তারুণ্য একটি অদম্য শক্তি। একটি অপ্রতিরোধ্য ঝড়। একটি দৃপ্ত শপথ। একটি অপরাজেয় দুর্জেয় ঘাঁটি। তারুণ্য কারো বাঁধা মানতে চায় না। সে তার আপন গতিতে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। যৌবন যেমনি গড়তে জানে, তেমনি ভাঙতেও জানে। নদীর দু’পাড়ে উঁচু বাঁধ না দিলে আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে যেমন নদীর পানি দু’কূল প্লাবিত করে ফসলের ক্ষেতসহ বসতবাড়ি ভাসিয়ে নিয়ে যায়; যৌবন কালকে সুপথে নিয়ন্ত্রণ না করলে তেমনি যে কোন মুহূর্তে বিপথগামী হতে বাধ্য। পৃথিবীর ইতিহাসে প্রতিটি আন্দোলনের সাফল্যের পেছনে রয়েছে তরুণ সমাজের আত্মত্যাগ। আজ নৈতিকতা অবক্ষয়ের সময়ে আদর্শিক সমাজ গঠনে তরুণ প্রজন্মের করণীয় তুলে ধরার প্রয়াস পেলাম। তরুণদের রক্তের বিনিময়ে ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে অসংখ্য রাজ্যপালের রাজ্য সীমা। আজও ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে তরুণদের আত্মত্যাগের বহু স্মৃতি। যখন যুব সমাজ চরিত্রবান ও সঠিক জ্ঞানের অধিকারী হবে, তখন তারাই উম্মতের যাবতীয় দায়িত্ব গ্রহণ করবে, আল্লাহর দেয়া দ্বীনের প্রচার ও প্রসারে ঝাঁপিয়ে পড়বে এবং তারাই মানুষকে দ্বীনের প্রতি দাওয়াত দেবে। কারণ, আল্লাহ তা’আলা যুবকদের দৈহিক শক্তি, উদ্ভাবনী মেধা, চিন্তা ও গবেষণা করার যোগ্যতা বয়স্কদের তুলনায় অনেক বেশি দিয়েছেন। যদিও বৃদ্ধদের অভিজ্ঞতা, জ্ঞানের গভীরতা ও বুদ্ধিমত্তা যুবকদের চেয়ে অনেক বেশি অগ্রগ্রামী, কিন্তু দৈহিক ভাবে দুর্বল হওয়ায় এবং সাহসের অভাব থাকার কারণে শক্তিশালী যুবকরা যে সব কাজ আঞ্জাম দিতে পারে তা আঞ্জাম দেয়া বৃদ্ধদের দ্বারা সম্ভব নয়। তাই নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ষোল বছর বয়সে তরুণদের নিয়ে গঠন করেছিলেন জনকল্যাণমূলক সংগঠন “হিলফুল ফুযুল”। তিনি যখন দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে মাঠে নামেন সর্বাগ্রে তরুণরাই এগিয়ে এসেছিলেন। হযরত ছিদ্দীকে আকবর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু, ফারুকে আযম রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু যৌবনেই ইসলাম কবুল করেন। তিনি মুসলমান হওয়ার আগ পর্যন্ত হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সঙ্গীরা অত্যন্ত সংগোপণে দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছিলেন। অন্যদের সাথে স্বয়ং হযরত ওমরও ছিলেন ইসলাম ও মুসলমানদের ঘোর শত্রু। নাঙ্গা তরবারী নিয়ে যে ওমর নবীজির শিরচ্ছেদ করতে পাগলের মত ছুটে গিয়েছিলেন, সেই ওমরই আল্লাহর অশেষ রহমতে যখন মুসলমান হয়ে গেলেন তখন থেকেই প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার শুরু হয়ে গেল। হযরত ওমর ইবনুল খাত্তাব রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু সহ মোট চল্লিশ জনের ছোট্ট একটি মুসলিম কাফেলা মক্কার অলিতে-গলিতে মিছিল বের করল। উন্মুক্ত তরবারী হাতে মিছিলের প্রথম কাতারে মহাবীর ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু। ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বণীতে মক্কার আকাশ-বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। কাবা প্রাঙ্গণে গিয়ে মিছিল শেষ হল। সকলে একসাথে সালাত আদায় করলেন। ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীর নেতৃত্বে ওমরকে দেখে কুরায়েশ যারপরনাই বিস্মিত-হতভম্ব হল। তাদের ক্রোধান্বিত অবস্থা দেখে ওমর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘সাবধান! কোন মুসলমানের কেশাগ্র স্পর্শ করলে ওমরের তরবারী আজ থেকে তোমাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হবে’। হযরত সুহায়িব বিন সিনান রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তিনি ইসলাম গ্রহনের পর আমরা খানায়ে কাবার পাশে জটলা করে বসতাম, কাবা শরীফের তাওয়াফ করতাম, আমাদের সাথে কেউ রূঢ় ব্যবহার করলে তার প্রতিশোধ নিতাম এবং আমাদের উপর আগুন্ত যে কোন আক্রমণ প্রতিহত করতাম। (তাবাকাতে ইবনে সাদ,৩/২৬৯) আসহাবে কাহাফে যারা ছিলেন তাঁরাও তরুণই ছিলেন । এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহ তাআলা পবিত্র কুরআনুল করিমে ইরশাদ করেন, “হে নবী (অদৃশ্যের সংবাদদাতা) ! আপনার কাছে আমি তাঁদের (আসহাবে কাহাফ)- ইতিবৃত্ত সঠিকভাবে বর্ণনা করেছি, তাঁরা ছিলেন কয়েকজন তরুণ। তাঁরা তাদের পালনকর্তার প্রতি ঈমান আনয়ন করেছিলেন এবং আমি তাঁদেরকে সৎপথে চলার শক্তি বৃদ্ধি করে দিয়েছি। (সূরা কাহাফ, আয়াত: ১৩) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতিটি কথা ও কাজের ধারক-বাহকের দায়িত্ব পালন করে ইসলামকে যারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে পৌঁছিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের অগ্রযাত্রায় রয়েছেন এক ঝাঁক তরুণ সাহাবী। তন্মধ্যে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আবদুল্লাহ ইবনে ওমর, আবদুল্লাহ ইবনে আমর ইবনুল আস, মুয়ায ইবনে জাবাল, যায়েদ ইবনে সাবেত, খালেদ ইবনে ওয়ালিদ ও মুসান্নাহ ইবনে হারেসাহ রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম প্রমুখ যুবক সাহাবীদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁরা সবাই ছিলেন তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে ঐক্যবদ্ধ ও সংঘবদ্ধ একটি জাতি। তাঁরা দ্বীনকে পৌঁছানোর গুরু দায়িত্ব পালন ছাড়াও দেশ, জাতি ও সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং তারা তাদের উপর অর্পিত স্বীয় দায়িত্ব পালনে কোন প্রকার অবহেলা প্রদর্শন করেননি। আজকের যুবকরাও যখন সৎ ও ভাল কর্ম করবে, তারা তাদের মর্যাদা ও অবস্থান সম্পর্কে অবগত হবে এবং তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব ও আমানত আদায় করবে, তারা তাঁদেরই উত্তরসূরি হবে এবং তাদের নামও ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এ কারণেই হুযূর পুরনূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, “মহান আল্লাহ তায়ালা কিয়ামতের দিন হাশরের ময়দানে আপন আরশের ছায়ার নিচে ঐ তরুণদেরকে বসার সুযোগ দিবেন, যারা তারুণ্যের সময়কে আল্লাহর পথে অতিবাহিত করেছেন”। (সহিহ বুখারী; সহিহ মুসলিম; মিশকাতুল মাসাবীহ)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যুবসমাজকে নিজেদের জীবন সাজাতে বিভিন্ন দিক- নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুকে ইরশাদ করেন- “হে বৎস! আমি তোমাকে কয়েকটি বাক্য শিখিয়ে দেব, তুমি আল্লাহর হিফাযত কর (হক্কুল্লাহ আদায় কর), আল্লাহ তায়ালা তোমাকে হিফাযত করবেন এবং তুমি তাঁকে তোমার সম্মুখে দেখতে পাবে। যখন তুমি কিছু চাও আল্লাহর কাছে চাও। আর যখন সাহায্য চাও আল্লাহর কাছে চাও। (জামে তিরমিযী) হযরত ওমর ইবন আবু সালমা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা যখন আমি হুযূর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে খাবার খাচ্ছিলাম এবং হাতকে প্লেটের সব জায়গায় ঘোরাচ্ছিলাম, তখন নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার হাত ধরে ফেলেন এবং আমাকে সম্বোধন করে বলেন- “হে বৎস! খাওয়ার শুরুতে বিসমিল্লাহ পড়, ডান হাত দিয়ে খাও এবং তোমার সামনের অংশ থেকে খাও। এর পর থেকে সারা জীবন এ নিয়মই ছিল আমার খাদ্য গ্রহণের নিয়ম।” (সহিহ বুখারী; সহিহ মুসলিম)
নেককার স্ত্রী গ্রহণের গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তরুণদের নেককার স্ত্রী গ্রহণ করার প্রতি অধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। কারণ, স্ত্রীগণ হল-সন্তান উৎপাদনের উৎস এবং ফলাফল লাভের যথাযথ স্থান। নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- “তুমি দ্বীনদার নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করে বিজয়ী হও, তোমার হাত বরকতময় হোক। কারণ, নেক স্ত্রী থেকে যখন আল্লাহ তোমাকে সন্তান দান করবে, সে তোমার সন্তানদের সঠিক দিক নির্দেশনা দেবে এবং বাল্য কাল থেকেই তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালনা করবে। -( সহিহ বুখারী; সহিহ মুসলিম)
আল্লাহ তা’আলা একজন যুবককে তার মাতা-পিতা বা তাঁদের উভয়ের মধ্যে জীবিত যে কোন একজনের প্রতি ভালো ব্যবহারের নির্দেশ দেন। আর তাকে স্মরণ করিয়ে দেন- তুমি যখন ছোট ছিলে, তখন কীভাবে তোমার মাতা-পিতা তোমাকে লালন-পালন করেছিল। ইরশাদ করেন- “ আর তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদাত করবে না এবং পিতা-মাতার সাথে সদাচরণ করবে। তাঁদের একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার নিকট বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাঁদেরকে ‘উফ’ বলো না এবং তাঁদেরকে ধমক দিও না। (চলবে)
লেখক: আরবী প্রভাষক, রাণীরহাট আল আমিন হামেদিয়া ফাযিল মাদ্রাসা,খতিব,রাজানগর রাণীরহাট ডিগ্রি কলেজ মসজিদ,রাঙ্গুনিয়া, চট্টগ্রাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন