শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

শিক্ষাঙ্গন

মুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

| প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

জুয়েল আক্তার : বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সন্দেহাতীতভাবে সর্বাগ্রে। এখানকার অকুতোভয় ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন। প্রাণপণে রুখেছেন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। জীবন বিলিয়ে দিয়েছেন অকাতরে। শহীদ হয়েছেন হাসতে হাসতে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত থেকে শুরু করে স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক ও বিভিন্ন পদ মর্যাদার অসংখ্য কর্মকতা-কর্মচারী পাকবাহিনীর হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন। এদের মধ্যে যাদের নাম পরিচয় পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে শিক্ষক রয়েছে ১৯ জন, ছাত্র ১০১ জন, কর্মকর্তা একজন ও কর্মচারী ২৮ জন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহুসংখ্যক ছাত্র-শিক্ষক শহীদ হলে সারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নেমে আসে মৃত্যুর হিম শীতল নীরবতা। এ দুর্দিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক এগিয়ে আসেন। যেসব শিক্ষক তাদের মনোবল না হারিয়ে শহীদ পরিবারের জন্য এগিয়ে আসেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলো অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহম্মেদ, মোঃ আবুল খায়ের, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম খান, অধ্যাপক ফজলুর রহমান খান প্রমুখ। অসহায় ও বিপন্ন পরিবারের জন্য অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ সরবরাহের ও সংগ্রহের কাজে তারা নিজেদেরকে আত্মনিয়োগ করেন। যুদ্ধের সময় ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য আশ্রয় নেন পুরনো ঢাকায়। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্দেশ মানতে গিয়ে ২১ এপ্রিল ১৯৭১ তার বিভাগে পুনঃযোগদান করতে বাধ্য হন। তারপর তিনি তার পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইশা খাঁ রোডের ৩১ নং বাসায় চলে আসেন। এ সময় বাধ্যতামূলকভাবে তিনি পরিচয়পত্র সংগ্রহ করেছিলেন। রাস্তাঘাটে চলতে মাঝে-মধেই সেনাবাহিনীকে দেখাতে হত এ পরিচয়পত্র। পরিচয়পত্রে লেখা থাকত পরিচয় পত্রধারী পাকিস্তানের অনুগত নাগরিক। কিন্তু এসব করেও শহীদ ভট্টাচার্যসহ অনেক শিক্ষকের শেষ রক্ষা হয়নি। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় একদল রাজাকার-আলবদর বাহিনী অধ্যাপক ভট্টাচার্যকে টেনে-হিঁচড়ে বাসার ওপর থেকে নিচে নামিয়ে আনেন। নিচে নেমে অপেক্ষমান গাড়িতে চোখ বাঁধা অবস্থায় দেখতে পান অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন ও আবুল খায়েরকে। অধ্যাপক সন্তোষচন্দ্রকেও চোখ বেঁধে গাড়িতে উঠানো হলো। এরপরের ঘটনা সবারই অজানা। শোনা যায়, নির্মম অত্যাচারের মাধ্যমে ১৪ ডিসেম্বর বহুসংখ্যক বুদ্ধিজীবীর সাথে তাদেরকেও হত্যা করা হয়।
 (সূত্র : ইতিহাস বিভাগ ঢাঃ বিঃ) মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান সম্পর্কে পটুয়াখালি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. শামসুদ্দীন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি পর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ ভূমিকা ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেজন্য এখানে পাকিস্তানি আক্রমণ হয় মারাত্মক। ছাত্রদের ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় গণহত্যা চালান হয়। গোটা নয় মাস জুড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল হুমকির মুখে। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থার বর্ণনা করতে গিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. মো. হারুন অর রশিদ বললেন. ‘হানাদারবাহিনীর প্রকৃতি দেখে স্বাভাবিকভাবে যা দেখা যায় তাহলো তাদের আক্রমণের কেন্দ্রস্থল ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম রাতে (২৫ মার্চ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকজন ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীকে তারা হত্যা করে। এরপরেও তারা অনেক সংখ্যককে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালায় কিন্তু ব্যর্থ হয়। তারা প্রথমে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ইকবাল হল (সূর্যসেন হল) ও জগন্নাথ হলে আক্রমণ চালায় এবং বেশ কয়েকজন ছাত্র, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে হত্যা করে। তারা কলা ভবনের সামনের বটগাছটি উপড়ে ফেলে। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিলপত্রাদি পুড়িয়ে নষ্ট করে দেয়। সেদিনের ভয়াবহ অবস্থা আঁচ করতে পেরে যদি ছাত্র-শিক্ষকরা সরে না যেত, তবে আরো অনেকে হত্যাকা-ের শিকার হত।’ মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা সম্পর্কে ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক এএইচ আহমেদ কামাল বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকরা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল। তবে চাঁদের যেমন কলঙ্ক থাকে তেমনিভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও কলঙ্ক ছিল। কারণ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতেগোনা কিছু ছাত্র-শিক্ষক সেদিন পাকবাহিনীর হাতে হাত মিলিয়েছিল। কিন্তু তারা সফল হয়নি। কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো ভাইস-চ্যান্সেলর প্রফেসর ড. মো. শাহিনুর রহমান বললেন- মুক্তিযুদ্বে ঢাবির ভূমিকা সম্পর্কে বলেন, সামরিক বাহিনী জুন মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিয়েছিল কিন্তু ছাত্র-ছাত্রী ক্লাসে আসেনি। ঢাকায় অবস্থানরত শিক্ষকরা ক্লাস নিতে আসত কিন্তু তাদের সবারই সক্রিয় সমর্থন ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। যে কারণে ১৪ ডিসেম্বর দ্বিতীয় হত্যাকা- ঘটেছিল ফলে আবার বেশকিছু শিক্ষক তাদের হাতে নিহত হয়। তিনি আরো জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদদের স্মৃতিকে ধরে রাখতে স্থাপন করা হয়েছে নামফলক ও স্মৃতিস্তম্ভ। এসব নামফলক ও স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে সময় লেগেছে ২৪ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের মূল ফটকের সামনে যে সবুজ চত্বরটি রয়েছে তার একেবারে মূল রাস্তার দিকের অংশে রয়েছে শহীদ ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীদের একটি নামফলক। মধুর ক্যান্টিনের সামনেই রয়েছে মধুদার স্মৃতি ভাস্কর্য। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অর্থাৎ ফুলার রোডের সংযোগস্থলে রয়েছে শহীদ স্মৃতিসৌধ বেদি। মধুর ক্যান্টিনের একটু পূর্বদিকে রয়েছে কালো টিনের ওপর সাদা অক্ষরে লেখা শহীদদের নামফলক। জগন্নাথ হলের মন্দিরের কিছু দূরেই আছে শহীদদের নামফলক। শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের গেটে আছে একটি শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। এসব স্মৃতিস্তম্ভ ও নামফলক চিরদিন দাঁড়িয়ে থাকবে। আর বাঙালি জাতি এদের স্মরণ করবে চিরকাল। শিক্ষার্থীরা মনে রাখবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান। শুধু তাই নয়, শহীদদের স্মৃতিকে অমর করে রাখতে গঠন করা হয়েছে শহীদ গিয়াসউদ্দীনের নামে একটি ট্রাস্ট ও ১টি শহীদ স্মৃতি পাঠাগার, গবেষণাগার। বিভিন্ন স্মারক বৃত্তি ইত্যাদি

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
Mehadi Hasan ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭, ২:৫৫ পিএম says : 0
খুবই ভাল লিখেছেন প্রিয় জুয়েল ভাই
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন