শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

তাসাওউফ : ‘কুতুব’ কারা ও অবস্থান কোথায়?

মুফতী মো: আবদুল্লাহ্ | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

প্রসঙ্গ : ‘ফাতুহাতে মাক্কীয়া’ শিরোনামের গ্রন্থটিতে এমন একটি উদ্ধৃতি রয়েছে যে, “প্রতিটি গ্রাম বা জনপদে হোক তা মুমিনদের আবাসস্থল বা কাফিরদের আবাসস্থল অবশ্যই তাতে বা তার মধ্যে একজন ‘কুতুব’ অবস্থান করেন বা থাকেন”। এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে? অর্থাৎ এতে বলা ‘ক্বারইয়া’ মানে কি ‘গ্রাম’ না কি ‘শহর’? ‘কুতুব’ কি মানব সমাজ থেকে হয়ে থাকেন, না কি মানব সমাজের বাইরেও কেউ হতে পারেন? যদি সাধারণ ‘গ্রাম’ অর্থ নেয়া হয়, সেক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগে, এমন অনেক গ্রাম পাওয়া যায় যেখানে গণ-মানুষকে হিদায়েতের পথে আহ্বানকারী কাউকেই পাওয়া যাবে না!

না কি তার অর্থ এমনটি হবে যে, ‘আশেপাশে হয়তো কোথাও এমন একজন লোক থাকবেন যাঁকে ‘কুতুব’ বলে ডাকার যোগ্য হবেন এবং তার আশেপাশের গ্রামগুলোর গোপন তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তাঁর উপর ন্যাস্ত হবে? মোটকথা ‘ক্বারইয়া’ ও ‘কুতুব’ এর ব্যাপারে খোদ আমিসহ অনেকেরই কৌতুহল রয়েছে বিধায় ব্যাখ্যা-অনুসন্ধানের এ আয়োজন।

‘ক্বারইয়া’ ও ‘কুতুব’ ‘গ্রাম’ না ‘শহর’? : উক্তরূপ একটি প্রশ্নের জবাবে হযরত শাহ আশরাফ আলী থানবী র. বলছেন, “বক্তব্য মতে উদ্ধৃতিটি ‘ফাতূহাতে মাক্কীয়া’ গ্রন্থে বিদ্যমান হলে, সেক্ষেত্রে বাহ্যিক বিবেচনায় ‘গ্রাম’ বলতে ব্যাপক অর্থই উদ্দেশ্য হবে অর্থাৎ সাধারণ ‘গ্রাম’ও হতে পারে, ‘শহর’ও হতে পারে; এবং “তার মধ্যে” বলতে সেই গ্রামে বা শহরে অবস্থানই বোঝাবে, কেবল তার সঙ্গে ‘সম্পর্ক’ বোঝাবে না।

আর ‘কুতুব’ বলতে মানুষ জাতির অন্তর্গত হওয়া জরুরী; তবে তাঁকে হিদায়েতকারী হতে হবে, সেটি জরুরী নয়। অবশ্য তিনি নিজে হিদায়েতপ্রাপ্ত হওয়া জরুরী। এমতাবস্থায় সংশ্লিষ্ট কুতুবকে ‘সৃষ্টিরহস্য’বিষয়ক কুতুব’ শিরোনামে তাসাওউফবিদ্যায় চিহ্ণিত করা হয়। এঁদের বাহ্যিক অবস্থা কখনও অনেক খারাপ বলে মনে হয়; তবে আভ্যন্তরীণ বিবেচনায় দেউলিয়া-বোকা প্রকৃতির হওয়ায়, শরীয়তের নিরীখে তাঁরা ‘মা‘যূর’-অপারগ বলে গণ্য হয়ে থাকেন। আবার কখনও সাধারণভাবে বোকা-দেউলিয়া বলেও মনে হয় না।

আশা করি, এটুকু ব্যাখ্যা সামনে থাকলে, আধ্যাত্মিক জগতের এ দিকটি অনেকটাই স্পষ্ট থাকবে”। (ইমদাদুল ফাতাওয়া : খ. ৪, পৃ. ৩৮৮, যাকারিয়া বুক ডিপো, ইউ.পি, ভারত)।

ব্যাখ্যার সার-সংক্ষেপ : হযরত শায়খ আল্লামা থানভী র. অতি সংক্ষিপ্ত বক্তব্যের মধ্যে আধ্যাত্মিক গোপন জগতের একটি গোপন বিষয়ের অনেকগুলো দিক তুলে ধরেছেন যেমন :

১. কোথাও কোথাও ‘গ্রাম’কেন্দ্রিকও কুতুব থাকেন; আবার অঞ্চলভেদে ‘শহর’কেন্দ্রিকও কুতুব হয়ে থাকেন।
২. ‘কুতুব’ মনুষ্য জাতিই হয়ে থাকেন।
৩. ‘কুতুব’ দু’প্রকারের হয়ে থাকেন যেমন : (ক). ‘সৃষ্টি রহস্য’গত বিদ্যা বিষয়ে অভিজ্ঞ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কুতুব; এবং (খ). ‘শরীয়াবিদ্যা’ বিষয়ে অভিজ্ঞ ও হিদায়েতের লাইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কুতুব।
৪. ‘কুতুব’ হওয়ার জন্য তাঁর জনগণকে হিদায়েতের পথে ডাকতে হবে বা আনতে সচেষ্ট হতে হবে Ñতা আবশ্যক নয়। তবে তাঁর নিজের হিদায়েতপ্রাপ্ত হওয়া জরুরী।
কারণ, হিদায়েতদানের মালিক খোদ মহান আল্লাহ্ নিজেই। তাঁর ইচ্ছা মতে, কোন গ্রামের বা শহরের লোকজনকে হিদায়েতের পথে আনার অনুমোদন ও বরাদ্দ থাকলে সেই অঞ্চলের কুতুবের বা কোন আলেম-দাঈদের দাওয়াত-আহ্বান ছাড়াই তিনি সংশ্লিষ্ট ভাগ্যবানদের হিদায়েতের বিভিন্ন দৃশ্য-অদৃশ্য ওসীলা-উপকরণ তৈরি করে দেবেন এবং সেভাবেই তারা ঈমান-ইসলামের পথে এগিয়ে যাবেন। অর্থাৎ মহান আল্লাহ্ কাউকে বা কোন জনপদবাসীকে হিদায়েতদানের জন্য কোন কুতুবের বা আমাদের মত আলেম-দাঈদের প্রতি মুখাপেক্ষী নন। বাকী, এক্ষেত্রে আমরা নগণ্যরা ওসীলা হয়ে ধন্য হতে পারি কিংবা আমাদেরও জবাবদেহিতার একটা ব্যাপার অবশ্যই রয়েছে; সেটি হল ভিন্ন কথা। তবে, নূন্যতম যোগ্যতা হিসাবে একজন কুতুবের যেমন নিজেকে হিদায়েতপ্রাপ্ত হতে হয় একইভাবে একজন ‘হাক্কানী আলেম’ বা ‘দাঈ‘ এর বেলায়ও তাঁর নিজের হিদায়েতপ্রাপ্ত হওয়া জরুরী।

৫. ‘কুতুব’ যেক্ষেত্রে ‘সৃষ্টিরহস্য’গত বিদ্যা বা কর্মকান্ড বিষয়ক হবেন, সেক্ষেত্রে তাঁর অবস্থান মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সব ‘গ্রাম’ বা শহরেই হতে পারে। যেমনটি উপরে বর্ণিত উদ্ধৃতি অংশ “হোক তা মুমিনদের আবাসস্থল বা কাফিরদের আবাসস্থল”Ñ থেকেও বোঝা যাচ্ছে। বাকী ‘শরীয়াবিদ্যা’ বিষয়ে অভিজ্ঞ ও হিদায়েতের লাইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কুতুব মুসলিম জনপদে বা শহরে অবস্থান করবেন, এমনটাই যেমন স্বাভাবিক যুক্তির দাবী। তার পাশাপাশি হিদায়েত বা দাওয়াতী কর্ম-তৎপরতার অংশ হিসাবে তাঁর সফর-সম্পর্ক-অবস্থান অমুসলিম শহর বা জনপদের সঙ্গেও হতে পারে।

‘কুতুব’ এর অবস্থা কেমন হবে?
৬. ‘কুতুব’ এর অবস্থা কেমন হবে? সেই প্রশ্নে হযরত থানভী র. বলেছেন,
প্রথমত : আল্লাহ্র মনোনীত কুতুবগণের বাহ্যিক অবস্থা প্রশ্নে কারও অবস্থা এমন হবে যে, পাগল-ফকীর ও ময়লা-মন্দ পরিস্থিতি; আবার কারও বাহ্যিক অবস্থা তেমন হবে না অর্থাৎ ভালো ও পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন বা পরিপাটিও হতে পারে; কিন্তু কবূলিয়াত বা গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নে উভয়েই তাঁর কাছে আপনজন ওলী-বন্ধু।
দ্বিতীয়ত : যাদের বাহ্যিক অবস্থা শোচনীয় ও খারাপ মনে হয় তাঁদের মধ্যে আবার দু’প্রকার দেখা যায়। এক শ্রেণির বাতেনী বা আভ্যন্তরীণ বিবেচনায় বুদ্ধি-বিবেক বিলুপ্ত (পাগল-মাজযূব) বলে মনে হয়, আরেক শ্রেণির তেমন ত্রুটি-সমস্যা আছে বলে মনে হয় না। যদিও বাস্তবে এ উভয়শ্রেণিরই সুস্থ্য-স্বাভাবিক লোকজনের অনুরূপ ভারসাম্যপূর্ণ বিবেক-বুদ্ধি অবর্তমান হওয়ায় এবং শরীয়তের বিচারে অনেকটা দেউলিয়া এর মধ্যে পরিগণিত হওয়ায় শরীয়া আইনের বিচারে এঁরা ‘মা‘যূর’ তথা অপারগ হিসাবে গণ্য।

দু’প্রকার কুতুবের ব্যতিক্রমী অবস্থা ও বিধান
সুতরাং এ দ্বিতীয় শ্রেণির দু’প্রকার কুতুব বাহ্যিকভাবে পাগল-মাজযূব বলে মনে হোক বা না হোক; বাহ্যিকভাবে অপরিস্কার-অপরিচ্ছন্ন হোক বা নামায-রোযা পালন করুক বা না করুক; দাঁড়ি-মোচ কাটুক বা না কাটুক Ñএঁরাও আল্লাহ্র মনোনীত বন্ধু ও ওলীÑ আমাদের বুঝে আসুক চাই না আসুক। এঁদের এ অবস্থায় উপনীত হওয়া কিংবা মহান আল্লাহ্র তাঁদেরকে এ অবস্থায় রাখার মধ্যেও তাঁর ‘সৃষ্টিগত রহস্য’ ও ‘আধ্যাত্মিক রহস্য’ কি কি আছে বা থাকতে পারে, তা তিনি নিজেই অধিক জ্ঞাত। তা ছাড়া, আত্মিক পরিশুদ্ধি বিষয়ক তাসাওউফ গ্রন্থাদি পাঠে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হাক্কানী আলেমগণের ব্যাখ্যা-বক্তব্য থেকে যতটুকু বোঝা যায়, তার একটি হল : এসব পাগল-ফকীর থেকে এ অর্থে ও এতটুকু আল্লাহ-প্রেমের সবক গ্রহণ করা যে, এঁরা যেমন তাঁকে পাওয়ার জন্য ঘর-সংসার, সুখ-শান্তি, পরিবার-পরিজন, পানাহার, পোশাক-আসাকসহ যাবতীয় সব কিছুর লোভ-মোহ পরিহার করে জীবন কাটিয়ে দিচ্ছেন। আমাদেরও বাস্তবে তেমনটি না পারলেও কমপক্ষে তেমন নিয়ত-মানসিকতা অবশ্যই থাকা চাই। যার ফলে শরীয়া মাপকাঠি ও তাকওয়া-ত্যাগের সীমা রক্ষা করে আমরাও মহান আল্লাহ্র মনোনীত ওলী ও কুতুবদের তালিকাভুক্ত হতে পারি।


‘কুতুব’ কেবল পাগল-ফকীর হন, আলেমরা হন না?
৭. উপরিউক্ত ক্রমিক-৬ এর “কুতুব এর অবস্থা কেমন হবে?” -এর শ্রেণিবিন্যাসের প্রথম প্রকারের আলোচনা থেকে বোঝা যায়, ‘কুতুব’ কেবল পাগল-মাজযূব বা বন-জঙ্গলে অবস্থানকারীই হবেন তেমনটিই নয়; বরং সুন্নাত ও শরীয়ত মোতাবেক জীবন-যাপনকারী পরিপাটি ও জগত-জীবন, ঘর-সংসার পরিচালনাকারী মুত্তাকী আলেমগণের মধ্যেও বড় একটি দল বা বড়সংখ্যক আলেম ‘কুতুব’ হিসাবে মনোনীত হন এবং কুতুব হিসাবে বিদ্যমান রয়েছেন; যদিও আমরা অনেকে তা আমাদের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক দূর্বল রাডার দ্বারা ধরতে বা হৃদয়ঙ্গম করতে পারি না। তার কারণ, আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ স. এর চেয়ে বড় ওলী, গৌস, কুতুব, আবদাল আর কে হতে পারে? কিন্তু তিনি স. তো পাগল-মাজযূব ও বনে-জঙ্গলে ঘুরে এবং জগত-জীবন ও ঘর-সংসারত্যাগী ওলী-আবদাল ছিলেন না! হাক্কানী আলেমগণও তাঁর পুরোপুরি অনুকরণ-অনুসরণে ঘর-সংসার, স্বজন-পরিবার, সমাজ, দেশ-রাষ্ট্র, মসজিদ-মাদরাসা সবকিছু নিয়ে সেভাবেই জীবন পার করে দিচ্ছেন।

সুতরাং সাধারণ যুক্তিতেও একটা বড়সংখ্যক ওলী-গৌস-কুতুব এঁদের মধ্যেও বিদ্যমান; যদিও তাঁরা তেমনটি দাবী করে বেড়ান না বা প্রকাশ করেন না। আমাদের দায়িত্ব তাঁদেরকে খুঁজে বের করা এবং তাঁদের পরামর্শ ও নির্দেশনা মোতাবেক জীবন যাপন করা।

ওলীগণের বিভিন্ন স্তর-মর্যাদা
৮. হযরত থানবী র. এর উক্ত ছোট্ট ব্যাখ্যা থেকে আরও বোঝা যাচ্ছে, মনোরোগ বা মনোবিদ্যার আধ্যাত্মিক চিকিৎসা বিষয়ক ‘তাসাওউফ’বিদ্যার গ্রন্থাদিতে ‘ওলী-আউলিয়া’ এর যেমন বিভিন্ন স্তর বা মর্যাদা-পদবী বিদ্যমান উদাহরণত ‘গৌছ’, ‘কুতুব’, ‘আবদাল’ ইত্যাদি। একইভাবে এগুলোর এক একটির অধীনেও এক বা একাধিক স্তর-মর্যাদা রয়েছে; যেমন প্রথমশ্রেণির কুতুব, দ্বিতীয় বা মধ্যম স্তরের বা তৃতীয়শ্রেণির কুতুব এবং সর্বোচ্চ মর্যাদার তথা ‘কুতুবুল-আকতাব’ মর্যাদার কুতুব ইত্যাদি। Ñগ্রন্থকার

৯. এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, আলোচিত ‘ফাতূহাতে মাক্কীয়া’ গ্রন্থটি তো কোন হাদীস-তাফসীরের গ্রন্থ নয়। তাই গ্রন্থকারের ‘কুতুব’ বিষয়ক এসব বক্তব্য বা ওলীগণের তেমন স্তরবিন্যাস কতটুকু গ্রহণযোগ্য হতে পারে? তার জবাব হচ্ছে, মহান আল্লাহ্র নৈকট্যপ্রাপ্ত ওলীগণের এমন স্তর-মর্যাদা বা পদবিন্যাস হাদীস-তাফসীরের গ্রন্থাদিতেও বিদ্যমান; যা মুফতী- ইসলামিক ফাউন্ডেশন এর ‘ফাতাওয়া ও গবেষণা সমগ্র’-২ এর বিভিন্ন অধ্যয়ে দলীল-প্রমাণসহ সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে।


লেখক: মুফতী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (1)
A. M. JAHANGIR ALAM ২ জানুয়ারি, ২০২৩, ১০:৪৯ এএম says : 0
তাসাওউফ : ‘কুতুব’ কারা ও অবস্থান কোথায় anek kichu jante parlam
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন