বিয়ে জীবনের একটি বড় অধ্যায়। জীবন চলার ক্ষেত্রে যে কয়েকটি বড় পয়েন্ট রয়েছে তার মধ্যে বিয়ে জীবনের মাঝপথের গুরুত্বপূর্ণ একটি পয়েন্ট। একজন মানুষের শিশুকাল, কৈশরকাল পার করে যখন যৌবন দরিয়ায় সাতার কাটতে থাকে। এ সাতারের মাঝে বিপীরত লিঙ্গের একজন এসে তার হাত ধরে বিয়ে নামক এ বন্ধনের মাধ্যমে। এর পরবর্তী জীবনে সুখের পায়রা উড়বে না দু:খের কোনো অজানা গহ্বরে তলিয়ে যাবে তা নির্ণয় করে দেবে বিয়ে। তাই মানুষ বলতেই চায় তার জীবনসঙ্গী যেন হয় তার সুখের সুখপাখি। গ্রাম, শহর-বন্দরে খুঁজে বেড়ায় বাকি জীবনের চলার পথের পুষ্পকে। যে পুষ্পে থাকবে না কোনো কাঁটা। যে ফুলের ঘ্রাণে তার ছোট কুড়ে ঘর হবে ঘ্রাণময়। যে ফুলের হাসিতে তার সারা জীবনের সকল যাতনা দূর হয়ে উদ্ভাসিত হবে তৃপ্তির রেখা। মন থেকে তালাশ করে জোছনা ছড়ানো একটি চাঁদকে। যে চাঁদের আলোয় আলোকিত হবে তার পুরো জগত। উভয়ে সে জোছনায় বিচরণ করবে। মায়ময় চাঁদের হাসিতে উচ্ছ্বল ও উদ্বেল হয়ে উঠবে তাদের তনুমন। বাকি জীবন সে জোছনার জোয়ারে কাটিয়ে দিবে। তাই বিয়ে জীবন জুড়ে বড় একটি ফেক্ট। বিয়েকে হেলাখেলা মনে করলে চলবে না। জীবনের বড় একটি সিদ্ধান্ত হলো বিয়ে। যে সিদ্ধান্ত নিতে হবে সঠিকভাবে। বিয়ে শুধু যৌবনের জৈবিক চাহিদা মিটানোর নাম নয়। বরং একটি বন্ধন, একটি ঘর, একটি সমাজ ও একটি রাষ্ট্র, একটি জাতি বিনির্মাণে বিয়ে প্রয়োজন। একটি বিয়ের কারণে গোটা দেশ আলোকিত হতে পারে আবার হতে পারে ব্যর্থ। তাই বিয়ে নিয়ে যেমন যে বিয়ে করবে সে ভাবতে হবে তেমনি ভাবতে হবে ঘরের লোক, সমাজের লোক এবং সর্বপরি রাষ্ট্র। বিয়েকে সহজ ও সুশৃংখলের মধ্যে যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্র আনতে ব্যর্থ হবে ততক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রের সফলতাও ব্যর্থতার গ্লানিতে রূপান্তরিত হবে। কারণ বিয়ে আগামী প্রজন্ম তৈরি করবে। সুতরাং আমরা আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কৃতি কার হতে তুলে দিচ্ছি তা ভাবতে হবে আজকের সমাজকে। অন্যদিকে ধর্মীয় দিক দিয়েও বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। ইসলাম ধর্মে বিয়েকে ঈমানের অর্ধেক বলে অভিহিত করেছে। বিয়েকে পবিত্র জীবনের মাইলফলক হিসেবে সাব্যস্ত করেছে। বিয়ে ধর্মের দৃষ্টিকোণ থেকে অন্যায় কাজ থেকে বাঁচার এক মাধ্যম। তাই বিয়েকে ধর্মে অধিক গুরুত্ব দিয়ে আসছে। ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সা.) বিয়েকে তাঁর সুন্নাত বলেছেন আরও বলেছেনÑ যদি সুন্নাত পালন না করে সে তাঁর দলভুক্ত নয়। এটি একটি বড়ই কঠিন কথা। বুঝতে পারলাম ধর্মীয় দিক থেকেও বিয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সুতরাং আমাদেরকে এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে তাতে যে সমস্যাগুলো আছে তা দূর করা আসূ প্রয়োজন।
বিয়ে সহজ করা: মানুষের জীবনে যে জিনিস অতি বেশি প্রয়োজন, আমরা দেখতে পাই তা পাওয়া অতি সহজ। মানুষসহ সকল প্রাণী বেঁচে থাকার জন্য প্রথম যে জিনিসটি প্রয়োজন তা হলো বাতাস বা অক্সিজেন। এই বাতাস যত বেশি প্রয়োজন ততবেশি সহজলভ্য। আমরা সহজে শ^াস-প্রশ^াস গ্রহণ করছি। এরপর পানি, আগুন ইত্যাদি। এ বস্তুগুলোও কিন্তু আমরা অতি সহজে পাই। এরপর পর্যায়ক্রমে জিনিসের চাহিদা অনুপাতে দাম বাড়তে থাকে। জীবন চলার ক্ষেত্রে বিয়ে একটি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তাই তাও অতি সহজ হওয়া প্রয়োজন। যাতে বিয়ে করতে গিয়ে মানুষ হিমশিম না খায়। যে জিনিস আনন্দের তা যেন বেদনায় পরিণত না হয়।
মূলত বিয়ে চারটি বস্তু পাওয়া যাওয়ার নাম। অর্থাৎ এ চারটি বস্তু পাওয়া গেলে বিয়ে হয়ে যাবে। বিয়ে কত সহজ? চারটি হলো, ইজাব, প্রস্তাব দেয়া, কবুলÑ প্রস্তাব গ্রহণ করা, আর দুই বা তিনজন সাক্ষী অর্থাৎ এ প্রস্তাব ও গ্রহণ করা উভয়টি সাক্ষী নিজ কানে শোনা আর স্ত্রীর জন্য মহরানা নির্ধারণ করা। এ চারটি বিষয় এত কঠিন নয় যে তাকে ভয় পাবো, কিন্তু এ চারটি বিষয়কে আমরা এতই কঠিন করে নিয়েছি যে, এখন আমরা বিয়ের নাম শুনলে ভয় পাই। আমরা বুঝতে পেরেছি, বিয়ে কয়েকজন মানুষ মিলে স্বল্প সময়ে, স্বল্প কথায়, স্বল্প খরচে সংঘঠিত করা যায়।
বিয়ের বয়স হলেই মা-বাবা ও অভিভাবকের দায়িত্ব ছেলে ও মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়া। ধর্মীয় দৃষ্টিতে বলতে গেলে বলতে হয় যদি মা-বাবা অভিভাবক বা সমাজ এ সহজ জিনিসকে কঠিন করে বিয়ে করতে ছেলে-মেয়ের দেরী হয়, তখন তারা যদি কোনো অপকর্ম করে তখন তার দায়ভার তাদের উপর এবং তাদের মা-বাবা, অভিভাবক ও সামাজের উপরও সমানভাবে বর্তাবে। আমাদেরকে বিয়ে সহজ থেকে সহজ করার চিন্তা করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
বিয়েতে অপসংষ্কৃতি: যা বলছিলাম বিয়ে আনন্দের একটি বিষয় তা যেন বেদনায় পরিণত না হয়; কিন্তু বর্তমানে আমাদের চারপাশে এমন পরিবেশ তৈরি হয়েছে যেন বিয়ে একটি আতঙ্কের নাম। বিয়ের কথা শুনলে হাসার কথা ছিল, হৃদয়ে তৃপ্তির ঢেকুর উথলে উঠার কথাছিল, কিন্তু বর্তমানে বিয়ের কথা শুনলে যুবকদের মুখ যেন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। রীতিমত বিয়ে একটি ভয়ের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিয়ে বর্তমানে কঠিন থেকে কঠিন বিষয় হয়ে দানবের মত আমাদের জীবনে দ-য়মান। এর কয়েকটি কারণ।
অতি খরচের চাপ: দেশের সর্বত্রই এখন বিয়েটি বড় একটি খরচের ফিরিস্তির নাম। বিয়ে হওয়া মানে বিশাল এক এলাহীকা-ের আয়োজন তাই অনেক ছেলে এ খরচের কারণে বিয়ে করতে ভয় পাচ্ছে। তবে এ খরচটি বেশিরভাগেই মেয়ে পক্ষ করতে হয়। তাই মেয়ের বাবা নিরবে চোখের অশ্রু ফেলে। এ অশ্রু দেখার যেন কেউ নেই। অবাক কা- যে ব্যক্তি নিজেই অশ্রু ফেলছে সেই একই ব্যক্তি নিজের ছেলের জন্য বউ ঘরে নিয়ে আসছে অন্যকে চোখের জল ফেলতে বাধ্য করে। এত খরচ না করলেও একটি বিয়ে হয়। পূর্বে বলা হয়েছে বিয়ে শুধু চারটি বস্তুর নাম, ইজাব, কবুল, সাক্ষী, মহরানা। এ চারটি জিনিসের জন্য এত খরচ প্রয়োজন পড়ে না। খরচের মধ্যে, পাঁচশ বা হাজার লোক খাওয়ানো। অতি বেশি মহরানা নির্ধারণ, মেয়ের জন্য কাপড়-গয়নায় অতিরিক্ত খরচ করা ইত্যাদি।
খাওয়ানো: বিয়েতে তিন চার দিন খাওয়ার মহড়া চলে, ছেলের বাড়ি, মেয়ের বাড়ি আবার ছেলের বাড়ি আবার মেয়ের বাড়ি ইত্যাদি। আবার বিভিন্নভাবে খাওয়ানো। ছেলের সাথের লোক, মেয়ের সাথের লোক, বাবা-মার সাথে, বোনের সাথে এবং সামাজিক ও আত্মীয়-স্বজন ইত্যাদি ধরণের ভাগে ভাগে লোক খাওয়ানো। আবার এতে চলে রাগ অভিমানের পালা, কোথাও ঝগড়া ও মারপিট এমনকি হত্যা পর্যন্ত হয় এ খাওয়ার জন্য। কোথাও বিয়েও ভেঙ্গে যায় এ খাওয়ানোকে কেন্দ্র করে। সমাজচ্যুতও হয় অনেকে সামাজিক লোক না খাওয়ানোর কারণে। আবার খাওয়ার পরে চলে এ খাবারের দোষ খোঁজাখুজি। রোস্ট দেয়নি, চিংড়ি দেয়নি, ফিরনী দেয়নি ইত্যাদি এ নিয়ে চলে আরেক দফা কাদা ছুড়াছুড়ি। অনেক স্থানে শুনি এমন আইটেম না দেয়াতে বিয়ে ভেঙ্গে বর পক্ষ বা কনে পক্ষ চলে গেছে। এখন যেন মনে হচ্ছে বিয়ে যেন খাওয়ার নাম। বিয়ে থেকে খাওয়াই গুরুত্ব যেন। বড় পরিতাপের বিষয় এতে পিষ্ট হচ্ছে দু’পরিবার। কিন্তু মুখ খুলে কেউ বলতে পারছে না। মুখে সবার হাসি এ হাসির ভেতর যে কত কষ্ট তা অভিভাকরাই বুঝে।
যৌতুক: বর্তমানে যৌতুক শব্দটি কেউ বলে না, বলে খুশি হয়ে উপহার দিয়েছে। আচ্ছা একটি প্রশ্ন রাখা যায়, উপহারের বিষয় হলো ইচ্ছাধীন, যে যা দিতে পারে এবং উপহারের বিষয় যত কমই হোক তা উপহার এবং তা নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না। বর্তমানে যৌতুক নয় ছেলেকে সম্মানী দেয়া হচ্ছে। তবে এ সম্মানী যদি কম হয় তখন বউয়ের উপর চলে অত্যাচার। এটি কেমন সম্মানী হলো বোধগম্য নয়। মেয়ের বাড়ি থেকে টাকা আসুক, বা খাট-পালং আসুক, হুন্ডা আসুক বা ফ্রিজ আসুক, আম-কাঠাল, শীতের পিঠা, কুরবানীর ছাগল বা গরু, ছেলে- মেয়ে জন্মগ্রহণ করলে চাউল, ডাউল ছাগল বা গরু, চাই আরো ছোট ও বড় কোনো জিনিস তা যৌতুকের অন্তর্ভুক্ত। খুশি হয়ে দিক বা অসন্তুষ্ট হয়ে দিক; আর যৌতুক একটি সামাজিক ব্যধি। এটি ধর্মীয়ভাবেও নিকৃষ্ট একটি বিষয়। এ প্রথা সমাজ থেকে দূর করতে হবে। না হয় এটি আরো বড় আকার ধারণ করে পুরো সমাজকে গ্রাস করে শেষ করে দিবে।
এমনিতে এগুলোর কারণে অনেক ঘর ভেঙ্গে যাচ্ছে। অনেক পরিবারে ঝগড়া চলছে। অনেক পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এমনকি এর কারণে অনেক স্বামী ও স্ত্রী হত্যা হচ্ছে। এ হত্যা হওয়াটা সমাজের জন্য লজ্জার বিষয় সমাজ ধ্বংসের একটি মাইলফলক। সুতরাং সমাজকে বাঁচাতে হলে সামাজের যৌতুক প্রথা দূর করতে হবে। যে কোনো প্রকারের যৌতুক হোক তা বন্ধ করতে হবে। সরকারীভাবে আইন আছে কিন্তু এগুলোর কোনো প্রয়োগ নেই। তাই প্রতিটি ব্যক্তিকে সতর্ক করতে হবে ও সতর্ক হতে হবে।
অন্যান্য বিষয়: অন্যান্য আরো অনেক বিষয় রয়েছে তা আরো লজ্জার বিষয়। বিয়েকে কেন্দ্র করে গেইট, লাইট, ভিডিও, মঞ্চ তৈরি করা ইত্যাদি বিষয়ে বাহুল্য খরচের দাগটি আরো বাড়িয়ে দেয়। বিয়ের গায়ে হলুদ নামে ও বিভিন্ন নামে ছেলে মেয়েরা অনৈতিক কাজে জাড়িয়ে যায়, কোনো কোনো বিয়েতে যুবক যুবতীরা আনন্দের নামে, মদ-গাজার টান মারে। অনেক কিশোর নতুন অভিজ্ঞতা নেয় বিয়ের আসর থেকে। এতে ধীরে ধীরে সমাজে অবক্ষয় সৃষ্টি করে। সমাজ প্রথমে টের পায় না যখন পুরো সমাজকে গ্রাস করে বসে তখন টের পায়। বর্তমানে পুরো সমাজকে গ্রাস করে বসেছে। এখন সবাই কিছু না কিছু টের পাচ্ছে। সব বাব-মা এখন চিন্তিত ও হতাশাগ্রস্ত। ছেলে মেয়েকে নিয়ে, বিয়ে নিয়ে এবং বিয়ের পরবর্তী জীবন নিয়ে।
বর্তমানে মহরানা বিষয়ে মেয়েদের পক্ষ থেকে অতি বেশি বাড়াবাড়ি করে চলছে। ছেলের সাধ্যের বাইরে গিয়ে তার উপর একটি বড় বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। মহরানা স্ত্রীর হক। বিয়ের সাথে সাথে তা স্ত্রীকে দিয়ে দিতে হবে। তবে তার সম্মতিতে পরে দিলেও তা পারবে। এই যে পরে দিলেও হবে, এ কথার উপর আজ সমাজ চলছে কেউ নগদ দেয়ার চিন্তাও করছে না। অনেকে মনে করে তা দিতেও হবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত তা আদায় করবে না তা করয হিসেবে তার ঘাড়ে থাকবে। তাই অতি দ্রুত মহরানা আদায় করা প্রয়োজন। অনেকে আবার এ মহরানাকে যেন ব্যবসার মাধ্যম বানিয়েছে, মেয়েকে ছেলে থেকে নিয়ে ছেলে থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অংকের মহরানার টাকা। এটিও সমাজে একটি বড় অন্যায়ের পথ উম্মোচিত হচ্ছে। মহরানা নির্ধারণের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। যাতে অতি বেশি মহরানা না হয়। ছেলের উপর বোঝা না হয় সহজ হয়। অনেক স্থানে বিয়ে ভেঙ্গে গেছে কিন্তু ছেলের কাছে মহরানার টাকা নেই, পরে দেখা গেলো ভিটেমাটি বিক্রি করে মহরানা পরিশোধ করতে হয়েছে। এমন কাজ সমাজে না হওয়া চাই, যাতে মানুষ পথের মানুষ বনে যায়। একেবারে নিঃস্ব হয়ে যায়।
সার্বিকভাবে বিয়েকে সহজ করা এ জাতির জন্য অতি বেশি প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। না হয় সমাজে অনৈতিক কাজ বাড়তে থাকবে, ঘর ভাঙ্গার পরিধি বাড়তে থাকবে, নারী নির্যাতন বাড়তে থাকবে, ঘরে ঘরে অশান্তি ও হতাশার কালো মেঘ ঘিরে ধরবে, নিজ সংস্কৃতিতে অবক্ষয় শুরু হবে, মনে রাখতে হবে তা একটি জাতির অস্তিত্ব বিপন্ন হওয়ার মূল কারণ হয়ে দাঁড়াবে এক সময় কিন্তু।
লেখক: পরিচালক, ইসলাহ বাংলাদেশ, আশরাফাবাদ, ঢাকা-১২১১
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন