মাওলানা মোঃ হাবিবুর রহমান : পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.) উদযাপন বিশ্ব মুসলিমের জন্য অতিশয় আনন্দ ও পুণ্যের কাজ।“ঈদে মিলাদুন্নবী” (সা.) মূলত হুজুর পাক (সা.)-এর প্রতি আন্তরিক মহব্বতের বহিঃপ্রকাশ এবং ইহা পবিত্র ইসলামের শান-শওকতও বটে। যে সকল দিবসগুলো আল্লাহর কাছে অতিব প্রিয় ও পুণ্যময় সেসব দিবসের মধ্যে শীর্ষস্থানীয় ও মহান দিবস হল “মিলাদুন্নবী (সা.) দিবস। এই দিবসেই মহান আল্লাহপাকের শ্রেষ্ঠ নেয়ামত বা অনুগ্রহ রাব্বুল আলামিনের প্রিয় বন্ধু হাবিব রাহমাতাল্লিল আলামিন এ ধরাদামে তাশরিফ এনেছেন। যাকে সৃষ্টি না করলে আল্লাহপাক কিছুই সৃষ্টি করতেন না। হাদীসের ভাষায়, “লাওলাকা লামা খালাকতুল আফলাক”। অর্থাৎ হে হাবিব আমি যদি আপনাকে সৃষ্টি না করতাম তাহলে কোন কিছুই সৃষ্টি করতাম না । মিলাদ শব্দটির অভিধান পর্যালোচনা করলে মিলাদ ‘মাওলেদ’ ও মৌলুদ তিনটি রূপ পরিলক্ষিত হয়, ছেরাহ্’ নামক অভিধান অনুসারে ‘মিলাদ’ অর্থ-জন্মস্থান, ‘আর মাওলেদ’ অর্থ জন্মকাল। গেয়াছুল লোগত, নামক অভিধানে ‘মিলাদ’-এর অর্থ লিখা হয় ‘জন্মকাল’। ফরহাঙ্গে রাব্বানীতে ‘মিলাদ’ মানে জন্মদিন আর মৌলুদ মানে নবজাত শিশু এবং মিলাদুন্নবী (সা.)-এর অর্থ রাসূলুল্লাহ (সা.) -এর জন্মদিন লিখা হয়েছে সুতরাং মিলাদুন্নবী মাওলেদ ও মৌলুদুন্নবী (সা.)-এর মানে হল আমাদের নূরনবী (সা.)-এর জন্মদিন, জন্ম কাহিনী এবং তদ্সম্পর্কিত ঘটনাবলীর আলোচনা আর ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) হল হুজুর রাহমাতাল্লিল আলামিন (সা.)-এর পবিত্র জন্মদিনের খুশি উদযাপন এবং এতদুপলক্ষে মাহলিফ, দুরুদ, জুলুছ, (মিছিল) আলোক সজ্জা, উরছুন্নবী, তার মহান জীবনী আলোচনা, তার উছওয়াহ হাছানা, বা মহান আদর্শ প্রতিফলনের উদ্দেশ্যে ব্যবস্থাপনা ও আয়োজন। ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এর প্রমাণ। পবিত্র জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করার জন্য নি¤œ আয়াতে আমরা মহান আল্লাহর নির্দেশ পাই। মহান আল্লাহ বলেন “কুল বি ফাদলিল্লাহি ওয়া বিরাহমাতিহি ফাবিজালিকা ফাল্ইয়াফরাহু, হুয়া খাউরুম্ মিম্মা ইয়াজমাউন’’ অর্থাৎ হে হাবীব! আপনি বলেদিন তোমরা আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া লাভ করলে, সেটার উপর খুশি উদ্যাপন করো। উহারা যাহা পুঞ্জিভূত করে তাহা অপেক্ষা উহা শ্রেয়। (সূরা ইউনুস আয়াত নং ৫৮) তাইতো ১২ইং রবিউল আউয়াল আসলে মু’মিনগণ নবী (সা.) এর প্রেমে উজ্জীবিত হয় নবী প্রেমে মাতোয়ারা ও আনন্দে আত্মহারা হয় পবিত্র ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (সা.) পালন করে থাকে। নবীয়ে দো জাঁহা (সা.) যে, সমস্ত আলমের (জগতের) জন্য রহমত। তিনি যে রাহমাতাল্লিল আলামিন পবিত্র কোরআনেই তো তার উজ্জল প্রমাণ রয়েছে। মহান আল্লাহপাক বলেন- “ওমা আরছাল নাকা ইল্লা রাহমাতাল্লিল আলামিন। অর্থাৎ- হে হাবিব! আমি তো আপনাকে বিশ্ব জগতের প্রতি কেবল রহমত রূপেই প্রেরণ করেছি। (সূরা আম্বিয়া আয়াত নং- ১০৭)। নবীয়ে দোজাঁহা রাহ্মাতাল্লিল আলামিনের আগমনে যখন সারাবিশ্বময় আনন্দিত ছিল তখন একজনের গায়ে ছিল প্রচ-তম জ্বালা বা দাহ্ আর সেই বেজার ব্যক্তিটির নামই হল মিঃ ইবলিশ আর এখন তার অনুসারিবৃন্দ।
নি¤েœাক্ত আয়াতে ও আমরা একই নির্দেশ পাই। মহান আল্লাহ বলেন, “ওয়াজকুরু নি’মাতাল্লাহে আলাইকুম’’ অর্থাৎ- তোমরা তোমাদের প্রদত্ত নিয়ামতের (সম্পদের) স্মরণ করো। (সূরা বাকারা আল্ কোরআন) এ আয়াতে যে নিয়ামত স্মরণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে তন্মধ্যে অন্যতম নিয়ামত হল হজরত রাসূলে করিম (সা.) অর্থাৎ তাঁকেই স্মরণ করার নিদের্শ দেয়া হয়েছে। তিনি যে, আল্লাহপাকের নেয়ামত তা নি¤েœর আয়াত দ্বারা সুষ্পষ্ট। আল্লাহ বলেন- “ওয়াইন তাউদ্দু নি’মাতাল্লাহে লাতুহ্ছুহা’’ অর্থাৎ- তোমরা আল্লাহর নিয়ামত গণনা করে শেষ করতে পারবে না। (আল কোরআন সূরা নাহল) এ আয়াতের তাফসিরে হজরত ছাহাল বিন আব্দুল্লাহ তুছতরী (রা.) বলেন- যে নিয়ামত গণনা করে শেষ করা যাবে না তা হলো হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) যাকে ঈমানের প্রথমেই স্মরণ করা হয়। অন্য এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা ফরমায়েছেন- “আলাম তারা ইলাল্ লাজিনা বাদ্দালু নিয়ামাতাল্লাহ’’ অর্থ- হে নবী! আপনি কি ঐ সমস্ত লোকদেরকে দেখননি (অর্থাৎ দেখছেন) যারা আল্লাহর নিয়ামতকে পরিবর্তন করে কুফুরী করেছে। (আল্ কোরআন সূরা ইব্রাহীম) এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফাস্রীর কুল স¤্রাট হজরত ইবনের আব্বাস (রা.) বলেন, নিয়ামত পরিবর্তনকারীরা হল কুরাইশীয় কাফের এবং নিয়ামত হলেন হজরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.), অর্থাৎ তারা তাঁর বিরোধিতা করে, তাঁর অবির্ভাবে বিরক্তি বোধ করে কুফুরী করেছে। (জুরকানী) পবিত্র কোরআনের আর একটি বাণী : “ওয়া জাক্কিরহুম বি অইয়্যামিল্লাহ’’ অর্থ- হে নবী আপনি তাদেরকে আল্লাহর দিনগুলো স্মরণ করিয়ে দিন। (আল কোরআন সূরা ইব্রাহিম) এ আয়াতে দিনগুলো বলতে ঐতিহাসিক ঘটনাসম্পন্ন দিনের কথাই বুঝানো হয়েছে। যেমন হুজুর করীম (সা.)-এর মিলাদ দিবস হল একটি অন্যতম ঐতিহাসিক দিবস, কেননা এ দিনেই তো পারস্যের পূজার উদ্দেশ্যে প্রজ্বলিত হাজার হাজার বৎসরের অগ্নিকু- হঠাৎ নির্বাপিত হয়ে যায়, মুসলিম উম্মাহর মিলনকেন্দ্র বাইতুল্লাহ্ শরীফ সিজদায় ঢলে পড়ে, মা আমেনা (রা.) তাঁর চোখের সামনে উদ্ভাসিত আলোকরশ্মি দিয়ে সুদূর রোম স¤্রাটের রাজ প্রাসাদ দেখতে পান ইত্যাদি। কোরআন শরীফে এসব ঘটনা সম্বলিত মহান দিবসটি আলোচনা করার লোকদেরকে সেগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। আল্লাহর নবীর রাহমাতাল্লিল আলামিনই হলেন আল্লাহপাকের সর্ববৃহৎ নিয়ামত, অনুগ্রহ ও দয়া যাহা পবিত্র কোরআনুল কারিম দ্বারা উজ্জল সূর্যের মত প্রমাণিত আর তিনি নিজেইত সূর্যের ও সূর্য, সূর্য মূলত তাঁর নূর মোবারক হইতেই নূর (আলো) পায় তাইতো কোরআনে পাকে তাঁকে সিরাজুম মুনিরা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। তাই নিঃসন্দেহে আল্লাহর এই শ্রেষ্ঠ নিয়ামত, অনুগ্রহ ও দয়া মু’মিনদেরকে দান করে আল্লাহপাক এহছান জিতিয়েছেন। এ লক্ষ্যে ইরশাদ করেন: “লাকাদ মান্নাল্লাহা আলাল মু’মিনিনা ইজ বায়াছা ফিহীম রাছুলাম........লাফি দালালিম্ মুবিন। অর্থ- নিশ্চয় আল্লাহর মহান অনুগ্রহ হচ্ছে মু’ মিনদের উপরে যে, তাদের মধ্যে তাদেরই মধ্য থেকে একজন রাসূল প্রেরণ করেছেন, যিনি তাদের উপর তার আয়াতসমূহ পাঠ করেন, তাহাদিগকে পরিশোধন করেন তাদেরকে কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেন, এবং তারা নিশ্চয় এর পূর্বে স্পষ্ট গোমরাহিতে ছিল। (সূরা আল্ েইমরান, আয়াত নং-১৬৪) এই মহান উদ্দেশ্য প্রতিফলনের উদ্দেশ্যেইত আল্লাহর খলিল মুসলমানদের জাতীর পিতা হজরত ইব্রাহিম আলাইহে ওয়া সাল্লাম ও তার পুত্র ইসমাঈল (আঃ) কাবাঘর উত্তোলন করে তার সন্তানদের কল্যাণে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মুক্তির জন্য মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে প্রার্থনা করেছিলেন এই বলে যে- “রাব্বানা ওয়াব আছ ফিহিম রাছুলাম ............... ইন্নাকা আনতাল আজিজুন হাকিম’’ অর্থ- হে পরোয়ারদিগার! তাদের মধ্য থেকেই তাদের নিকট একজন পয়গাম্বর প্রেরণ করুন যিনি তাদের কাছে তোমার আয়াতসমূহ তিলাওয়াত করবেন, তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দিবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন, নিশ্চয় তুমিই পরাক্রমশালী হিকমত ওয়ালা। (সূরা বাকারা আয়াত নং-১২৯) এই দোয়ায় নিজের বংশধরের মধ্যে থেকেই পয়গাম্বর হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এর কারণ প্রথমত এই যে, এটা তার সন্তানদের জন্য গৌরবের বিষয়। দ্বিতয়ত, এতে তাদের কল্যাণও নিহিত রয়েছে। কারণ, সগোত্র থেকে পয়গাম্বর হলে তাঁর চাল-চলন ও অভ্যাস-আচরণ সম্পর্কে তারা উত্তমরূপে অবগত থাকবেন। ধোঁকাবাজী ও প্রতারণার সম্ভাবনা থাকবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন