‘প্রতিবন্ধীরা সমাজের বোঝা নয় সম্পদ’ এ স্লোগান সর্বোত্রই উচ্চারিত হয়ে থাকে। প্রতিবন্ধীদের পাশে দাঁড়াতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বহুবার সমাজের বিত্তবানদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। অথচ প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা সংক্রান্ত প্রস্তাবিত একটি আইন দীর্ঘ ৯ বছর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বন্দি (আটক) রয়েছে।
জানা গেছে, প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষায় ২০১৩ সালে আইন এবং এ বিষয়ে একাধিক নীতিমালা করা হয়। সেই আইনে প্রতিবন্ধীদের কল্যাণে ফাউন্ডেশনের নাম পরিবর্তন করে প্রতিবন্ধী অধিদফতর করার প্রস্তাব করা হয়। সেই প্রস্তাব দীর্ঘ ৯ বছর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ফাইল চাপা পড়ে রয়েছে। তবে প্রতিবন্ধী অধিদফতর গঠনের প্রস্তাব থেকে সরে আসছে সরকার। সে কারণে এবার ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আদলে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন করা হচ্ছে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের জন্য জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের আইনগত ভিত্তি অধিকতর শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়েছে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় আইনের খসড়া তৈরি করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দিয়েছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন আইন, আগামী মন্ত্রিসভার বৈঠকে আইনটি পাস হওয়ার কথা রয়েছে বলে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমে প্রতিবন্ধিকতা বিষয়ক পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্তকরণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রতিবন্ধিকতা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সরকারি আদেশ মোতাবেক পরিচালনা করার ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে।
১৯৯৯ সালের ১৬ নভেম্বর সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় প্রজ্ঞাপণ জারি করে জাতীয প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। এই আইনের অধীনে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে গণ্য হবে। খসড়ায় বলা হয়, ফাউন্ডেশন একটি সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হবে এবং একটি সাধারণ সিলমোহর থাকবে। এই আইন ও তদধীন প্রণীত বিধির-বিধান সাপেক্ষে, ইহার স্থাবর ও অস্থাবর উভয় প্রকার সম্পত্তি অর্জন করার, অধিকারে রাখার এবং হস্তান্তর করার ক্ষমতা থাকবে এবং ফাউন্ডেশন তার নিজ নামে মামলা দায়ের করতে পারবে এবং উক্ত নামে এর বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা যাবে। ফাউন্ডেশনের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় থাকবে।
ফাউন্ডেশনের দায়িত্ব ও কার্যাবলিতে বলা হয়, ফাউন্ডেশন প্রয়োজন বোধে, সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে, বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে শাখা কার্যালয় স্থাপন করতে পারবে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সুরক্ষাসহ তাদের অধিকার, মর্যাদা, কল্যাণ, সুরক্ষা এবং সামাজিক কর্মকাণ্ডে পূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ নিশ্চিতকরণ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা প্রদানের জন্য তাহাদের চিহ্নিত ও শনাক্তকরণের জরিপ পরিচালনা ও প্রতিবন্ধিকতা বিষয়ক সকল কার্যক্রম পরিচালনা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়ন ও সেবা সংক্রান্ত সরকারি বা বেসরকারি যেকোনো কার্যক্রমে কারিগরি সহায়তা ও সহযোগিতা প্রদান। প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের থেরাপি এবং পুনর্বাসনের সুবিধা প্রদান। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার, মর্যাদা, জীবনমান উন্নয়ন, কল্যাণ ও সুরক্ষা সংক্রান্ত সকল বিষয় বাস্তবায়নের নিমিত্তে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রতিবন্ধী সংক্রান্ত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবসসমূহ উদযাপন এবং উক্ত দিবসসমূহ উদযাপন সংশ্লিষ্ট সকলকে উৎসাহিতকরণ। প্রতিবন্ধিকতার কারণ ও উক্ত কারণসমূহ নিরসন ও দূরীকরণ সংক্রান্ত গবেষণা ও উক্ত গবেষণার ফলসমূহ ব্যাপক প্রচার নিশ্চিতকরণ। প্রযোজ্যতা অনুযায়ী প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান স্থাপন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা ও উন্নয়নের স্বার্থে সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের সহিত যৌথভাবে কার্যক্রম গ্রহণ ও উহার সম্প্রসারণ। গণসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সর্বস্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রমে প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক পাঠ্যক্রম অন্তর্ভুক্তকরণে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ এবং প্রতিবন্ধিতা সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ সরকারি আদেশ মোতাবেক পরিচালনা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের সেবা ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি ও প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দারিদ্র্য হ্রাস ও কর্মসংস্থানের জন্য আর্থিক অনুদান ও সহায়ক উপকরণ সরবরাহসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ।
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য বিভিন্ন সেবা ও উন্নয়নমূলক কার্যক্রম গ্রহণ এবং উহার বাস্তবায়ন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য প্রণীত কর্মপরিকল্পনার সহিত সংগতিপূর্ণ অংশ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র পরিচালনা এবং সরকারের পূর্বানুমোদনক্রমে কেন্দ্র সম্প্রসারণ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন। জাতীয় সমন্বয় কমিটি ও জাতীয় নির্বাহী কমিটি কর্তৃক অর্পিত দায়িত্ব ও কার্যাবলি বাস্তবায়ন। জেলা ও উপজেলার কেন্দ্রে স্পেশাল স্কুল ফর চিলড্রেন উইথ অটিজম কর্নার পরিচালনা। জেলা ও উপজেলার কেন্দ্রে বঙ্গবন্ধু জিমনেশিয়াম কর্নার স্থাপন ও পরিচালনা। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদানুযায়ী বিভিন্ন ধরনের সহায়ক উপকরণ বিনামূল্যে বিতরণ ও প্রয়োজনে কারখানা স্থাপন। গুরুতর প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের দৈনন্দিন কার্যক্রম এবং কর্মসংস্থানে কেয়ার গিভার সার্ভিস প্রদান। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কর্মসংস্থানের জন্য কোটা পূরণে ভূমিকা পালন। প্রতিবন্ধিতাবিষয়ক কার্যক্রমে সংশ্লিষ্ট সংগঠনসমূহকে প্রয়োজনে সহায়তা প্রদান। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের থেরাপিউটিক চিকিৎসা সেবা, কাউন্সেলিং, অ্যাসেসমেন্ট এবং রেফারেল সার্ভিস প্রদানের লক্ষ্যে প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপনের পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উন্নয়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রম গ্রহণ। একীভূত শিক্ষা এবং অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের কল্যাণ ও উন্নয়নে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নির্দেশনা বাস্তবায়ন এবং সরকার কর্তৃক সময়ে সময়ে অর্পিত অন্যান্য দায়িত্ব পালন। বয়স ও সময় নির্বিশেষে সকল গুরুতর প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রতিবন্ধী নিবাস চালুকরণ। চাকরিপ্রত্যাশী ও চাকরিরত সকল প্রতিবন্ধী ব্যক্তির স্বল্পখরচে আবাসন সুবিধার ব্যবস্থাকরণ। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আইনগত সহায়তা প্রদান। বয়স নির্বিশেষে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের শৈল্পিক বা সাংস্কৃতিক প্রতিভার বিকাশ, বিনোদন ও তথ্য প্রচারের উদ্দেশ্যে বেতার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র এবং গণ-যোগাযোগ মাধ্যমসমূহে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ। স্পেশাল অলিম্পিক, প্যারা অলিম্পিক এবং অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য ক্রীড়া ও শরীরচর্চা বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা। সরকারি-বেসরকারি দফতরে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রবেশগম্যতা নিশ্চিতকরণ।
পরিচালনা বোর্ড গঠনের প্রস্তাবণায় বলা হয়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব হবেন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান। সমাজসেবা অধিদফতরের ডিজি, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক-১, অর্থ বিভাগ, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ, কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, স্বাস্থ্যশিক্ষা বিভাগ, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা বিভাগ, আইসিটি বিভাগ, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণ পূর্ত মন্ত্রণালয় থেকে একজন করে যুগ্মসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা, নিউরো ডেভেলপমেন্টাল প্রতিবন্ধী সুরক্ষা ট্রাস্টের এমডি জাতীয় সমাজকল্যাণ পরিষদের নির্বাহী সচিব, জাতীয় অর্থপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক, প্রতিবন্ধীদের সেবা ও সুরক্ষায় নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে তিন জন প্রতিনিধি ফাউন্ডেশনের সদস্য হবেন। জাতীয় প্রতিবন্ধি উন্নয়ন ফাউন্ডেশনের এমডি হবে সদস্য সচিব।
উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রস্তাবে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী, স্বাস্থ্যমন্ত্রী, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়ে সরকার মনোনীত একজন বিশিষ্ট ব্যক্তি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ গঠিত হবে। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য-সচিব হবেন।
তহবিল গঠনের প্রস্তাবে বলা হয়, ফাউন্ডেশনের একটি স্থায়ী তহবিল থাকবে। এতে সরকারি, বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তি, সরকারের অনুমোদনক্রমে বিদেশ সরকার সংস্থা বা আন্তর্জাতিক সংস্থা, ফাউন্ডেশনের বিনিয়োগ থেকে অর্জিত আয়, তপশিলি ব্যাংকে তহবিলের অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে আয়, সরকার অনুমোদন ক্রমে অন্য কোনো উৎস থেকে প্রাপ্ত আয়। স্থায়ী আমানতের সম্পূর্ণ অংশ থেকে দরিদ্র প্রতিবন্ধীদের পুনর্বাসন, শিক্ষা, চিকিৎসা, জরুরি সেবা, প্রতিবন্ধীদের এককালীন অনুদান, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবৃত্তি খাতে ব্যয় করা যাবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন