামে কোন শিরক, কুফরকারীর ঝাড়ফুঁক, তাবিজ কবজও একজন ইমানদার গ্রহন করতে পারে না। সে রোগে ভোগে নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু ইমানহারা হতে পারে না। ইমানদার রোগ থেকে মুক্তির জন্য একক চিকিৎসা বা সমম্বিত চিকিৎসা গ্রহন করবে। সে ঔষধ সেবন করবে, কোরআনী আমল করবে, নিজের তৌফিক অনুযায়ী দান সাদাকা করবে। অথবা তার মর্জি অনুযায়ী যে কোনটি গ্রহন করবে। সে একক চিকিৎসা গ্রহন করুক বা সমম্বিত চিকিৎসা গ্রহন করুক সর্বাবস্থায় তার একিন তার বিশ্বাস থাকবে মহান রবই আমার একমাত্র সহায়, আমার মুক্তিদানকারী, আমার রোগ নিরাময় কারী বাকি সবকিছু উছিলা মাত্র। সে হারাম, কুফর, শিরক কোনটির ধারে কাছেও যাবে না।
কোরআনী ইলম ও আমলের ঘাটতি আজ আমাদের সমাজে ব্যাপক। যে কেউ আমাদের ইমান নিয়ে খুব সহজে ছিনিমিনি খেলতে পারে। ইলম আর আমলের অভাবে দলাদলি, ছাড়াছাড়ি, বাড়াবাড়িরও অভাব নেই। দলাদলি, ছাড়াছাড়ি, বাড়াবাড়িতে আজ মুসলিম সমাজ নিমজ্জিত। মুহুর্তেই রেগে যাই। মুহুর্তেই ঠান্ডা হয়ে যাই। কি সে রাগলাম আর কি সে থামলাম উভয়টিই দুর্বোধ্য। কাউকে আল্লাহ ওয়ালা মানতেও আমাদের সময় লাগে না আবার কাউকে শয়তান বানাতেও সময় লাগে না। এর কারন কোরআনী ইলম ও আমল। সাহাবায়ে আজমাইন সুরা ফাতেহা পড়ে ফুঁক দেওয়ায় সাপে কাঁটা রোগী ভাল হয়ে যায়। রাসুল সাঃ এর উপর জাদুর আছর সুরা ফালাক নাসে দুর হয়ে হয়ে যায়। সুরা এই আয়াত পড়ে ফুঁক দেওয়ায় জ্বীনের আছরের রোগী ভাল হয়ে যায়। জ্বীন আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। আজ সে ঈমানী জযবা কোথায়? ফলে মুসলিম সমাজ অন্তর দৃষ্টি তথা আধ্মাতিকতা থেকে বঞ্চিত। আবার কেউ কেউ এমন আছি আধ্মাতিকতা বা হিকমাহ বা অন্তর দৃষ্টিকে ভন্ডামী বলি। হ্যা ভন্ডামি হলে ভন্ডামী বলবো। কিন্তু সবখানে এটা প্রযোজ্য নয়। স্থান কাল পাত্র ভেদে এই শব্দটি প্রয়োগ করতে হবে।
উপরের হাদিসগুলোর নির্দেশনা খুব ব্যাপক। একটি হাদিসের শেষাংশে বলা হয়েছে। যাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে, তিনি জেনে গেছেন। আর যাকে অজ্ঞ রেখেছেন তিনি মুর্খ থেকেছেন। আমাদের কোরআনী ইলমের ক্ষেত্রে অজ্ঞতা আর আমলের ক্ষেত্রে দৈন্যতা আমাদেরকে তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। আমলের দৈন্যতার কারনে আলেমগনের মধ্যে হিকমাহ তথা দুর দৃষ্টি পয়দা হচ্ছে না। আলহামদু লিল্লাহ আমলদার অনেক আলেম আছেন। কিন্তু মুসলিম জনসংখ্যার তুলনায় খুবই নগন্য। কোরআনের সাজে, কোরআনের রাজ কায়েম করতে হলে যেমন ময়দানে ইসলামী জযবা ওয়ালা লোক লাগবে। তেমনি কোরআনের সুফল সমাজে ব্যাপক ভাবে পেতে হলে ইলমের সাথে আমল ওয়ালা তথা হিকমাত ওয়ালা লোকের খুব বেশি প্রয়োজন। এমন লোক বেশি থাকলে মুসলিম সমাজ শিরক, কুফর, জাদুটোনা ইত্যাদি থেকে মুক্ত থাকবে। কোরআনী চিকিৎসায় তার রোগ ভাল হবে, ঈমান মজবুত হবে। কোরআনের দাওয়াত মানুষের দিলে দিলে পৌছে যাবে। মানুষ কোরআনকে এক জীবন্ত কিতাব হিসেবে দেখতে পাবে। এই কোরআনের আইনে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজে, দেশে, বিশ্বে শান্তি শৃংখলা বিরাজ করবে। কোরআনী আমলে সে দৈহিক, আত্মিক রোগ থেকে মুক্তি পাবে, তার আত্মা পরিশুদ্ধ হবে। জ্বীনেরা ক্ষতির চিন্তাও করবে না, বরং একে অপরের সহযোগী হবে। জাদু টোনা সমাজে থাকলেও জাদুকররা ভয়ের মধ্যে থাকবে। দুষ্টেরা থেমে যাবে। ভালরা এগিয়ে যাবে। মহান রব আমাদের সঠিক সমজ দান করুন। আমীন।
লেখক : শিক্ষাবিদ, ইসলামী চিন্তাবিদ, গবেষক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন