মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশগুলোর বিমানের টিকিট নিয়ে হাহাকার চলছে। টিকিট সঙ্কটের অজুহাতে এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে দ্বিগুণ ভাড়া হাতিয়ে নিচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ না থাকায় এয়ারলাইন্সগুলো চড়া দামে টিকিট বিক্রি করে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। চারটি এয়ারলাইন্স ইতোমধ্যে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম বন্ধ করেছে। আরো দু’টি এয়ারলাইন্স শিগগিরই একটি করে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে দেবে। এয়ার টিকিট সঙ্কটের দরুন প্রায় ২০ হাজার ওমরাযাত্রীর ওমরাহ পালনে অনিশ্চয়তার আভাস পাওয়া গেছে।
টপ টেন নামক টিকিট সিন্ডিকেট চক্র কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে চড়া দামে টিকিট বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দ্বিগুণ ভাড়ার টিকিট কিনতে হাজার হাজার ওমরাযাত্রী ও বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীদের নাভিশ্বাস উঠেছে। এতে অভিবাসন ব্যয়ও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। টিকিটের অভাবে অনেক ওমরাযাত্রীর মাহে রমজানের শেষ দশ দিনে মক্কা-মদিনায় ইত্তেকাফ পালনেও অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। হাব সভাপতি এম শাহাদাত হোসাইন তসলিম সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে জানিয়েছেন, চলতি বছর থেকে সউদী সরকার সারা বছর (হজের এক সপ্তাহ বাদ দিয়ে) ওমরাহ ভিসা প্রদান করছে। গত ৮ মে পর্যন্ত বাংলাদেশের এক লাখ ৬২ হাজার ৫০৮ জনকে ওমরাহ ভিসা দিয়েছে। বিমানের টিকিট সঙ্কট অব্যাহত থাকলে চলতি রমজানে প্রায় ২০ হাজার ওমরাযাত্রী সউদী আরব যাওয়া থেকে বঞ্চিত হবেন। এতে ওমরাযাত্রীদের ভিসা ও হোটেল বাবদ খরচ হওয়া প্রায় ৯০ কোটি টাকা গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। টিকিট সঙ্কট দ্রুত নিরসনে হাব কর্তৃপক্ষ স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানিয়েছেন।
যথাসময়ে টিকিট না পাওয়ায় ভিসার মেয়াদও শেষ হয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন কর্মীর। টিকিট বিক্রির সিন্ডিকেট চক্র বিমান, সাউদিয়াসহ অন্যান্য এয়ারলাইন্সের টিকিট ব্লক করে রেখে চড়া দামে তা বিক্রি করে রাতারাতি কালো টাকার মালিক হচ্ছে। এয়ারলাইন্সের ভাড়া অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় ওমরাযাত্রীদেরও অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। টিকিট সঙ্কট নিরসনে আটাব কর্তৃপক্ষ ঢাকা বিমানবন্দরকে দ্রুত ওপেন স্কাই ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন।
সিভিল এভিয়েশনসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নীরব ভূমিকা পালন করায় এসব এয়ারলাইন্স আসন সঙ্কটের দোহাই দিয়ে প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যাচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে আসন্ন ঈদুল ফিতরে এ নিয়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে। আটাব সভাপতি মঞ্জুর মোর্শেদ (মাহবুব)-এর নেতৃত্বে আটাবের একটি প্রতিনিধিদল গত মার্চ মাসে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর সাথে দেখা করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তবমুখী উদ্যোগ নেয়ার অনুরোধ জানান। প্রতিমন্ত্রী এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাংলাদেশ থেকে পরিচালনাকারী মধ্যপ্রাচ্যগামী জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম, মদিনা, দুবাই দোহা, বাহরাইন মাস্কাট, কুয়েত, সারজাহসহ বিভিন্ন রুটে আসন সঙ্কট চরম আকার ধারণ করছে। এ আসন সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে এয়ারলাইন্সগুলো বিভিন্ন রুটের ভাড়া দ্বিগুণ করছে। এর ফলে সব চেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যগামী কর্মী ও ওমরাযাত্রীগণ। দ্বিগুণ টাকা খরচ করেও তারা অনেক সময়ে ফ্লাইটে সিট পাচ্ছেন না। যথাসময়ে কর্মস্থলে যেতে না পারার কারণে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীরা চাকরি হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। এ ছাড়া টিকিটের মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশ প্রচুর পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা হারাচ্ছে। পরিস্থিতি এমন দিকে গড়াচ্ছে যে, এসব বিষয় দেখার কেউ নেই।
ব্যবসায়িক লস হওয়ায় ইত্তেহাদ এয়ারওয়েজ, ফ্লাই দুবাই, ওমান এয়ার ও জেট এয়ারওয়েজ ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সপ্তাহে প্রায় ১ হাজার ক্যাপাসিটি লস হয়েছে। এমিরেটস এয়ারওয়েজ তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার কারণে আগামী ১৬ এপ্রিল থেকে বাংলাদেশে ফ্রিকোয়েন্সি কমিয়ে দিয়েছে। কাতার এয়ারওয়েজও সউদী আরবে ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারছে না। এতে এয়ারলাইন্সগুলোর টিকিট সঙ্কট দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিতে পারে। আবাবিল হজ গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. আবু ইউসুফ এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
তিনি বলেন, বর্তমানের ওমরাযাত্রীর সংখ্যা আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মাহে রজমানে ওমরাযাত্রীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। ঈদ উপলক্ষে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত কর্মীদের ভ্রমণ বেড়ে যাবে। মো. আবু ইউসুফ বলেন, এয়ারলাইন্সের টিকিট সঙ্কট চরম আকার ধারণ করায় অভিবাসী কর্মী ও ওমরাযাত্রীদের অতিরিক্ত টাকা দিয়েও টিকিট কিনতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে।
তিনি আল্লাহর মেহমান ওমরাযাত্রীদের সহজে ওমরা পালনের সুযোগ দেয়ার জন্য অবিলম্বে জেদ্দা-মদিনা রুটে বিমানের অতিরিক্ত ফ্লাইট চালু করে যাত্রীদের সেবা নিশ্চিতকরণের জোর দাবি জানান।
আটাব সভাপতি এস এন মঞ্জুর মোর্শেদ (মাহবুব) বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের রুটে বিভিন্ন এয়ারলাইন্স আসন সঙ্কটের সুযোগ দেখিয়ে ভাড়া প্রায় দ্বিগুণ আদায় করছে। এতে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী ও সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে সৃষ্ট সঙ্কট দ্রুত নিরসন এবং মধ্যপ্রাচ্যের রুটে অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনার উদ্যোগ নেয়ার জোর দাবি জানানো হয়েছে। বিমান মন্ত্রণালয় থেকে সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষকে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার নির্দেশ দেয়া হলেও সিভিল এভিয়েশন নীরব ভূমিকা পালন করছে।
এ দিকে, বিমান গতকাল থেকে ঢাকা-দিল্লি রুটে বিমানের ফ্লাইট চালু করেছে। কিন্ত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটে চাহিদা থাকা সত্তে¡ও অতিরিক্ত ফ্লাইট বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়নি।
বাংলাদেশ এয়ার ট্রাভেলসের স্বত্বাধিকারী ও হাবের ইসি’র সদস্য হাফেজ মাওলানা জাহিদ আলম এয়ারলাইন্সের টিকিট সঙ্কট দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে বিমানের লোকসান হয়, এমন রুটে ফ্লাইট অপারেশন সীমিত করে মধ্যপ্রাচ্যের রুটে ফ্লাইট বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন। তিনি এভিয়েশন সেক্টরে অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধে বিমানের রিজার্ভেশন ব্যবস্থা উন্মুক্ত রাখা এবং নজরদারি বাড়ানোর অনুরোধ জানান। গুটি কয়েক টিকিট বিক্রির সিন্ডিকেট চক্র (এজেন্ট) বিমানের টিকিট ব্লক করেও চড়া দামে টিকিট বিক্রি করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
ওই দিকে, অন্যান্য রুটে বিমান ভাড়া না বাড়লেও মধ্যপ্রাচ্যমুখী রুটে অস্বাভাবিক ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় স্থিতিশীল রাখা সম্ভব হচ্ছে না। বিএমইটির সূত্র জানায়, সরকার সউদী আরবে জনপ্রতি অভিবাসন ব্যয় ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা, মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ১ লাখ ৭ হাজার ৭৮০ টাকা, কুয়েতে ১ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা, ওমানে ১ লাখ ৭৮০ টাকা, বাহরাইনে ৯৭ হাজার ৭৮০ টাকা, সিঙ্গাপুরে ২ লাখ ৬২ হাজার ২০০ টাকা এবং ব্রুনাইয়ে ১ লাখ ২০ হাজার ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করেছে। কিন্ত বিমান ভাড়া দ্বিগুণ, গামকার অনুমোদিত সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফি ৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৮ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করায় অভিবাসন ব্যয় বেড়ে যাচ্ছে। এতে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অপর দিকে, গত ১০ মে থেকে সউদী থেকে ওমরাযাত্রীদের মোফা ইস্যু বন্ধ রয়েছে। এতে সাউদিয়া এয়ারলাইন্স ও বিমানের অনেক নির্ধারিত সিট বাতিল করতে হচ্ছে। সউদী সরকার ওমরাযাত্রী প্রতি জেদ্দা-মক্কা রুটে পরিবহন ভাড়া নতুন করে ১০৫ রিয়াল ধার্য করায় মোফা ইস্যু বন্ধ রাখা হয়েছে।
বায়রা সভাপতি বেনজীর আহমেদ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটে এয়ারলাইন্সের টিকিট সঙ্কটে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, সিন্ডিকেট চক্রের কারণে বিমানের টিকিটের দাম দ্বি-গুণ বাড়ছে। এতে বিদেশ গমনেচ্ছু কর্মীরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রুটে কয়েকটি এয়ারলাইন্স ঢাকা থেকে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। বিমান ভাড়া বৃদ্ধি রোধকল্পে ওপেন স্কাই নীতি দ্রুত ঘোষণা করতে হবে। বায়রা সভাপতি বলেন, বিমানের টিকিট সঙ্কট নিরসন করা সম্ভব না হলে শ্রমবাজারে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে। অনতিবিলম্বে মধ্যপ্রাচ্যমুখী বিমানের আসন সঙ্কট দ্রুত নিরসন ও অতিরিক্ত ভাড়া কমিয়ে আনা সম্ভব না হলে জনশক্তি রফতানি এবং রেমিট্যান্স আয়ের ক্ষেত্রে মারাত্মক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে বলেও বায়রা সভাপতি উল্লেখ করেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন