ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) ছাত্রলীগের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আজ শেষ হবে শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের দীর্ঘ নেতৃত্ব। গঠিত হবে নতুন নেতৃত্ব। ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ১ বছর মেয়াদি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নেতৃত্বে এসে ৪ বছরের অধিককাল ধরে ছিলেন এই দুই নেতা। নেতৃত্বে আসার ৮ মাস পর শাখা ছাত্রলীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ করেন তারা। মেয়াদ শেষ হওয়ার আড়াই বছর পর গঠন করে হল কমিটি। এবং সেগুলো পূর্ণাঙ্গ করতে শুরু করে আরো ৮ মাস পর। কিছু হলে এখনো কমিটি দেয়া বাকি। দীর্ঘ এ সময়ে নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে আলোচনায় এসেছেন এই দুই নেতা।
নানাভাবে বিতর্কিত নেতাকর্মীদের হল কমিটিগুলোতে পদায়ন, বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা, বিরোধী মতাদর্শের ছাত্র সংগঠনগুলোকে দমন-পীড়ন, কেন্দ্রীয় নেতাকে মারধর, ক্ষমতার স্থায়ীত্ব ধরে রাখতে কমিটি আটকে রাখা, নানা অজুহাতে দীর্ঘ সময় ধরে সংগঠনের কাজে নিষ্কিয় থাকা ও রাষ্ট্রবিরোধী সংগঠনের প্রার্থনালয় নির্মাণের অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
সনজিত চন্দ্র দাস এক বছরের কমিটিতে সভাপতি হিসেবে চার বছর ধরে আছেন। দীর্ঘ এ সময়ের অধিকাংশ সময়ই তিনি নানা অজুহাতে সংগঠনের কার্যক্রম থেকে নিষ্কিয় ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক মানবসম্পদ বিষয়ক উপসম্পাদক শামীম আহম্মেদকে মারধর করা হয় তার নির্দেশে। চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের ক্রীড়া সম্পাদক মো. আল আমিন সিদ্দিককে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও দেখে নেয়ার হুমকি, ১৫ এপ্রিল সম্ভাব্য মোটরসাইকেল দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার উপস্থিতিতে এক বহিরাগত শিক্ষার্থীকে মারধর, ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি রুহুল আমিনকে মারধর, জগন্নাথ হলে ইসকন মন্দির প্রতিষ্ঠা, ওই হলের কমিটিতে বিতর্কিতদের পদায়ন করা ও প্রটোকল হারানোর ভয়ে হল কমিটি গঠনে বিলম্ব করাসহ নানান অভিযোগ রয়েছে সনজিতের বিরুদ্ধে।
জানা যায়, ২০১৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক শিক্ষার্থী এহসানকে মারধর করে হাসপাতালে পাঠায় হল ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক ওমর ফারুক, রুহুল আমিন, সদস্য সামিউল ইসলাম সামী, আহসান উল্লাহ, উপ সম্পাদক মেহেদী হাসান হিমেল। এ ঘটনায় ওই মাসের ২৮ তারিখ সিন্ডিকেটের এক সভায় তাদেরকে ওমর ফারুককে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী ও বাকিদের দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। প্ররোচনার দায়ে হল শাখার সহ-সভাপতি আরিফকে এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
এদিকে গত ১৪ অক্টোবর রাতে সলিমুল্লাহ মুসলিম হল শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা হলে এতে দেখা যায় সহ-সভাপতি, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকের মতো বড় বড় পদগুলোতে বহিষ্কৃত এসব নেতাকর্মীকে পদায়ন করা হয়। সনজিত-সাদ্দামের স্বাক্ষরিত প্যাডে তাদের এসব পদে পদায়ন করা হয়।
২০১৮ সালে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত শেখ মারুফ হোসেন সুজনকে করা হয়েছে সূর্যসেন হলের সহ-সভাপতি। একই পদে পদায়ন করা হয় নারী হেনস্তার দায়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কৃত মাহমুদ অর্পণকে। ছিনতাই মামলার আসামী আয়ান হোসেন জজকে করা হয় বিজয় একাত্তর হলে সহ-সভাপতি। একই অভিযোগে অভিযুক্ত আরেক ছাত্রলীগ কর্মী তুষার হোসেন পেয়েছেন সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সহসভাপতির পদ। এরকম অসংখ্য বিতর্কিত নেতাকর্মীদের দিয়ে গঠন করা হয়েছে হল কমিটিগুলো।
এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঘোষিত ঢাবির ১৮ টি হলের ৯টি হলে সভাপতি কিংবা সাধারণ সম্পাদক পদে নিজ এলাকা ময়মনসিংহ থেকে নেতা বানিয়েছেন সনজিত। এছাড়া অধিকাংশ হলের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ময়মনসিংহের শিক্ষার্থীদেরকে পদায়ন করার জন্য কমিটি আটকে রাখেন তিনি। তাদেরকে হল কমিটিতে না রাখলে কমিটির অনুমোদন দিতেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবর ও ছাত্রলীগ নেতাদের দেয়া তথ্য বিশ্লেষণে জানা যায়, সনজিত-সাদ্দামের সময়ে ক্যাম্পাসে বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও হলে হলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উপর সবচেয়ে বেশি হামলা করা হয়। ঢাবি শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত একটি মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা স্টুডেন্ট এগেইনেস্ট টর্চার বলছে চলতি বছরে মাত্র পাঁচ মাসেই ২১ জন শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসব নির্যাতনে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা যার অধিকাংশই ছিল শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের অনুসারী।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে টিএসসিতে ছাত্র অধিকার পরিষদ আয়োজিত কাওয়ালি গানের আসরে ব্যাপক ভাঙচুরের অভিযোগ উঠে সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে। এর আগে ২০২০ সালের মার্চ মাসে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এক বৃহৎ কর্মসূচিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে তৈয়ব নামের এক ব্যবসায়ীর মাইক, সাউন্ডবক্সসহ প্রায় ৮ লাখ টাকার জিনিস নষ্ট হয়, যার জন্য তিনি দায়ী করেন সাদ্দাম হোসেনকে। তার পাওনা টাকা দিবে দিবে করে এখনো দেয়নি সাদ্দাম। ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ভবনের ভেতরে হামলার শিকার হন তৎকালীন ভিপি নুরুল হক নূর ও তার অনুসারীরা। এ ঘটনায় সনজিত চন্দ্র দাস ও সাদ্দাম হোসাইনসহ ৩৭ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসাইন। এছাড়া বিগত কয়েক দিনে একের পর এক ইনস্টিটিউট, অনুষদের কমিটি ঘোষণা করা হচ্ছে। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সম্মেলনের মাধ্যমে এসব কমিটির বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা করা হয়নি। ঢাবি ছাত্রলীগের হল সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকদের অভিযোগ, হল কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে গড়িমসি করা ছিল তাদের সাংগঠনিক অক্ষমতার প্রকাশ। দীর্ঘ এ সময়জুড়ে নানা কর্মকাণ্ডে বিতর্ক তৈরি করে গণমাধ্যম এড়িয়ে চলার অভিযোগ রয়েছে সনজিতের বিরুদ্ধে। ছাত্রলীগের কিছু নেতার দাবি জবাবদিহিতার ভয়ে তিনি এ কাজ করে থাকেন।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি সনজিত চন্দ্র দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনকে একাধিকবার ফোন দিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন