জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ভর্তি পদ্ধতিতে বিভিন্ন কোটা ও মেধার বৈষম্য প্রকট। শিফট, লিঙ্গ ও পোষ্যসহ বিভিন্ন কোটার কারণে মেধাবীরা যোগ্যতা সত্ত্বেও ভর্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। সেইসাথে পাচ্ছে না পছন্দের বিষয়ে ভর্তির সুযোগও। অন্যদিকে ন্যূনতম নম্বর পেয়ে যেকোন বিষয়ে ভর্তি হচ্ছেন কোটাধারীরা। ভর্তি পরীক্ষার এই পদ্ধতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এই সংকট সমাধানে ভর্তি পদ্ধতির মৌলিক সংস্কার করে অভিন্ন প্রশ্নপত্র ও একক মেধাতালিকা প্রণয়নের দাবি জানিয়েছেন তারা।
জাবি রেজিস্ট্রার ভবনের তথ্যমতে, গত তিনটি শিক্ষাবর্ষের (৪৮, ৪৯ ও ৫০ ব্যাচ) ভর্তিতে প্রায় সমানসংখ্যক ছাত্র ও ছাত্রী ভর্তি করানো হয়েছে। তবে ওই ভর্তি পরীক্ষাগুলোতে ছাত্রীদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ছাত্র উত্তীর্ণ হয়েছে। ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে ‘এ’ ইউনিটে ২২ হাজারের বেশি ছাত্র উত্তীর্ণ হয়। সেখানে ছাত্রী উত্তীর্ণের সংখ্যা ১০ হাজার ৩২৮ জন। পরের বছরগুলোর ফলাফলেও একই চিত্র উঠে এসেছে। ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ২৫ হাজার ১৩৭ জন ছাত্র উত্তীর্ণ হয়। আর ছাত্রীরা উত্তীর্ণ হয় ১২ হাজার ৬৫০ জন। ২০২০-২১ সেশনে ১৪ হাজার ৮৫৯ ছাত্র ও ৭ হাজার ৩৬৬ জন ছাত্রী ভর্তি পরীক্ষায় পাশ করে। অথচ এই ইউনিটে প্রায় সমান সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করানো হয়।
এছাড়া গত তিন বছরে ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির ‘এইচ’ ইউনিটে ধারাবাহিকভাবে ছেলেরা প্রায় তিনগুন বেশি উত্তীর্ণ হয়ে আসছে। দেখা যায়, ২০১৯ সালে ছাত্র-ছাত্রী যথাক্রমে ৬ হাজার ৮৮৩ ও ২ হাজার ৬৯২ জন; ২০২০ সালে ছেলে-মেয়ে যথাক্রমে ৫ হাজার ৫০৭ ও ১ হাজার ৮০৭ জন এবং ২০২১ সালে ছাত্র-ছাত্রী যথাক্রমে ৩৫১০ ও ১৪৭১ জন পাশ করে।
এভাবে প্রতিটি ইউনিটেই ৪০ থেকে ৭০ শতাংশ পর্যন্ত ছেলেরা পরীক্ষায় বেশি কৃতকার্য হচ্ছে। ফলে মেয়েরা ছেলেদের তুলনায় ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ কম নম্বর পেয়েও ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। তবে শুধুমাত্র সি-১ ইউনিটে ছেলেদের তুলনায় মেয়েরা ১২ শতাংশ বেশি পাশ করেছে।
২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও ভর্তি পরীক্ষার্থী সাকিব হাসান বলেন, ছেলে পরীক্ষার্থী দ্বিগুণ হওয়ায় আমাদের চেয়ে কম নম্বর পেয়ে মেয়েরা ভর্তির সুযোগ পাচ্ছে। কম নাম্বার পেয়ে অনেকেই এখন জাবির শিক্ষার্থী কিন্তু আমি তাদের চেয়েও বেশি নাম্বার পেয়েও ভর্তি হতে পারিনি শুধু লিঙ্গভিত্তিক ভর্তি পদ্ধতির কারনে। এ ছাড়া পোষ্য কোটা ও শিফট পদ্ধতির কারণে ভর্তি পরীক্ষায় মেধা যাচাইয়ের ন্যূনতম সুযোগ থাকছে না।
অন্যদিকে বিগত বছরগুলোতে প্রকট হয়েছে শিফট বৈষম্য। সর্বশেষ ভর্তি পরীক্ষার তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ‘এ’ ইউনিটভুক্ত গাণিতিক ও পদার্থবিষয়ক অনুষদের দ্বিতীয় শিফটে প্রায় ১৪৫, পঞ্চম শিফটে ১১৮ ও প্রথম শিফটে ৯২ পরীক্ষার্থী মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছেন। আর বাকি চারটি শিফটে মোট ১১১ জন। ‘বি’ ইউনিটভুক্ত সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ও আইন অনুষদের দেখা যায়, পঞ্চম বা শেষ শিফট থেকে সুযোগ পেয়েছে ১৭৫ জন। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শিফট থেকে যথাক্রমে ৩৪, ৫৯, ৫১ ও ৬৭ জন। এধরণের বৈষম্যের কারণে পরীক্ষা চলাকালীন ‘একক প্রশ্নপত্রে মূল্যায়ন চাই’ শীর্ষক প্ল্যাকার্ডে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শোভন রায় নামের এক ভর্তি-ইচ্ছুক।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বেড়েই চলছে পোষ্য কোটায় ভর্তির সংখ্যা। রেজিস্ট্রার কার্যালয় সূত্র জানায়, ৪৮, ৪৯ ও ৫০ ব্যাচে যথাক্রমে ৪১, ৫৩ ও ৫৬ জন পোষ্য কোটায় ভর্তি হয়েছে। জানা যায়, ১৯৯৩ সালের ২৬ জুন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে ভর্তির অধ্যাদেশে পোষ্য ভর্তির কথা উল্লেখ করা হয়। শুরুতে পোষ্যদের জন্য লিখিত পরীক্ষায় পাস নম্বর ছিল ৪০ শতাংশ। কিন্তু ২০১৩-২০১৪ সেশনে পাস নম্বর কমিয়ে ৩৫ শতাংশ করা হয়। আবার ২০১৫-২০১৬ সেশনে আরেক দফা কমিয়ে ৩৩ শতাংশ করা হয়। ২০১৬-১৭ সেশনে শুধু পোষ্যদের জন্য আবশ্যিক বিষয়ে পাস নম্বর পাওয়ার বাধ্যবাধকতা উঠিয়ে দেওয়া হয়। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে গ্রেস (অতিরিক্ত মার্ক) দিয়েও ভর্তি করাতে তদবির করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দ।
তাছাড়া বাড়ছে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীর সংখ্যা। ৪৮, ৪৯ ও ৫০ ব্যাচে যথাক্রমে ১৩২, ১৪০ ও ১৩৯ জন ভর্তি হয় মুক্তিযোদ্ধা কোটায়।
চাঁদপুর জেলার এক ছাত্রের অভিভাবক আব্দুল ওয়াহাব মিঞা বলেন, ‘শুধু আমার সন্তানই নয় দেশের শত শত শিক্ষার্থী মেধার স্বাক্ষর রাখতে পারলেও হেরে যায় কোটা পদ্ধতির কাছে। জাবির ছাত্র-ছাত্রী কোটার বেড়াজালে আমার ছেলে ভালো নাম্বার পেয়েও ভর্তি হতে পারেনি। অথচ একজন, শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারীর ছেলে-মেয়ে পাশ মার্কস না পেয়েও ভর্তি হতে পারছে শুনেছি। এভাবে চলতে থাকলে একসময় মেধার কোনো মূল্যায়ন থাকবে না। আমি চাই শিগিরই কোটার কলঙ্ক দূর হোক মেধাবীরা সুযোগ পাক।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক ভর্তি পদ্ধতির মৌলিক সংস্কার চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক আলিফ মাহমুদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হলো মেধাবীদের কদর করার জায়গা এখানে কারো পরিচয়ে বা কোটা নিয়ে ভর্তি হয়ে সত্যিকার অর্থে মেধাবীদের বঞ্চিত করা কোনোভাবেই কাম্য নয়। একজন শিক্ষার্থীর বাবা-মা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা বা কর্মচারী হলেই যে তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করাতে হবে এমন চিন্তাধারা সরাসরি মেধার অবমূল্যায়ন। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য অন্ধকার বয়ে আনবে।
এ ব্যাপারে প্রত্নতত্ত বিভাগের প্রফেসর একেএম শাহনেওয়াজ বলেন, আযাচিতভাবে ভর্তি করানো, সকল ধরণের কোটাই মেধাবীদের অবমূল্যায়ন করে। সামগ্রিকভাবে পোষ্য, প্রতিবন্ধি, মুক্তিযোদ্ধা বা অন্যান্য কোটা সংস্কার করা জরুরী। মেধাকে প্রাধান্য দিতে ও শিক্ষার যথাযথ মান বজায় রাখতে ভর্তি পদ্ধতির মৌলিক সংস্কার আবশ্যক। এজন্য এক প্রশ্নপত্র ও এক মেধাতালিকায় ভর্তি ব্যবস্থা প্রচলন করতে হবে।
এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা জানান, এই পদ্ধতি বহাল থাকার পেছনে রয়েছে শিক্ষকদের বিপুল আর্থিক সুবিধা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ সেশনে ভর্তি কার্যক্রম থেকে মোট আয় হয় ৩৫ কোটি ৩১ লাখ ৫২ হাজার ৯৬০ টাকা। প্রতিবছর যার ৪০ শতাংশ অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় তহবিল ও ১০ শতাংশ সরকারি তহবিলে জমা প্রদান করতে হয় এবং বাকি অর্থ ভর্তি কার্যক্রমে ব্যয়ের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু নিয়ন্ত্রক ও মহাহিসাব নিরীক্ষক এর কার্যালয়ের অধীন শিক্ষা অডিট অধিদপ্তরের অডিট টিমকে ১৭ কোটি ২৭ লাখ ৩০ হাজার ২৯৬ টাকার হিসাব দিতে পারেনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বিষয়টিকে গুরুতর আর্থিক অনিয়ম বলে চিহ্নিত করেছে অডিট কমিটি।
এ বিষয় দর্শন বিভাগের প্রফেসর রায়হান রাইন বলেন, পুরো ভর্তি পদ্ধতিটাই সংস্কার করা জরুরী। সব ক্ষেত্রেই মেধার বৈষম্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। হলে সিটের বিপরীতে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি নেওয়া হয় কিন্তু বিগত বছরের ফলাফল পর্যালোচনা করেও ছাত্র-ছাত্রী ভর্তির সংখ্যা প্রাপ্ত নাম্বারের উপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা যেতে পারে। শিফট পদ্ধতির কারণে সঠিক ভাবে মূল্যায়নও করা যাচ্ছে না। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীর সম্মানী প্রদানের একটা নীতিমালা থাকলে অর্থনৈতিক কোনো সুবিধার জন্য শিফট পদ্ধতি বহাল থাকবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক ভর্তি কার্যক্রম পরিচালনা ও পদ্ধতি নিয়ে ভিসি প্রফেসর নূরুল আলম বলেন, শিফটের কারণে বৈষম্য হচ্ছে এটা সত্য। এবছর আমরা ইউনিট কমিয়ে কিছুটা সমাধান করার চেষ্টা করেছি। পরের বছর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের স্কুল-কলেজে পরীক্ষা কেন্দ্র নির্ধারণ করে শিফট পদ্ধতিটা আরো কমিয়ে আনার চেষ্টা করবো।
তিনি আরো বলেন, ‘সমান সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি নেওয়া হয় আবাসিক হলে সিটের উপর ভিত্তি করে। নতুন যে হল নিমার্ণ করা হয়েছে সেখানেও সমান সংখ্যক সিট রয়েছে। তবে ভবিষ্যতে যদি আবার আবাসিক হল নির্মাণের প্রয়োজন পরে তখন বিষয়গুলো বিবেচনায় নেওয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন