মুহাম্মদ আবদুর রহীম ইসলামাবাদী : বাংলা ইসলামী সাহিত্যের অগ্রপথিক ইসলামী রেনেসাঁ আন্দোলনের অগ্রদূত মুসলিম উম্মাহর দরদী বন্ধু, দূরদর্শী ইসলামী চিন্তাবিদ, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী ব্যক্তিত্ব আমার প্রিয় লেখক মাসিক মদীনা সম্পাদক হযরত আল্লামা মাওলানা মুহিউদ্দীন খান সাহেব অবশেষে আমাদের শোক সাগরে ভাসিয়ে পরম প্রিয় মাওলা পরওয়ারদিগারে আলম আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯ রমযান ১৪৩৭ হিজরী/২৫ জুন, ২০১৬ ইং শনিবার পরপারে চলে গিয়েছেন। তিনি এখন আলমে বরযখের বাসিন্দা।
ষাট বছরব্যাপী তাঁর কর্মজীবন ও অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। অনুপ্রেরণা যোগাবে মানুষকে যুগের পর যুগ। ৮১ বছর বয়সে তাঁর ইন্তেকাল হয়। ১৯৫৫ ও ১৯৫৬ সনে তিনি মাদ্রাসা-ই-আলীয়া ঢাকা থেকে কামিল হাদিস ও কামিল ফেকাহ পাস করেন।
হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.) ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এক বিশাল ইসলামী ব্যক্তিত্ব। জ্ঞান সাধনা, ইসলামী শিক্ষা বিস্তার, জনসেবা, ইসলামী রাজনীতি, সাহিত্য ও সাংবাদিকতা, আধ্যাত্মিক সাধনাসহ সর্ব ময়দানে তিনি কাজ করেছেন, অবদান রেখেছেন। তাঁকে একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব বলা চলে।ৎ উপমহাদেশের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় আলেমকে তিনি পেয়েছিলেন উস্তাদ হিসেবে। তাঁরা হলেন শায়খুল ইসলাম আল্লামা জাফর আহমদ উসমানী (রহ.), হযরত আল্লামা মুফতী সৈয়দ আমিনুল এহসান মুজাদ্দেদী (রহ.), বিখ্যাত সাহিত্যিক হযরত আল্লামা আবদুর রহমান কাশগরী (রহ.) প্রমুখ। তাঁর আধ্যাত্মিক মুরশিদ ছিলেন হাফেজুল হাদীস আল্লামা আবদুল্লাহ দরখাস্তী (রহ.), আল্লামা সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) ও শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল মোমিন হবিগঞ্জী। আল্লামা মুফতী আমিমুল এহছান মুজাদ্দেদী (রহ.)-এর কাছ থেকেও তিনি হাদীস, তাফসীর ও ফেকাহ শাস্ত্রের সাথে আধ্যাত্মিক ময়দানের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য। বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআন শরীফের তাফসীর তিনি জাতিকে উপহার দেন। ৮ খ-ে সমাপ্ত বিখ্যাত তাফসীর গ্রন্থ ‘মাআরেফুল কুরআন’ নামক উর্দু তাফসীরের তিনি অনুবাদ করেন যা ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ কর্তৃক প্রকাশিত হয়। সৌদি আরব থেকে এটি সংক্ষিপ্ত আকারে ১ খ-ে প্রকাশিত হয়। আল্লামা বদরে আলম মিরেঠী (রহ.) কর্তৃক লিখিত হাদিস সংকলন ‘তরজুমানুসসুন্নাহ’র অনুবাদও তিনি করেন। মুসলিম শরীফ থেকে সংকলিত নির্বাচিত হাদিসের একটি উর্দু অনুবাদও তিনি বাংলায় তরজুমা করেন। যা প্রথমে মাসিক মদীনায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়। হযরত মাওলানা মুহিউদ্দীন খান (রহ.) বাংলা ভাষায় সবচেয়ে বেশী সীরাত গ্রন্থ অনুবাদ করেন। বাংলাদেশী আলেমদের মধ্যে এ বিষয়ে তিনি অগ্রপথিক। আল্লামা শিবলী নোমানী (রহ.) ও আল্লামা সৈয়দ সুলাইমান নদভী (রহ.) লিখিত বিখ্যাত সীরাত গ্রন্থ ‘সীরাতুন্নবী’ এর অনুবাদ করেন তিনি। শায়খুল হাদীস আল্লামা যাকারিয়া কান্দলভী (রহ.) লিখিত শামায়েলে তিরমিযীর উর্দু অনুবাদ ও ব্যাখ্যার বাংলা অনুবাদ করেন তিনি। মাসিক মদীনায় তিনি ৫০ হাজারের বেশী প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ফেকাহ্, হাদীস, তাফসীর, সীরাত, ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়ের প্রশ্নের উত্তরগুলো ‘সমকালীন জিজ্ঞাসার জবাব’ নামেও প্রকাশিত হয়। ‘এহইয়ায়ে উলুমুদ্দীন’ সহ হযরত ইমাম গাজ্জালীর (রহ.) বেশ কয়েকটি গ্রন্থও তিনি অনুবাদ করেন। আলেম সমাজের ইতিহাস সংক্রান্ত একটি বড় বইও তিনি প্রকাশ করেন। এ পর্যন্ত দুই শতাধিক মৌলিক ও অনুবাদগ্রন্থ তিনি পাঠকদের উপহার দেন।
আরবী জানা ও বুঝার জন্য আরবী-বাংলা ও বাংলা আরবী অভিধানের গুরুত্ব অনেক বেশী। তাই তিনি ‘আল কাউসার’ নামক অভিধান রচনা, সম্পাদনা ও প্রকাশ করে এ শূন্যতা পূরণ করেন। এলমে তাছাওউফের উপর কয়েকটি মৌলিক গ্রন্থও তিনি প্রকাশ করেন। শত শত নয় হাজার হাজার লেখক, অনুবাদক, সম্পাদক, সাংবাদিক প্রবন্ধকার তার চেষ্টা, পরামর্শ ও পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠে। লাখ লাখ পাঠক তৈরীর পেছনেও তাঁর রয়েছে বিরাট ভূমিকা। আল্লামা শিবলী নুমানী (রহ.) লিখিত ‘আল-ফারুক’ নামক বিখ্যাত গ্রন্থটি তিনি যুব বয়সে অনুবাদ করেন যা এমদাদিয়া লাইব্রেরী, চকবাজার, ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়। হযরত মাওলানা ইলিয়াছ (রহ.) ও তাবলীগ জামাত সম্পর্কে তাঁর একটি বই রয়েছে। ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন চেষ্টা চালান। জমিয়তে তালাবায়ে আরাবিয়ার তিনি কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ-এর কেন্দ্রীয় নির্বাহী সভাপতি ছিলেন। জাতীয় সীরাত কমিটির তিনি সভাপতি ছিলেন। আন্তর্জাতিক সংস্থা বাবেতায়ে আলমে ইসলামীর তিনি কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ছিলেন। মোতামার আলমে ইসলামী নামক সংস্থার বাংলাদেশ শাখার সভাপতি ছিলেন। আঞ্জুমানে তালিমুল কুরআন সংস্থার সভাপতি ছিলেন। যার মাধ্যমে প্রতি রমযান মাসে তাফসীরুল কুরআনের উপর প্রশিক্ষণ হয় ঢাকায়। আল্লামা আহমদ আলী লাহোরী (রহ.)-এর শাগরিদ আল্লামা শামসুদ্দীন কাসেমী (রহ.) দীঘর্ কাল এই কোর্স পরিচালনা করেন ঢাকা মিরপুর জামেয়া হোছাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ মাদ্রাসায়। এখনো তার শাগরিদ্রা এ কোর্স চালিয়ে যাচ্ছেন। এ কোর্সের মাধ্যমে হাজার হাজার মুফাস্সিরে কুরআন তৈরী হয়েছেন। বিখ্যাত আলেম আল্লামা ছৈয়দ মো: ইউসুফ বানুœরী (রহ.), আল্লামা গোলাম গউছ হাজাররী (রহ.), আল্লামা মুফতী মাহমুদ (রহ.), হযরত মাওলানা আতহার আলী (রহ.), হযরত মাওলানা সৈয়দ মুসলেহ উদ্দীন (রহ.), খতীবে আযম হযরত মাওলানা সিদ্দীক আহমদ (রহ.), হযরত মাওলানা শামছুল হুদা পাচবাগী (রহ.), হযরত মাওলানা শামছুল হক ফরিদপুরী (রহ.), হযরত মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (রহ.), হযরত মাওলানা মোহাম্মদ উল্লাহ, হাফেজ্জী হুজুর (রহ.), মাওলানা সৈয়দ আবদুল আহাদ আল মাদানী (রহ.), শায়খুল হাদিস হযরত মাওলানা হেদায়েত উল্লাহ (রহ.), হযরত মাওলানা নুর মোহাম্মদ আজমী (রহ.), শর্শিনার শায়খুল হাদীস আল্লামা নিয়াজ মাখদুম খোত্তানী হুজুর (রহ.), হযরত মাওলানা মীর মুহসেন উদ্দীন আহমদ দুদুমিয়া (রহ.), সিলেটের হযরত মাওলানা হাফেজ আবদুল করীম শায়খে কেšড়িয়া (রহ.), হাটহাজারী মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস আল্লামা আবদুল আজিজ (রহ.), নারিন্দার পীর হযরত মাওলানা সৈয়দ নজর ইমাম মোহাম্মদ (রহ.), ফুরফুরাবাদ পীর হযরত মাওলানা আবদুল কাহ্হার সিদ্দিকী (রহ.), শর্শিনার পীর হযরত মাওলানা আবু জাফর মো: ছালেহ (রহ.), হযরত মাওলানা আশরাফ আলী ধরমগুলী (রহ.), শায়খুল হাদীস আল্লামা আজিজুল হক (রহ.), হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেব, চট্টগ্রামের হযরত মাওলানা আবদুস সাত্তার শাহ সাহেব (রহ.), বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতীব ও মাদ্রাসা-ই-আলীয়া ঢাকা এর সাবেক হেড মাওলানা ওবায়দুল হক, হযরত মাওলানা আমিনুল হক মাহমুদী (রহ.), বায়তুশ শরীফের পীর হযরত মাওলানা শাহ আবদুল জাব্বার (রহ.) প্রমুখ তাঁকে খুবই ভালবাসতেন।
তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে ছিলেন সাবেক মন্ত্রী, দৈনিক ইনকিলাব-এর প্রতিষ্ঠাতা ও বাংলাদেশ জমিয়তুল মোদাররেসীনের সভাপতি আলহাজ মাওলানা এম.এ মান্নান (রহ.), মুফতী আমিমুুল এহছান মুজাদ্দেদী (রহ.)-এর ভাগিনা হযরত মাওলানা কাজী ছালেম ওয়াহেদী, তাফসীরে নুরুল কোরআনের লেখক হযরত মাওলানা আমিনুল ইসলাম (রহ.), দৈনিক সংগ্রামের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক অধ্যাপক মাওলানা আখতার ফারুক (রহ.), দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী, তাবলিগী নেছাবের অনুবাদক হযরত মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ (রহ.), চট্টগ্রাম দারুল মাআরিফ আল ইসলামিয়া এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ এর সাবেক মহাপরিচালক সাবেক সচিব এ.জেড.এম শামসুল আলম, হযরত মাওলানা আবদুল বাতেন (রহ.), তিব্বিয়া হাবিবিয়া কলেজ, ঢাকা এর সাবেক প্রিন্সিপাল হাকিম হাফেজ আজিজুল ইসলাম (রহ.), মাওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতি (রহ.), হযরত মাওলানা আবদুল্লাহ (রহ.), হযরত মাওলানা আবদুল আজিজ (রহ.)। অনেক জুনিয়র এমনকি নিজ শাগরিদতুল্য জ্ঞানী ব্যক্তিদের সাথেও তিনি বন্ধুদের ন্যায় ব্যবহার করতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাসিক মদীনা দীর্ঘজীবি হোক। সাপ্তাহিক মুসলিম জাহান নিয়মিত প্রকাশিত হোক। বাংলা ভাষায় আরো যে সমস্ত বই কিতাব প্রকাশে তাঁর আগ্রহ ও প্রচেষ্টা ছিল সেগুলো প্রকাশিত হোক। এটাই আজ আমাদের একান্ত কামনা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন