সংঘাত-সংঘর্ষ, নানা নাটকীয়তা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠার পর ঢাকায় শান্তিপূর্ণ গণসমাবেশ করেছে জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। পথে পথে বাধা, হামলা, পুলিশ-ক্ষমতাসীন দলের তল্লাশি, মোড়ে মোড়ে পাহাড়ার পরও সমাবেশস্থল গোলাপবাগ মাঠ ও সায়েদাবাদ থেকে কমলাপুর জনসমুদ্রে পরিণত হয়েছিল। শত বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে লাখো মানুষের জমায়েতে উৎফুল্ল বিএনপি নেতাকর্মীরা। এই সমাবেশ থেকেই সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ ১০ দফা দাবি ঘোষণা করেছে বিএনপি। এসব দাবি আদায়ে ২৪ ডিসেম্বর থেকে যুগপৎ আন্দোলন নামবে বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দল ও সংগঠন। তবে এই সমাবেশে চমক এবং আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে নেতাকর্মীরা মনে করছেন জাতীয় সংসদ থেকে বিএনপির সাত এমপির পদত্যাগ। বিএনপির গণসমাবেশের সংবাদ এড়িয়ে যায়নি বিদেশী গণমাধ্যমগুলোও। সমাবেশ শেষে শনিবার ও গতকাল রোববারও চায়ের দোকানে, আড্ডায়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও বিএনপির সমাবেশ নিয়েই ছিল আলোচনা। তাদের অনেকেই বলেন, বেগম খালেদা জিয়া বন্দী, তারেক রহমান দেশে নেই, শীর্ষ নেতারাও কারাগারে। তারপরও এতো মানুষ কিভাবে হয়! কেউ কেউ আবার উত্তরও দিয়েছেন, বিএনপির সমাবেশে মানুষ বক্তব্য শুনতে কিংবা কোন নেতাকে দেখতে আসে না। যারা কথা বলতে পারে না, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করতে পারে না, তারা উপস্থিত হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়।
বিএনপির সমাবেশে গিয়েছিলেন সবুজবাগের ভ্যানচালক সবুজ মিয়া। যাওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চালের দাম বেড়ে গেছে। বাচ্চাদের ঠিক মত খাবার দিতে পারিনা। এ সমাবেশ চাল-ডালের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদ প্রতিবাদ জানাতেই গিয়েছি। আর সংসার চালাতে পারি না।
গতকাল নয়াপল্টনে চায়ের দোকানের সামনে শমসের আলী নামে এক রিক্সা চালক বলেন, তিনি শনিবার রিক্সা চালাননি, বিএনপির সমাবেশে গিয়েছিলেন। কেন গিয়েছিলেন? জানতে চাইলে শমসের বলেন, এই সরকার চাল-ডাল-তেলের দাম যেভাবে বাড়াচ্ছে, তাতে বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে গেছে। প্রতিবাদ করতে সেখানে গেছিলাম। গোলাপবাগে বসবাসকারী উৎপল দাস নামে এক ব্যক্তি বিএনপির গণসমাবেশে জনসমাগম সম্পর্কে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, আমার বাসা থেকেই গোলাপবাগ মাঠ দেখা যায়। সমাবেশের আগের রাতেই দেখেছি মাঠ ভরে গিয়েছিল। রাতে তারা সেখানেই ছিলেন। সকাল বেলা দেখেছি আশপাশের এলাকাও লোকে লোকারণ্য হয়ে গেছে।
রাজধানীর ভিক্টর পরিবহনে গতকাল দুই যাত্রী বিএনপির সমাবেশ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, সরকার এতো কিছু করল কিন্তু সমাবেশ তো বন্ধ করতে পারেনি, লোকজনও কম হয়নি।
সাইফুল ইসলাম নামে এক চাকরিজীবী বলেন, বিএনপি দেশে এখন একটা সুর তুলতে পেরেছে, যার প্রমাণ বিএনপির সমাবেশগুলো। এতো কিছু করা হচ্ছে, বাস, নৌকা সব বন্ধ তারপরও মানুষ যাচ্ছে, সমাবেশ হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকায় বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের পর নিজেই মনে করেছিলেন বিএনপির সমাবেশে লোকসমাগম হবে না। কিন্তু টেলিভিশন ও ফেসবুকে দেখে তিনি অবাক হয়েছেন।
ইঞ্জিনিয়ার আতিকুর রহমান ফেসবুকে সমাবেশের একটি ছবি দিয়ে লিখেছেন- সরকারের বাধা না থাকলে পুরো ঢাকা শহর গোলাপবাগে পরিণত হতো। মো. খোকন লিখেছেন, সরকার এতো কঠোর থাকার পরও এতো মানুষ কিভাবে আসল? এটি একটি ইতিহাসই বটে।
দীর্ঘদিন পর ঢাকার বুকে বড় শোডাউন হওয়াতে উৎফুল্ল বিএনপি নেতাকর্মীরাও। তারা বলছেন, এতো বাধা-বিপত্তি, পুলিশ-আওয়ামী লীগের মারমুখী অবস্থান, পথে পথে তল্লাশি, হামলা-মামলার পরও লাখ লাখ নেতাকর্মীর উপস্থিতি বিস্ময়কর।
ছাত্রদলের সাবেক নেতা ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক রজিবুল ইসলাম সমাবেশ শেষে বলেন, একদিন আগে অনুমতি পেয়েও লাখ লাখ মানুষ ছুটে এসেছে। আর যদি কোন বাধা-ভীতিকর পরিস্থিতি না থাকতো তাহলে পুরো ঢাকা শহরই বিএনপির সমাবেশের নগরীতে পরিণত হতো। ১০ দফা দাবির বিষয়ে তিনি বলেন, যে ১০ দফা দাবি দেয়া হয়েছে এটি শুধু বিএনপির নয়, দেশের সকল গণতন্ত্রকামী এবং স্বৈরশাসন থেকে মুক্তিকামী মানুষের দাবি।
সমাবেশে বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, মির্জা ফখরুলসহ অনেকেই নেই তারপরও কেন এসেছিলেন ফেরার পথে জানতে চাইলে হবিগঞ্জ থেকে সমাবেশে আসা ইয়াছিন মাতবর বলেন, আমরা এখানে কাউকে দেখতে আসিনি। আমরা এসেছি সরকারের দুর্নীতি, দুঃশাসনের প্রতিবাদ জানাতে। তিনি বলেন, শুধু বিএনপি না, যারাই এই দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বলতে তাদের সমাবেশেই আমি উপস্থিত হব।
ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু আফসার মো. ইয়াহিয়া বলেন, গোলাপবাগের লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতি বলে দিচ্ছে বর্তমান কর্তৃত্ববাদী, ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি দেশের মানুষের আস্থা নেই। তারা বিএনপির আন্দোলন ও দাবির প্রতি একাত্মতা পোষণ করেছেন।
তিনি বলেন, ওই সমাবেশে বিএনপির সাত এমপির পদত্যাগের যে ঘোষণা দিয়েছেন তা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনের টার্নিং পয়েন্ট। সরকারের পদত্যাগসহ বিএনপি ১০ দফা দাবি ঘোষণা করে যে চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু করছে, তার আগে সংসদ থেকে নিজেরা পদত্যাগ করে এই আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এতো অল্প সময়ে বিপুল সংখ্যক মানুষ কিভাবে উপস্থিত হলো জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নাজমুল হাসান বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত এখন এক সূতোয় গাঁথা। এখন আর কেউ নেতা বা কর্মী নন, সকলেই নেতা, সকলেই কর্মী। যত বাধা-প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হোক নেতাকর্মীরা জীবন বাজী রেখে হলেও তারেক রহমানের ডাকে সাড়া দিতে প্রস্তুত, আগের ৯ বিভাগীয় সমাবেশে তারা প্রমাণ করেছে, ঢাকার সমাবেশেও সেটি প্রমাণিত হয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপি যে আন্দোলন শুরু করেছে এটি এখন আর বিএনপির একার আন্দোলন নয়, এটি গণমানুষের আন্দোলনে রূপ নিয়েছে। যা গণসমাবেশগুলোতে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ ঘর ছেড়ে বের হতে শুরু করেছে, প্রতিবাদ করছে সরকারের বিরুদ্ধে।
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক এড. আব্দুস সালাম আজাদ বলেন, সরকার এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছিলে যে, ঢাকায় বিএনপি সমাবেশ করতে পারবে না। সেখান থেকে লাখ লাখ মানুষ নিয়ে বিএনপি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করেছে। সাধারণ মানুষ জানিয়ে দিয়েছে তারা আর এই সরকারকে দেখতে চায় না। তিনি আশা প্রকাশ করেন, বিএনপি যে ১০ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নামছে সাধারণ মানুষ এই দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলনে শরিক হবে। কারণ এটি শুধু বিএনপির দাবি নয়, কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষের দাবি রয়েছে এর মধ্যে।
বিদেশী গণমাধ্যমে বিএনপির সমাবেশ: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ, নির্দলীয় তত্ত্বাবধাক সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার দাবিতে শানিবার ঢাকায় বিরোধী দল বিএনপি’র বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এমন খবর দিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে ভারতের হিন্দুস্তান টাইমস, বার্তা সংস্থা এএফপি, স্ট্রেইটস টাইমস, এনডিটিভি, বিবিসি বাংলা, ডয়েচেভেলে, পারসটুডে প্রভৃতি সংবাদ মাধ্যম।
হিন্দুস্তান টাইমসের শিরোনাম- বাংলাদেশ অপোজিশন মাউন্টস হিউজ প্রটেস্ট ইন ঢাকা: ‘শেখ হাসিনা ভোট থিফ’। এনডিটিভির শিরোনাম- ‘ম্যাসিভ প্রটেস্ট ইন বাংলাদেশ ক্যাপিটাল এগেইনস্ট শেখ হাসিনা’জ গভর্নমেন্ট’। এএফপি’র শিরোনাম- ‘বাংলাদেশ অপোজিশন মাউন্টস হিউজ প্রটেস্ট ইন ক্যাপিটাল’। হিন্দুস্তান টাইমস তার প্রতিবেদনে লিখেছে, নতুন নির্বাচন দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মী ঢাকায় সমবেত হন। শনিবার রাজধানী ঢাকায় উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। এরই মধ্যে বিক্ষোভকারীরা আগের নির্বাচনে ‘ভোট চুরি’ নিয়ে স্লোগান দেন। সহিংসতায় উস্কানি দেয়ার অভিযোগে বিরোধী দলের শীর্ষ দুই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিরোধী দল দেশজুড়ে যখন প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ এবং নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবিতে বিক্ষোভ করছে, তখন তাদের র্যালি থেকে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক আবহে এরই মধ্যে জাতিসংঘ সহ পশ্চিমা দেশগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে মুখপাত্র জহির উদ্দিন স্বপন বলেছেন, আমাদের প্রধান দাবি হলো- অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হবে। জাতীয় সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মূলত বার্তা সংস্থা এএফপি’র রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে খবর পরিবেশন করেছে হিন্দুস্তান টাইমস। এএফপি আরও বলেছে, এদিন শহরের প্রবেশপথগুলোতে চেকপয়েন্ট বসায় পুলিশ। বিস্তৃত মেট্রোপলিটন শহরে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। ঢাকার রাস্তাঘাট স্বাভাবিক সময়ে যানজটে আটকে থাকে। সেই রাস্তাগুলোতে এদিন হাতেগোনা সাইকেল, রিকশা ও কার চলাচল করতে দেখা গেছে। বিরোধী বিএনপি’র কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, সরকার অনানুষ্ঠানিকভাবে পরিবহন ধর্মঘট ডেকেছে, যাতে মানুষজন সমাবেশে যোগ দিতে না পারেন। স্থানীয় মিডিয়ার খবরে বলা হয়েছে, শুক্রবার বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ক্ষমতাসীন দলের ক্যাডাররা। এনডিটিভি লিখেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিক্ষোভ, নতুন নির্বাচন দাবিতে শনিবার ঢাকায় প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র মিটিংয়ে সমবেত হয়েছিলেন প্রায় এক লাখ সমর্থক। গোলাপবাগ মাঠে আয়োজিত এই র্যালি আশপাশের সব সড়কে ছড়িয়ে পড়ে। এই বিক্ষোভেই পার্লামেন্ট থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বিএনপি’র সাত জন এমপি। পার্লামেন্টে এই দলটির আসনই আছে সাতটি। ফলে পার্লামেন্ট পরিণত হবে ব্যাপকভাবে রাবার স্ট্যাম্পে। এখানে এমনিতেই শেখ হাসিনার দলের কমপক্ষে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ ও পশ্চিমা সরকারগুলো। দেশীয় মুদ্রা টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে শতকরা ২৫ ভাগ। ফলে খাদ্য আমদানির খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দরিদ্র ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি। খাদ্য ও অন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বৃদ্ধিতে ক্ষোভ প্রকাশ করতে র্যালিতে যোগ দিয়েছিলেন অটোরিকশাচালক রাসেল মিয়া। তিনি বলেছেন, মূল্যবৃদ্ধির ফলে তার পরিবারের দিনে তিনবারের খাবার সরবরাহে লড়াই করতে হচ্ছে। তিনি বলেন, নিষ্পেষণের শিকার আমি। যেসব মানুষ আমার এই পরিণতির জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে আমি এখানে এসেছি। কিন্তু বাংলাদেশে আছে অর্ধডজন বেসরকারি টেলিভিশন। তাদের কেউই এই ইভেন্ট সরাসরি সম্প্রচার করেনি। এতে সংশয় বেড়েছে যে, কর্তৃপক্ষ তাদেরকে সম্প্রচার না করতে চাপ দিয়েছে।#
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন