আল্লাহপাক এই দুনিয়াকে এমনভাবে তৈরি করেছেন যে, এখানে বেদনা ও আনন্দ, সুখ ও দুঃখ হাত ধরাধরি করে চলে। এখানকার আনন্দ বা বেদনা কোনোটাই নিরঙ্কুশ নয়। ফলে এখানকার জীবনে মানুষের দুঃখ-বেদনায় নিপতিত হওয়া অস্বাভাবিক কোন বিষয় নয়। কিন্তু কিছু বেদনা এমনও হয়ে থাকে যে, তার ক্রিয়া গোটা জাতিকে আচ্ছন্ন করে ফেলে এবং বিশ্বজোড়া বিষ ক্রিয়ার কারণে তার ক্ষত শোকাতেও সময় লাগে।
এমনই একটি বেদনা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ ও বহুগ্রন্থ প্রণেতা, উস্তাদুল উলামা ওয়াল মুহাদ্দিসীন, পীরে কামিল, শায়খুল হাদীস হযরত আল্লামা মুফতী মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী ছাহেব কিবলাহ রাহিমাহুল্লাহ’র ইন্তেকালের মধ্য দিয়ে মানবতাকে আচ্ছন্ন করেছে, যে বেদনা এমনসব মানুষের অন্তরাত্মাকে কাঁপিয়ে তুলেছে, যারা আল্লামা দুবাগী সাহেব এর ব্যক্তিত্ব, কৃতিত্ব ও তাঁর অবদান সম্পর্কে অবহিত।
বিংশ শতাব্দীর এ ক্ষণজন্মা মহা মনীষী হযরত আল্লামা মুজাহিদ উদ্দীন চৌধুরী দুবাগী রাহিমাহুল্লাহ এর সম্পর্কে কিছু লিখার ইচ্ছা থাকলেও মরহুমের শান-মান তথা ইলমি ব্যক্তিত্বের কথা স্বরণ হলে হাতে কাপুনী চলে আসে এবং হৃদ স্পন্দন বেড়ে যায়। তবুও যেহেতু এ মহান ব্যক্তি সম্পর্কে কিছু লিখার মনস্থ করেছি তাই লিখতে হবে। আমি আল্লাহর দরবারে তাওফিক কামনা করে কলম হাতে নিলাম।
এ দুনিয়ায় অনেক মহা মানবের জন্ম হয়েছে। যারা যুগে যুগে ইলমি খেদমতের মাধ্যমে বিশ্ব মানবতাকে সঠিক পথের দিশা দিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন আল্লামা দুবাগী রাহিমাহুল্লাহ। আমি অধম আল্লামা দুবাগী রাহিমাহুল্লাহ এর লেখা কিতাবাদি পড়ে তাঁর মহান খেদমত দেখে অভিভূত হই ও তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি।
কারণ প্রবাস জীবন তথা সাতসমুদ্র তের নদীর ওপারে সূদূর বিলেতে যিনি দ্বীন ইসলাম তথা আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের প্রতিটি বিষয়ের উপর কিতাব রচনা করে যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, ইতিহাসে এমন নজির বিরল।
আমি আল্লামা দুবাগী ছাহেব রাহিমাহুল্লাহর কিতাবাদি পড়ে তাঁকে এক নজর দেখা ও তাঁর কাছ থেকে ফয়েজ-বরকত হাসিল করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়ি।
আলহামদুলিল্লাহ! আমার লন্ডন সফরে আমি নিজে খোঁজ নিয়ে তাঁর বাসা বের করে মুলাকাত করে এ মহান ওলির কাছ থেকে দোয়া ও ফয়েজ-বরকত আমার সৌভাগ্যে ঘটেছিল বলে আমি আমাকে ধন্য মনে করছি। প্রথম দর্শনেই আমার মনে সলফে সালেহীনের চিত্রপট ফুটে উঠে। যেভাবে আল্লামা দুবাগী ছাহেব তাঁর লেখা কিতাবাদি ইসলামের বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছেন, বাস্তব পক্ষে তাঁর গোটা জীবন ছিলো এর জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত।
আল্লামা দুবাগী সাহেব রাহিমাহুল্লাহর মেহমানদারি ছাড়াও তাঁর ইসলামী তৎপরতা, জ্ঞানসাধনা ছিল অভাবনীয় ও বিস্ময়কর। পরিণত বয়সেও তিনি জ্ঞানসাধনা-গবেষণা, লেখালেখি বিরতিহীন-ক্লান্তিহীনভাবে চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর নিজস্ব কুতুবখানা বা বিশাল লাইব্রেরি তা রীতিমতো অবাক করার মতো। আমি প্রত্যক্ষ করি যে, আল্লামা দুবাগী সাহেব রাহিমাহুল্লাহর নিজস্ব কুতুবখানার স্বতন্ত্র কোনো স্থান নেই, বরং তার সমগ্র বাসভবনের প্রতি কক্ষেই সাজানো গ্রন্থভর্তি আলমারির সারি। বড় বড় এসব আলমারি মূল আরবিসহ প্রসিদ্ধ নানা ভাষার মূল গ্রন্থরাজিতে পরিপূর্ণ। তিনি প্রয়োজনে যে কোনোটা খুলে অধ্যয়ন, গবেষণা ও লেখালেখিতে ব্যস্ত থাকতেন।
বাংলাদেশসহ উপমহাদেশ এবং আরব বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহু পণ্ডিত, মনীষী তথা খ্যাতনামা ওলামায়ে কেরাম আল্লামা মোজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী রাহিমাহুল্লাহর রচিত গবেষণাধর্মী তথ্যবহুল রচনাবলী ও নানামুখী ইসলামী তৎপরতা দেখে এতই অভিভূত ও মুগ্ধ হয়েছেন যে, তারা তাদের প্রেরিত শুভেচ্ছাবাণী ও মূল্যবান অভিমতগুলোতে আল্লামা মোজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী রাহিমাহুল্লাহকে মোবারকবাদ সাধুবাদ জানিয়েছেন।
তাঁর বাংলা ভাষায় রচিত বিখ্যাত পুস্তক মীলাদে বেনযীর। পুস্তকটির প্রতিপাদ্যগুলো এতই তথ্যবহুল, গবেষণাধর্মী ও বিস্তীর্ণ। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী আল্লামা দুবাগী সাহেব রাহিমাহুল্লাহ বহুকাল পূর্বের একটি বহুল বিতর্কিত আলোচিত বিষয় মীলাদ ও কিয়ামের ওপর মীলাদে বেনযীর রচনা করে বিশ্বব্যাপী দারুণ আলোড়নের সৃষ্টি করেছেন। তার জবান ও কলম ছিল যুগপৎভাবে সক্রিয় এবং আধ্যাত্মিক সাধনা তার বলিষ্ঠ নৈতিকতার নিদর্শন। বিলেতের পরিস্থিতির আলোকেই জবান ও কলমের জিহাদ চালু রেখেছিলেন। বিক্ষিপ্তভাবে ওয়াজ মাহফিল, ইসালে সওয়াব ও মীলাদ মাহফিল, বিভিন্ন শহরের মসজিদে গমন করে ওয়াজ বক্তৃতা বয়ান, আন্তর্জাতিক ইসলামী সম্মেলনগুলোতে ভাষণ প্রদান ইত্যাদি ছিল তাঁর প্রচার মিশনের প্রধান আকর্ষণ।
নবীপাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সালাম এর খাঁটি একজন ওয়ারিছ এবং প্রকৃত মুত্তাকী পরহেজগার হিসেবে যে সকল সীরত ও বাহ্যিক আচার-আচরণ থাকা দরকার সবই সমন্বয় ঘটেছিল আল্লামা দুবাগী রাহিমাহুল্লাহ এর জীবনে।
মুমিন-মুসলমানদের সঠিক পথে পরিচালনার জন্য আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের মতাদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন আনজুমানে আল ইসলাহ ইউ.কে। ইলমে ওহী তথা কুরআন ও সুন্নাহর সহী শিক্ষার জন্য বিলেত জীবনে মাদরাসা প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। মসজিদ ও খানেকা প্রতিষ্ঠায় তিনি ছিলেন তৎপর। তাঁর তৎপরতায় গড়ে উঠে অনেক মসজিদ ও খানেকা।
আল্লামা দুবাগী ছাহেব রাহিমাহুল্লাহ বাংলাদেশে থাকতে বিভিন্ন মাদরাসায় ইলমে হাদীসের খেদমতে আঞ্জাম দিয়েছেন। তাঁর জীবনের বিরাট অংশ কেটেছে সুদূর বিলেতে সেখানে শত ব্যস্ততার মাঝেও লেখালেখিতে, দরস ও তাদরীছে, তালিম-তরবিয়তে, বাক -বক্তৃতা ও মুনাযারায় তাঁর সময় কাটে। তাঁর লেখা বই-পুস্তকগুলো আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের একেকটি হাতিয়ার যা আমাদের সঠিক চলার পথে মাইলফলক হিসেবে কাজ করে।
এ মহা-মনীষীর ইন্তেকালে মুসলিম উম্মাহ তাদের এক রাহবারকে হারিয়েছে। দেশ-বিদেশের ইসলামি স্কলারগণ তাঁর ইন্তেকালে শোক প্রকাশ করে দোয়ার মাহফিল করেন। তাতে বুঝা যায়, শায়খুল হাদীস আল্লামা মুফতি মুজাহিদ উদ্দিন চৌধুরী দুবাগী রাহিমাহুল্লাহ এর শিক্ষা ও পরিচিতি শুধু লন্ডন ও বাংলাদেশ ভিত্তিক ছিল তা নয় বরং তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক মহলে সর্বজন স্বীকৃত একজন মুহাক্কিক আলেম, মুফতিয়ে আযম, মুনাযিরে আযম, শরীয়ত ও তরিকতের রাহবার।
আমরা এ মহা-মনিষীকে হারিয়ে শোক সাগরে মুহ্যমান। আল্লাহপাক যেন তাঁর আওলাদ সাহেবজাদাগণকে মরহুমের খেদমতসমূহ সঠিকভাবে পরিচালনা করার তাওফিক দান করেন এবং আল্লামা দুবাগী রাহিমাহুল্লাহকে যেন জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করেন। আমিন!
লেখকঃ গভর্নর, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বোর্ড অব গভর্নরস, অধ্যক্ষ, নেছারিয়া কামিল মাদরাসা, ঢাকা
খতীব, আমিনবাগ জামে মসজিদ, শান্তিনগর, ঢাকা
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন