আউলাদে রাসূল (সা.) হুজুর কেবলা তৈয়্যব শাহ (রহ.), এই ক্রিয়াশীল মোবারকময় নামটি আত্মার প্রশান্তি। হৃদয়ের শিহরণ। প্রেমের ঝর্ণাধারা। যে প্রেমের মেলবন্ধন সুদূর বাগদাদ হয়ে ঈমানের বাড়ি মদিনা। গাউসে জামান তৈয়্যব শাহ আশেক ভক্তের শিরে তাজ। হৃদ মাজারে সুউচ্চ মিনার। মুজাদ্দিদে জমান, মোফাচ্ছিরে কুরআন তৈয়্যব শাহ ইলমে দ্বীনের মহান বাহক। খোদাভীতি আর রাসূলপ্রীতির পূর্ণজাগুরক। শরীয়ত ও তরিকতের অনন্য মডেল আউলাদে রাসূল (সা.) তৈয়্যব শাহ অসহায়ের সহায়, এতিমের বন্ধু। পীর ও বীর তৈয়্যব শাহ গুনেহগারদের আশ্রয়স্থল, মুরিদানের ছায়াসঙ্গী, সর্বহারাদের সাহস, এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। ইলমে লাদুনীর ধারক, খলিফায়ে শাহে জিলান হুজুর খাজা চৌহরভী (রহ.)’র দোয়া, কুতুবুল আউলিয়া শাহিনশাহে সিরিকোট (রহ.)-এর প্রত্যাশার বাতিঘর হলো হুজুর কেবলা, মহিউল উলুম, মহিউস সুন্নাহ গাউসে জামান হাফেজ ক্বারি আল্লামা সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ (রহ.)।
উল্লেখ্য ১৩৪০ হিজরি মোতাবেক ১৯১৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের হাজারা জেলার সুবিখ্যাত দরবারে আলীয়া কাদেরিয়া সিরিকোট শরীফের শাহানশাহ কুতুবুল আউলিয়া আল্লামা সৈয়্যদ আহমদ শাহ সিরিকোটি (রহ.)’র ঘর ও আম্মাজান সৈয়্যদা খাতুন (রহ.)’র কোল আলোকিত করে মাতৃগর্ভের অলী ‘পাক চীজ’ তৈয়্যব শাহ নামক নুর মোবরকের আগমন। প্রায় ৭৭ বছর বয়সে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দের ৭ জুন, ১৪১৩ হিজরির ১৫ যিলহজ্ব সোমবার সাড়ে নয়টার দিকে তাসবীহ পাঠ কালে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় চির বিশ্রাম গ্রহণ করেন তিনি। পিতা-মাতার উভয় দিক থেকেই তিনি ইমাম হোসাইন (রা.)’র বংশধারায় বিখ্যাত মাশওয়ানী গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। প্রিয় রাসূল করীম (সা.)’র ৩৯তম নুরানি বংশধর হুজুর গাউসে জামান খুবই অল্প বয়সে পবিত্র কুরআনের হিফয সম্পন্ন করে হাফেজ ক্বারি’র খেতাব অর্জন করেন। এরপর প্রাতিষ্ঠানিক জ্ঞানার্জন করেন হুজুর খাজা চৌহরভী (রহ.) প্রতিষ্ঠিত হরিপুর রহমানিয়া মাদরাসা থেকে। বুজুর্গ পিতা কুতুবুল আউলিয়ার সান্নিধ্যে পর্যায়ক্রমে হুজুর কেবল শরীয়ত-ত্বরীক্বতের সুযোগ্য নেতৃত্বের যাবতীয় গুণাবলী অর্জন করেন।
অল্প বয়স থেকেই গাউসে জামানের গভীর জ্ঞানের আলো বিচ্ছুরিত হতে থাকে। মাত্র চার বছর বয়সে সম্মানিত পিতাকে বলেছিলেন, বাজী নামাজ মে আপ আল্লাহকো দেখতা হ্যাঁয়, মুঝেহ ভি দেখনা হ্যাঁয়।” আর মাত্র সাত বছর বয়সে পিতার সাথে আজমীর শরীফ যিয়ারতের সময় খোদ খাজা গরীবে নেওয়ায মঈনুদ্দীন চিশতি (রা.)’র সাথে তাঁর জাহেরী মোলাক্বাত ও কথোপকথন হয়। এছাড়াও শৈশবে আরও অনেক আধ্যাত্মিক ঘটনা সকলের অন্তরকে বিমোহিত করে। ১৯৫৬ সালে পিতা শাহানশাহে সিরিকোটের সাথে পবিত্র হজ্ব ও মদিনা শরীফ যিয়ারাতে ধন্য হন। ১৯৫৮ সালে ৪২ বছর বয়সে হুজুর পাক (সা.)-এর নির্দেশে স্বীয় পীর-মুর্শিদ হুজুর কুতুবুল আউলিয়া সৈয়্যদ আহমদ শাহ ছিরিকোটি (রহ.) তাঁকে সিলসিলায়ে আলীয়া কাদেরিয়ার প্রধান খলিফা মনোনীত করেন। ১৯৬১ সালে ১ শাওয়াল ১৩৮০ হিজরীতে প্রথম বারের মতো স্বীয় পিতা ও পীর শাহানশাহ সিরিকোটের নির্দেশে ঈদের নামাজের ইমামের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে হুজুর কেবলা গাউসে জামানের উপর অর্পিত বিশাল দ্বীনি দায়িত্বর আড়ম্বরপূর্ণ অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৬১ সালে পীর হিসেবে প্রথম চট্টগ্রাম আগমনে হলেও ইতোপূর্বে পিতার সাথে ১৯৪২ সালে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম সফর করে বাংলাবাসীকে ধন্য করেছিলেন হুজুর কেবলা। নিজ পীর মুর্শিদ শাহানশাহে সিরিকোট তৈয়্যব শাহ (রহ.)›র ব্যাপারে প্রায়ই বলতেন, ্রতৈয়্যব মার্দাজাদ অলি হ্যাঁয়, তৈয়্যবকা মক্বাম বহুত উঁচা হ্যায়।” হুজুর কেবলা বানিয়ে জামেয়া শাহানশাহে সিরিকোটের আদর্শে উজ্জীবীত হয়ে ১৯৬৮ সালে রাজধানী ঢাকার বুকে প্রতিষ্ঠা করেন নবীপ্রেমের বাগান কাদেরিয়া তৈয়্যবিয়া কামিল মাদরাসা। যা আজ ঢাকার বুকে সুন্নি মুসলমানদের রাজমুকুট। শান্তিকামী মুসলমানদের মহাখুশির উপলক্ষ ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) যখন বাতিল সম্প্রদায় কর্তৃক বারবার উপেক্ষিত হচ্ছে তখন হুজুর মুজাদ্দিদে জমান তৈয়্যব শাহ ১৯৭৪ সালে দরবারে সিরিকোট শরীফ থেকে আনজুমে রহমানিয়া আহমদিয়া সুন্নিয়াকে নির্দেশ দেন পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ‹জশনে জুলুছ› আয়োজন করতে। ১৯৭৭ সালে সর্বপ্রথম হুজুর কেবলা আথলে রাসূল (সা.) নিজের শ্রেষ্ঠ সংস্কার পবিত্র জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)-এ নেতৃত্ব দিয়ে এ তাৎপর্যপূর্ণ আয়োজন মহান আল্লাহ-রাসূল (সা.) কর্তৃক কবুল করে নেন। তাই তো আজ সারা বিশ্বে জশনে জুলুছে ঈদে মিলাদুন্নবী নবীপ্রেমিকদের প্রাণের উৎসবে পরিনত হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ। ১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম হালিশহরে মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া, কালুরঘাটে মাদরাসায়-এ তৈয়্যবিয়া হাফেজিয়া, পাকিস্তানের করাচীতে মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া করাচী প্রতিষ্ঠা করে দ্বীনি শিক্ষার বিস্তার ঘটান। ১৯৭৬ সালে কর্ণফুলীর তীরবর্তী ভিন্নধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত চন্দ্রঘোনায় মাদরাসা-এ তৈয়্যবিয়া অদুদিয়া সুন্নিয়া প্রতিষ্ঠা করে ঘোর অন্ধকারে আলোর মশাল জ্বালিয়েছিলেন মহিউল উলুম তৈয়্যব শাহ। এ প্রবন্ধের লেখক আমি অধমও চন্দ্রঘোনা তৈয়বিয়া মাদরাসার আলোয় আলোকিত (ছাত্র)। চন্দ্রঘোনা তৈয়বিয়া মাদরাসা উত্তর চট্টলায় স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল। অবশ্য এ প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে মুজাদ্দিদ বাবাজী ইমাম শেরে বাংলা (রহ.)’র অবদানও অনস্বীকার্য। বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে প্রায় শতাধিক দ্বীনি প্রতিষ্ঠান হুজুর কেবলাথর আধ্যাত্মিক ইশারায় পরিচালিত হয়। সাধারণ মুসলমানদের ঈমান আকিদায় পারদর্শী করতে মুজাদ্দিদে জমান ১৯৭৮ সালে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাথআতের মুখপত্র খ্যাত তরজুমান-এ আহলে সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করেন। যা আজ আলেম-আওয়াম সকলের জন্য ঈমানী হাতিয়ার। ১৯৭৯ সালে হুজুর গাউসুল আজম জিলানী (রা.)থর যিয়ারতের সময় রাত ১২টায় গাউসে পাক থেকে নির্দেশিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করেন তরিকত চর্চার মহান এদারা আলমগীর খানকা শরীফ। যার মাধ্যমে তরিকত চর্চার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তরিকতপন্থীদের প্রাণকেন্দ্রে পরিনত হয় এ খানেকা। খাজা চৌহরভী (রহ.) রচিত নবীপ্রেমের অনবদ্য গ্রন্থ ৩০ পারা দরুদ শরীফের অদ্বিতীয় কিতাব মাজমুয়ায়ে সালাওয়াতে রাসূলের প্রকাশকও হুজুর কেবলায়ে আলম।
সুন্নি মতাদর্শ ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে গঠিত বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনার ২১ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সম্মেলনে চট্টগ্রাম মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসেনাকে উদ্দেশ্য করে ১৯৮৬ সালে ঘোষণা দিয়েছেন ্রইয়ে হামারী ঈমানী ফৌজ হ্যাঁয়। ইয়ে আউলিয়ায়ে কেরাম কী ফৌজ হ্যাঁয়।গ্ধ যে মকবুল বানী প্রতিটি সুন্নি নেতা-কর্মীর মনে সাহস-প্রেরণা হয়ে সজীব থাকবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত।
১৯৮৫ সালে হুজুর কেবলা মিয়ানমার সফর করেন। সে সময়ে ওখানকার অসংখ্য লোক হুজুর কেবলার হাতে বায়াত গ্রহণ করে ধন্য হন। বার্মা সফরেও মাদরাসা প্রতিষ্ঠা করতে ভুলেননি মহিউল উলুম তৈয়্যব শাহ। বার্মার রেঙ্গুনে প্রতিষ্ঠা করেন, মাদরাসা-এ আহলে সুন্নাত। উল্লেখিত প্রতিষ্ঠান ছাড়াও হুজুর কেবলা আরও অসংখ্য দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে সুন্নি মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়নে যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আজ দেশে লক্ষ লক্ষ আলেমে দ্বীন হুজুর কেবলাথর গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে বের হয়ে দ্বীনের সঠিক নির্যাস ছড়াচ্ছে। হুজুর কেবলার বদান্যতায় এদেশে কাদেরিয়া তরিকা ও সুন্নিয়াত এক নতুন জীবন লাভ করেন। হুজুরের নির্দেশে আজ খতমে গাউসিয়া, গেয়ারভী ও বারভী শরীফ এবং মিলাদ-ক্বিয়াম, আজানের আগে সালাত ও সালাম শুধু নতুনত্ব পাননি বরং পুনর্জীবন লাভ করে ঘরে ঘরে, জনে জনে সকলের প্রাণে প্রাণে সমাদৃত হয়েছে। এগুলো আজ সুফিবাদী মুসলমানদের জীবনে অপরিহার্য অনুসঙ্গ। গাউসে জামান তৈয়ব শাহ (রহ.)›র অবদান অবিবেচক ও অকৃতজ্ঞ ছাড়া সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতে বাধ্য।
হুজুর গাউসে জামান, মুজাদ্দিদে জামানের এক একটি সংস্কার, এক একটি নিদিষ্ট দল বা সম্প্রাদায়ের জন্য। যেমন ইলমে দ্বীনের (মাদরাসা) সংস্কার আলেম ও ছাত্রদের জন্যই বেশি লাভজনক। জশনে জুলুছ সুন্নি জনতার জন্য প্রধান প্রাণের উৎস। এভাবে প্রত্যেকটা অবদান। এ মহান মুজাদ্দিদের একটি অনন্য তাজদিদ (সংস্কার) সারা সৃষ্টি জাহানের জন্য। যা প্রমাণ হয়েছে ২০২০ সালের অন্ধকারাচ্ছন্ন করোনাকালিন। আর তা হলো মানবতার সংগঠন গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ। প্রতিদিন সূর্যের উদয়াস্ত হয়। কিন্তু ১৯৮৬ সালে বাংলার আকাশে এক নতুন সূর্যের উদয় হয়েছিল, যার সূর্যাস্ত হবে না কেয়ামততক। সে সূর্যের নাম হলো গাউসিয়া কমিটি। পবিত্র কুরআনের সুমহান নির্দেশ ্রসত্যবাদীদের সাথী হওগ্ধ শ্লোগানকে সামনে রেখে এ সত্যান্বেষী জান্নাতি কাফেলার পথচলা শুরু। অবশ্য এ মাদানি কাফেলার গোড়াপত্তন আরও বহুদিন আগে। বলাচলে দূর আরবে মরুর দুলাল প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুজুলের ছায়াসংগঠন গাউসিয়া কমিটি। ফিলফুল ফুজুল প্রতিষ্ঠা করেন প্রিয় রাসূল (সা.) আর গাউসিয়া কমিটি প্রতিষ্ঠা করেন আউলাদে রাসূল (সা.)। তাই উভয় সংগঠনের কার্যক্রমে আছে সুনিপুণ মিল।
লেখক : কলামিস্ট ও ইসলামী বক্তা, সাবেক সম্পাদক: মাসিক ছাত্রবাত
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন