ওমরাযাত্রীদের বিমানের টিকিটের দাম দিনদিন আকাশচুম্বী হচ্ছে। ওমরাহ টিকিটের টাকা যোগাতে নাভিশ্বাস উঠছে যাত্রীদের। বিমান ও সাউদিয়া অ্যারাবিয়ান এয়ারলাইন্সের ওমরাহ টিকিটের মূল্য বৃদ্ধির কারণে ওমরাযাত্রী ও এজেন্সির মালিকদের মাঝে ভুল বুঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। এতে এই দুইটি এয়ারলাইন্সের পরিবর্তে থার্ড ক্যারিয়ার যোগে বর্তমানে ৮০% ওমরাযাত্রী সউদী যাচ্ছেন। ফলে ঢাকা-জেদ্দা, ঢাকা-মদিনা রুটে উল্লেখিত এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটগুলোতে অনেক সিট খালি যাচ্ছে। এতে অনেক টাকা গচ্চাও দিতে হচ্ছে এয়ারলাইন্স দুইটিকে।
ওমরাহ টিকিটে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হলে টিকিট সিন্ডিকেটের দৌরাত্ন্য নির্মূল করতে হবে। সিন্ডিকেট চক্রের দৌরাত্ন্য কমাতে না পারলে ওমরাহ টিকিটের দাম স্বাভাবিক পর্যায়ে আসবে না। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন। বিগত ৩১ জুলাই থেকে এ যাবত প্রায় ৪০ হাজার বাংলাদেশি ওমরাযাত্রী পবিত্র ওমরাহ পালন করেছেন। বৈশ্বিক করোনা মহামারির দরুণ বিগত দুই বছর ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা পবিত্র হজ ও ওমরাহ কার্যক্রম পালনের সুযোগ পাননি।
এদিকে, ঢাকা-জেদ্দা-মদিনা-ঢাকা রুটে বিমান ভাড়া অস্বাভাবিক বাড়ছে। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স ওমরাহ টিকিটের দাম ৮৫০ মার্কিন ডলারের স্থলে আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে ৯৫০ মার্কিন বাড়িয়েছে। বিমানকে অনুসরণ করে সাউদিয়া এয়ারলাইন্সও একই দিন থেকে ৮৫০ ডলার থেকে ৯৫০ ডলার ওমরাহ টিকিটের দাম বৃদ্ধি করেছে। এর সাথে ওমরাযাত্রীদের আরো ট্যাক্স গুনতে হবে প্রায় ১৪ হাজার টাকা। বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স গত ১ অক্টোবর থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ওমরাযাত্রীদের টিকিটের দাম দেড়শ’ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি করেছিল। এতে চড়া দামে বিমানের টিকিট কিনতে ওমরাযাত্রী ও মাধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মীদের চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হতে হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, ইতোপূর্বে পাঁচটি এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেয়ায় সিন্ডিকেট চক্র ওমরাহ টিকিটের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে চড়া দামে টিকিট বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল। বিমানের মতিঝিল অফিসের ম্যানেজার সেলস দেড় মাসের টিকিট নামে বেনামে সিন্ডিকেট চক্রের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল। এতে ওমরাহ এজেন্সির মালিকরা বিমান অফিসে ধর্না দিয়েও ওমরাযাত্রীদের টিকিট পেতে হিমসিম খেতে হয়েছে । আটাব ও হাব নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন, বিমানের দেড় মাসের ফ্লাইটগুলো যথাযথভাবে চেক করা হলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে। তারা ওমরাযাত্রীদের টিকিট সঙ্কট দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে সাউদী আরবের রুটে একাধিক অতিরিক্ত ফ্লাইট চালু এবং ওমরাহ এজেন্সিগুলোর কাছে সরাসরি টিকিট বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিতকরণে বিমান মন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
আটাবের উপ-মহাসচিব গোলাম মাহমুদ ভূঁইয়া মানিক গতকাল ইনকিলাবের সাথে আলাপকালে ওমরাহ টিকিটের মূল্য বৃদ্ধির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, বিমান ও সাউদিয়া এয়ারলাইন্স আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে ওমরাহ টিকিটের দাম আরো ১শ’ মার্কিন ডলার করে বাড়িয়েছে। সিন্ডিকেট চক্র এ দু’টি এয়ারলাইন্সের বর্ধিত মূল্যের ওমরাহ টিকিট কিনে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করছে। তিনি বলেন, ওমরাহ টিকিটের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আজ বুধবার ফ্লাইট দুবাই এয়ারলাইন্স যোগে গোল্ডেন হর্স এয়ার ট্রাভেলসের ৩০ জন ওমরাযাত্রী ৭৫ হাজার টাকায় টিকিট কিনে ট্রানজিট রুটে ওমরাহ পালনে সউদী যাচ্ছেন। আটাব নেতা ওমরাহ টিকিটের বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহার করে সহনীয় পর্যায়ে পুননির্ধারনে জোর দাবি জানান।
ইউরো এয়ার ইন্টারন্যাশনাল ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী ও কোবা হজ গ্রুপের চেয়ারম্যান মাওলানা মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান ওমরাহ টিকিটের মূল্য বৃদ্ধিতে তীব্র প্রতিবাদ ক্ষোভ প্রকাশ করেন, সিস্টেমে বিমানের ওমরাযাত্রীর কোনো সিট নেই। সিন্ডিকেট চক্র গ্রুপভিত্তিক ওমরাহ টিকিট ধরে রেখে চড়া দামে বিক্রি করছে। তিনি বলেন, জাতীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে অনুসরণ করে বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলো নতুনভাবে ওমরাহ টিকিটের দাম বাড়ানোর চিন্তাভাবনা করছে।
মাওলানা মাহমুদুর রহমান হজ টিকিটের ন্যায় ওমরাহ টিকিট এজেন্সিগুলোর কাছে সমহারে বিক্রি নিশ্চিতকরণ এবং ওমরাহ ফ্লাইট সঙ্কট নিরসনে দ্রুত জেদ্দা-মদিনা রুটে সিডিউল ফ্লাইট বৃদ্ধিসহ অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনার জোর দাবি জানিয়েছেন। তিনি ওমরাহ টিকিট সিন্ডিকেট নির্মূলে কার্যকরী উদ্যোগ নেয়ার জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানান। তিনি বলেন, বিমানে ওমরাহ টিকিট না পেয়ে আগামী ২৬ নভেম্বর কুয়েত এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট (কেইউ-২৮৪) যোগে ৬০ জন ওমরাযাত্রী এবং আজ বুধবার এ্যামিরেট ও গালফ এয়ার যোগে আরো ৭০ জন ওমরাযাত্রীকে ট্রানজিট রুটে সউদী আরবে পাঠাচ্ছি। এদের ভাড়া পড়ছে ৭৫০ মার্কিন ডলার। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মাঝখানে বিমান টিকিটের দাম কিছু কমালেও কোনো টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না।
মোস্তফা এয়ার ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী ও বাংলাদেশ হজযাত্রী ও হাজী কল্যাণ পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু দাউদ ফয়সাল গতকাল মঙ্গলবার ইনকিলাবকে বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই বিমান বিগত ১ অক্টোবর থেকে ওমরাহ টিকিটের দাম এক লাফেই ১৫ হাজার টাকা জনপ্রতি বৃদ্ধি করা ওমরাযাত্রীদের ওপর জুলুম করেছিল । তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়েনি সেক্ষেত্রে ওমরাহ টিকিটের মূল্য বৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ নেই। তিনি সাউদিয়া এয়ারলাইন্স ও বিমান কর্তৃপক্ষকে ওমরাহ টিকিটের বর্ধিত ভাড়া প্রত্যাহারের জোর দাবি জানান। ওমরাহ টিকিটের মূল্য সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনতে বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
বিমানের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে চিহ্নিত ট্রাভেল এজেন্সীগুলো গত ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত সকল টিকিট কিনে নিয়েছিল। এর আগেও সেপ্টেম্বর মাসের পুরো ওমরাহ টিকিট চিহ্নিত ট্রাভেল এজেন্সিগুলো কিনে নিয়ে যায়। ওমরাহ টিকিটের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করছে কতিপয় সিন্ডিকেট চক্র। সাউদিয়া এয়ারলাইন্সসহ বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের ওমরার গ্রুপ টিকিট কিনে চড়া দামে বিক্রি করছে কতিপয় চিহ্নিত ট্রাভেলস এজেন্সি। সিন্ডিকেট চক্র ওমরাযাত্রীদের কাছে ৫ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা অতিরিক্ত দামে টিকিট বিক্রি করে রাতারাতি কোটিপতি বনে যাচ্ছে। হাবের সাবেক এক শীর্ষ নেতা এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
তিনি ওমরাহ টিকিট সিন্ডিকেট চক্রের কবল থেকে রক্ষার জন্য উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন এবং দুদকের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। তিনি বলেন, টিকিটের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে এসব দেখার কেউ নেই। তিনি ওমরাযাত্রী ও বিদেশগামী কর্মীদের দুর্ভোগ লাঘবে অনতিবিলম্বে বিমান ভাড়া সহনীয় পর্যায়ে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেন। আটাব অনতিবিলম্বে নামহীন সকল অবৈধ টিকিট বাতিল করে এজেন্সির মাধ্যমে সিস্টেমেটিক বৈধ নামে টিকিট বিক্রিসহ ওমরাযাত্রীদের চাপ কমানোর লক্ষ্যে ঢাকা-জেদ্দা-ঢাকা রুটে অতিরিক্ত ফ্লাইট চালুর জন্য শিগগিরই বিমানের কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত চিঠি দিয়েছিল।
উল্লেখ্য, ২০২২ সালে করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ার ফলে ওমরা ও হজের অনুমতি দেয় সউদী সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে নানা শর্তও জুড়ে দেয়া হয়। এবার বাংলাদেশ থেকে বড় একটি অংশ হজে গেলেও ৬০ এর ঊর্ধ্বে যাদের বয়স হয়েছে, যাদের করোনা টিকার সনদ নেই, সর্বোপরি হজের টাকা আবাসিক খরচ ও বিমান টিকেটের দাম বৃদ্ধির ফলে অনেকে রেজিস্ট্রেশন করেও হজে যেতে পারেননি। ফলে ওমরা যাত্রী আগের যেকোন সময়ের চেয়ে কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আর অবস্থার সুযোগ নিচ্ছে বাংলাদেশ বিমান ও সাউদী এয়ারলাইন্স। অভিযোগ রয়েছে টিকিট সিন্ডিকেট চক্র ওমরা যাত্রীদের জিম্মি করে নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত টিকিট বিক্রি করছে। যাত্রী পরিবহনের ক্যাপাসিটির তুলনায় ওমরাযাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় সাউদিয়া এয়ারলাইন্স ও বিমান টিকিটের দাম বাড়াচ্ছে। টিকিটের সঙ্কট চরম আকার ধারণ করায় অনেক ওমরাযাত্রী বাধ্য হয়েই বিজনেস ক্লাসের টিকিট অতিরিক্ত টাকা দিয়ে কিনে ওমরায় যাচ্ছেন। এ সুযোগে সিন্ডিকেট চক্র বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকিট ব্লক করে রেখে চড়া দামে বিক্রি করছে।
বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের টিকিট অতিরিক্ত দিয়ে কিনতে ওমরাযাত্রীদের গলদঘর্ম। সিস্টেমে বিমানের ওমরাযাত্রীদের টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। আবার বেশি টাকা দিলে ওমরাহ টিকিট মিলছে। যথাসময়ে সাউদিয়া ও বাংলাদেশ বিমানের টিকিট না পেয়ে ওমরাযাত্রীরা চরম হতাশায় ভুগছেন। হাবের ইসি সদস্য মুফতি মুস্তাফিজুর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, বিমান ও সাউদিয়া আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে ওমরাহ টিকিটের আরো ১০০ মার্কিন ডলার বৃদ্ধি করেছে। এতে ওমরাযাত্রীরা বিপাকে পড়েছেন। ওমরাহ টিকিটের দাম আকাশচুম্বী হওয়ায় ৮০% ওমরাযাত্রী থার্ড ক্যারিয়ার যোগে সউদী যাচ্ছেন। এতে বিমান ও সাউদিয়ার ফ্লাইটের অনেক সিটই খালি যাচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন