শেক্সপিয়ারের দ্য টেমপেস্ট নাটকে প্রসপেরোকে উদ্দেশ্য করে ক্যালিবান বলেছিল, ‘তুমি আমাকে ভাষা শিখিয়েছ, তাতে আমার লাভ হয়েছে এই যে, আমি জানি কী করে অভিশাপ দিতে হয়।’ ক্যালিবানের এই উক্তি ও মনিবের প্রতি তার এই আচরণ একজন উপনিবেশবাদীর প্রতি এক ধরনের প্রতিরোধের সামিল। এ কারণে শেক্সপিয়ারকেও প্রতিরোধ সাহিত্য রচয়িতাদের একজন ধরলে কোনো অত্যুক্তি হবে না। যে সাহিত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যাবতীয় অন্যায়-অত্যাচার, নিপীড়ন-নির্যাতন, শোষণ ও দুঃশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে তা-ই প্রতিরোধ সাহিত্য। প্রতিরোধ সাহিত্য, সে কবিতা হোক, উপন্যাস, ছোটগল্প কিংবা নাটক, আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের অঙ্গনে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত সাহিত্য বলে বিবেচিত হচ্ছে। প্রান্তিক শ্রেণি থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত শ্রেণি পর্যন্ত সমাজের নিপীড়িত-নির্যাতিত সব শ্রেণির মানুষ নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন হয়ে ওঠায় তাদের চিন্তায় ও চাল-চলনে যেমন পরিবর্তন সাধিত হয়েছে, তেমনি বিপ্লব ঘটেছে তাদের পঠনপাঠনেও। এজন্যে বোধহয় পাবলো নেরুদা, নাজিম হেকমত, পি বি শেলি, কাজী নজরুল ইসলাম প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক অন্যদেরকে ছাড়িয়ে আবার চলে আসছেন জনপ্রিয়তার প্রথম কাতারে। ভাববাদী রোমন্টিক যুগের কাব্য-আন্দোলনের দিন আর নেই। যন্ত্র সভ্যতার নির্দয় নিষ্পেষণে যখন হাহাকার করছে মানুষ; পুঁজিবাদ, বর্ণবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার যাঁতাকলে পড়ে যখন করজোড়ে ফরিয়াদ করছে মানবতা, তখন ভাববাদ নিয়ে ভাবিত হওয়ার অবকাশ মানুষের নেই। তার আত্মার সঙ্গী তাই বিপ্লবী ও সংগ্রামীরা। সঙ্গতকারণেই বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন বিপ্লবী কবি-সাহিত্যিকরা।
প্রতিরোধ সাহিত্যে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো, বাংলাদেশও সমৃদ্ধ। মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) এর অগ্রদূত। বাংলা ভাষার প্রথম আধুনিক কবি মধুসূদন। তিনি ছিলেন আপদমস্তক বিপ্লবী কবিও। বিপ্লব ছিলো তাঁর রক্তে-মাংসে, হৃদয়ে ও সত্তায়। তিনি বিপ্লব এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যর নানা অঙ্গনে। বাংলা কবিতায় সনেট ও অমিত্রাক্ষর ছন্দ প্রবর্তন তাঁর এক অমর কীর্তি। বাংলা ভাষায় নাটক, প্রহসন, অনুবাদসাহিত্য, পত্রসাহিত্য ও মহাকাব্য প্রবর্তন এবং বাংলা সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষার সর্বপ্রথম প্রয়োগের মাধ্যমে তিনি খুলে দিয়েছিলেন বাংলা ভাষার অমিত সম্ভাবনার দুয়ার। তবে বাংলা সাহিত্যের আঙ্গিক পরিবর্তনের পাশাপাশি তিনি এর অন্তর্দেশেও জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন বিপ্লবের গোপন অগ্নি। তার সাক্ষ্য বহন করছে তাঁর রচিত প্রহসনগুলো। বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ তাঁর এমন একটি প্রহসন যেখানে তিনি ব্যঙ্গবিদ্রƒপের চাবুকাঘাতে জর্জরিত করেছেন তৎকালীন সমাজের দুশ্চরিত্র পুরোধা শ্রেণীকে।
মধুসূদন দীনবন্ধু মিত্রের (১৮২৯-১৮৭৩) নীল দর্পণ অনুবাদ করেছিলেন ইংরেজিতে দি ইনডিগো প্লান্টিং মিরোর শিরোনামে, যা ছিলো ইংরেজদের নীলচাষের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ। মেঘনাদবধ কাব্যের মধ্যেও বিদ্রোহের অনল জ্বলতে দেখি আমরা। এ মহাকাব্যের রাবণপুত্র মেঘনাদ একজন দেশপ্রেমিক বীরপুরুষ-যোদ্ধা আর পরদেশআগ্রাসী রাম মূলত শাসক ইংরেজ। মধূসূনের এ প্রতীকী ব্যবহার তাঁর ভেতরে লুকায়িত স্বাধীনতার স্পৃহাকেই ইঙ্গিত করে। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ রাবণ তাঁর সমগ্র শক্তি দিয়ে যে রামকে প্রতিরোধ করতে চেয়েছে, সে রাম মাতৃভূমি ভারতআগ্রাসী ইংরেজ; মধুসূদন সেখানে নিজেকেই উপস্থাপন করেছেন রাবনের আদলে। ‘জন্মভুমি রক্ষাহেতু কে ডরে মরিতে?’ এ শুধু মহাকাব্যের প্রয়োজনে রচিত পঙক্তিই নয়, মধুসূদনের অন্তরে জাত দাবানলসম স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাও বটে।
গিরীশচন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) সিরাজ-উদ-দৌলা নাটক লিখেছিলেন ১৯০৫ সালে। দেশপ্রেমিক যে-সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয় ও মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষের স্বাধীনতাসূর্য অস্ত গিয়েছিল ১৭৫৭ সালে, দুর্বৃত্ত ইংরেজ তাঁকে জাতির কাছে উপস্থাপন করেছিল খলনায়ক হিসেবে। নাট্যকার গিরীশচন্দ্র সেন অপপ্রচারের অমানিশায় হারিয়ে যাওয়া সেই নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে আলোতে এনেছিলেন লুণ্ঠিত স্বাধীনতাকে পুনরুদ্ধারের মানসে। দীনবন্ধু মিত্রের নীল দর্পণ রচিত হয়েছিল ১৮৬০ সালে। নীল দর্পণ-এর পর গিরীশচন্দ্র সেনের সিরাজ-উদ-দৌলা-ই ছিলো সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরবর্তীকালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য।
কিন্তু বাংলা সাহিত্য প্রকৃত বিদ্রোহী হলেন কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ -১৯৭৬)। নজরুলের বিপ্লবী কবিতাগুলো একসঙ্গে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত না হওয়ায় আজও বিশ্ববাসীর অজানাই রয়ে গেছে যে, কতটা তীব্র ছিলো নজরুলের বিদ্রোহের আগুন। ইংরেজি সাহিত্যের পি বি শেলি (১৭৯২-১৮২২) ও জর্জ গর্ডন বায়রন (১৭৮৮-১৮২৪) বিদ্রোহী কবি বটে, কিন্তু প্রকৃত অর্থে তাঁরা কেউই নজরুলের চেয়ে বড় কবি ছিলেন না। তাদের বিদ্রোহ ছিলো বস্তুত প্রতীকী, শৈল্পিক নৈপুণ্য ও ভাষার আলঙ্কারিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ; ফলে তা বুদ্ধিজীবী-পাঠকশ্রেণী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে, ব্যাপক সাধারণ পাঠকের দোরগোড়ায় পৌঁছোতে পারেনি কখনও। পক্ষান্তরে নজরুলের বিদ্রোহ ছিলো স্বতঃস্ফূর্ত, খরস্রোতা নদীর মতো বেগবান, ভাষা খবুই সাধারণ, স্বল্পশিক্ষিতেরও বোধগম্য, চিত্রকল্প এতই পরিচিত যে, নাটকের দৃশ্যের মতো যে কাউকে মোহাবিষ্ট করে রাখে। নজরুল যখন বলেন:
দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিল নিচে ফেলে।
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি করে কী জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
তখন পাঠকের চোখে যেমন পানি চলে আসে, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহীও হয়ে ওঠে সে ভেতরে ভেতরে। নজরুলের মধ্যে কোন রাখঢাক নেই; তার কণ্ঠ যেন কোনো যোদ্ধার, ঘোষণা বীরপুরুষের :
আসিতেছে শুভ দিন
দিনে দিনে বহু বাড়িয়াছে দেনা শুধিতে হইবে ঋণ।
(কুলিমজুর, সাম্যবাদী)
পাঠক তখন তাঁর সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা না করে পারে না। নজরুলের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, তাঁর কবিতার প্রতিটা পঙক্তিই কবিতা। নজরুল তাঁর সাম্যবাদী কাব্যগ্রন্থে মানবতাবাদের যে বিস্ময়কর মন্ত্র উচ্চারণ করে গেছেন একের পর এক, তার নজির বিশ্বসাহিত্যর ইতিহাসে একটিও নেই। নজরুল বিদ্রোহ করেছেন সমুদয় অন্যায়, অত্যাচার, জুলুম, পরাধীনতা, কুসংস্কার, জরাজীর্ণতা, প্রাচীনতা ও মানুষের পশুত্বশক্তির বিরুদ্ধে; স্বদেশ ও স্বজাতির জন্যে ছিল তাঁর বুক ভরা দরদ। নজরুলই বিশ্বের একমাত্র কবি যিনি মানুষে মানুষে মিলনের সেতু নির্মাণ করেন ভালোবাসার মন্ত্রে:
গাহি সাম্যের গান
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান
যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৈদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান
মসজিদ এই, মন্দির এই, গির্জা এই হৃদয়,
এইখানে বসে ঈসা মুসা পেল সত্যের পরিচয়।
মিথ্যা শুনিনি ভাই,
এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির-কাবা নাই।
(সাম্যবাদী, সাম্যবাদী)
নজরুল প্রচলিত কুসংস্কারচ্ছন্ন হৃদয়হীন ধর্মীয় জীবনের প্রচণ্ড সমালোচক, কারণ তিনি ধর্ম পছন্দ করেন কিন্তু ধর্মের নামে ভণ্ডামি, কপটতা, শঠতা সহ্য করেন না একদম। তাই তো তিনিই বলতে পারেন এভাবে:
খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা?
সব দ্বার এর খোলা রবে, চালা হাতুড়িÑশাবল চালা!
হায়রে ভজনালয়,
তোমার মিনারে চড়িয়া ভন্ড গাহে স্বার্থের জয়!
মানুষের ঘৃণা করি’
ও কারা কোরান, বেদ, বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!
ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ জোর করে নাও কেড়ে;
যাহারা আনিল গ্রন্থ কেতাব সেই মানুষেরে মেরে
পুজিছে গুন্থ ভন্ডের দল!
(মানুষ, সাম্যবাদী)
বাংলা ভাষার আরেকজন প্রকৃত বিদ্রোহী কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭)। নজরুলের মতো তিনিও ছিলেন আপদমস্তক বিপ্লবী। ‘আগামী’, ‘একটি মোরগের কাহিনী’, ‘সিগারেট’, ‘দেশলাইকাঠি’, ‘আঠার বছর’, ‘হে মহাজীবন’ প্রভৃতি তাঁর চমৎকার সব কবিতা, যেখানে লুকিয়ে আছে বিদ্রোহের ছাইচাপা আগুন, সুযোগ পেলেই যা জ্বলে ওঠবে দাউদাউ করে:
জড় নই, মৃত নই, নই অন্ধকারের খনিজ,
আমি তো জীবন্ত প্রাণ, আমি এক অঙ্কুরিত বীজ;
মাটিতে লালিত, ভীরু, শুধু আজ আকাশের ডাকে
মেলেছি সন্দিগ্ধ চোখ, স্বপ্ন ঘিরে রেখেছে আমাকে
(আগামী, ছাড়পত্র)
সুকান্তের ‘একটি মোরগের কাহিনী’ প্রতিরোধ সাহিত্যের এক অদ্বিতীয় নমুনা, কবিতাটির প্রতীকী অর্থ-দ্যোতনার জন্য। তৃতীয় বিশ্বের সাধারণ মানুষদেরকে তিনি মোরগ প্রতীকের মাধ্যমে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যে, তা বিশ্ববিবেককে নাড়া না দিয়ে পারে না। কবিরা কোনো কথা সরাসরি বলতে চান না। তাঁরা একটা প্রতীকের আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুকান্তও তাই করেছেন। একটা মোরগের কথা তিনি আমাদের শোনাতে চান গল্পের মতো করে। তিনি বলে চলেন:
একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেলো
বিরাট প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে,
ভাঙ্গা প্যাকিং বাক্সের গাদায়Ñ
আরো দু’তিনটি মুরগীর সঙ্গে।
আশ্রয় যদিও মিললো,
উপযুক্ত আহার মিললো না।
(একটি মোরগের কাহিনী, ছাড়পত্র)
কবির মূল্য উদ্দেশ্য মোরগের জীবনের ট্রাজেডির কথা বলা। আশ্রয় তো পেল প্রাসাদে। কিন্তু প্রাসাদ যে প্রাণহীন। কবি বলেন:
অসহায় মোরগ খাবারের সন্ধানে
বারবার চেষ্টা করলো প্রাসাদে ঢুকতে,
প্রত্যেক বারই তাড়া খেল প্রচণ্ড।
তারপর সত্যিই সে একদিন প্রাসাদে ঢুকতে পেল,
একেবারে সোজা চলে এল
ধবধবে সাদা দামী কাপড়ে ঢাকা খাবার টেবিলে:
অবশ্য খাবার খেতে নয়Ñ
খাবার হিসেবে।
(একটি মোরগের কাহিনী, ছাড়পত্র)
সুকান্ত এ ধরনের গল্প বলার আড়ালে যে কাজটি মূলত করতে চেয়েছেন, তা হলো, বিশ্ববিবেককে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে জাগিয়ে তোলা এবং অধিকারবঞ্চিত, ক্ষুধার্ত, সর্বহারাদের প্রতিরোধের শপথে উদ্দীপ্ত করা। এটি একটি খুবই শক্তিশালী আক্রমণাত্মক সেটায়ার। এ ধরনের কবিতা সমগ্র বিশ্বসাহিত্যেও দুর্লভ।
চল্লিশের দশকের দুজন কবি ফররুখ আহমদ (১৯১৮-১৯৭৪) ও সুভাষ মুখোপাধ্যায় (১৯১৯-২০০৩) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁদের বিপ্লবী কবিতার জন্য। ফররুখের ‘লাশ’ কবিতা ছাড়া বাংলা সাহিত্যের প্রতিরোধ সাহিত্য কল্পনা-ই করা যায় না। যে-কোনো ভাষার যে-কোনো শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে এটি তুল্য হওয়ার যোগ্যতা রাখে। তেরশ পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষের যে-ভয়াবহ চিত্র এঁকেছিলেন ফররুখ এ কবিতায়, তা বিশ্বের যে-কোনো স্থানের দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে এবং চিরদিনই তা মানুষকে বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করে তুলবে। কবি যখন এরকম করে বলেন:
পৃথিবী চষিছে কারা শোষণে-শাসনে
সাক্ষ্য তার রাজপথে জমিনের ’পর
সাড়ে তিন হাত হাড় রচিতেছে মানুষের অন্তিম কবর।
পড়ে আছে মৃত মানবতা তারি সাথে পথে মুখ গুঁজে।
আকাশ অদৃশ্য হলো দাম্ভিকের খিলানে গম্বুজে
নিত্য স্ফীতোদর
এখানে মাটিতে এরা মুখ গুঁজে মরিতেছে ধরণীর ’পর।
(লাশ)
তখন তাঁর সাথে একাত্মতা ঘোষণা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকে না।
সুভাষ মুখোপাধ্যায় তাঁর পদাতিক কাব্যগ্রন্থের মাধ্যমে পুঁজিবাদী শ্রেণীর অস্তিত্ব ধরে ঝাঁকুনি দেওয়ার চেষ্টা করেন ঝটিকার মতো। বুলেটের মতো বুর্জোয়া শ্রেণীর বক্ষদেশ বিদ্ধ করে যেতে থাকে তাঁর এক-একটি পঙক্তি। কবি যখন এরকম করে বলেন:
প্রিয়, ফুল খেলবার দিন নয় অদ্য
ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা,
চোখে আর স্বপ্নের নেই নীল মদ্য
কাঠফাটা রোদ সেঁকে চামড়া।
চিমনির মুখে শোনো সাইরেন-শঙ্খ,
গান গায় হাতুড়ি ও কাস্তে
তিল তিল মরণেও জীবন অসংখ্য
জীবনকে চায় ভালোবাসতে।
(মে-দিনের কবিতা)
তখন রোমান্টিকতার পথ পরিহার করে রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় তৃতীয় বিশ্বের ভুখানাঙ্গা আত্মভোলা মানুষগুলো, চোখে যাদের জ্বলে ওঠে বিপ্লবের বারুদ।
বাংলা সাহিত্যের বিপুল কবি-সাহিত্যিক আছেন যাঁরা এ প্রসঙ্গে উল্লিখিত হওয়ার দাবি রাখে। নারী-লেখকদের মধ্যে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন যথার্থ অর্থেই ছিলেন প্রতিবাদী সাহিত্যিক । তবে তাঁর এ প্রতিবাদ নারী-অধিকারসর্বস্ব হওয়ায় তাঁকে বাংলা ভাষার প্রথম নারীবাদী লেখক হিসেবে অভিহিত করা হয়। তাঁর ‘সুলতানাস ড্রিম’ কিংবা ‘নারীস্থান’ এমন সব রচনা, যা পারমাণবিক বোমার মতো বিপ্লব ঘটিয়েছিল পুরুষের স্বৈরাচারী বোধের সাম্রাজ্যে। কথা সাহিত্যিকদের মধ্যে মানিক বন্দোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণ, শাহেদ আলী, মনোজ বসু প্রমুখের নাম নেয়া যায, যাঁদের জন্য আলাদা আলাদাভাবে দীর্ঘ পরিসরে আলোচনা করা যেতে পারে। যেসব কবির নাম এ প্রসঙ্গে উল্লেখ না করলে অসম্পূর্ণতা থেকে যায় তাঁরা হলেন জীবনানন্দ দাশ, শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, আবুল হাসান, হেলাল হাফিজ প্রমুখ, যাদের প্রচুর কবিতা আছে প্রতিরোধের উদ্দীপনায় দীপ্ত।
ম্যাক্সিম গোর্কি, নিকোলাই অস্ত্রভস্কি, জোসেফ কনরাড, বরিস পাস্তেরনাক, ই এম ফস্টার, ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রমুখ কবি-সাহিত্যিক তাঁদের বিপ্লবী সাহিত্যকর্মের জন্য বিশ্বব্যাপী নন্দিত। ডব্লিউ বি ইয়েটসও এঁদের মতো আরেকজন প্রখ্যাত কবি, আইরিশ স্বাধীনতা আন্দোলনের পক্ষে যিনি অনেক কবিতা রচনা করেছিলেন। আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা দিবস সচক্ষে দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন তিনি। এ দিবসকে উৎসর্গ করে তিনি ‘অ্যা গ্রেট ডে’ শিরোনামে একটি কবিতাও রচনা করেছিলেন। এ কবিতাটিতে ইয়েটস স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর যে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, তার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন:
বিপ্লব ও কামানের গোলা জিন্দাবাদ!
ঘোড়ার পিঠে বসে থাকা এক ভিক্ষুক
বেত্রাঘাত করছে আরেক ভিক্ষুককে।
বিপ্লব ও কামানের গোলা জিন্দাবাদ!
ভিক্ষুকের স্থান বদল হয়েছে,
কিন্তু বেত্রাঘাত চলছেই।
এ কবিতাটি বাঙালি কবিদের জন্যও প্রাসঙ্গিক। দেশ স্বাধীন হয়েছে, বিজ্ঞানের ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, পৃথিবী সভ্য হয়েছেÑ এসব ভেবে আত্মতৃপ্ত হয়ে আঙুল চোষার কোনো অবকাশ নেই। মানবতার বিরুদ্ধে আগ্রাসন সব দেশে সব স্থানে সবসময়ই চলবে কখনও উপনিবেশবাদের নামে, কখনও সমাজতন্ত্র, কখনও বা গণতন্ত্রের নামে, এবং কবি-সাহিত্যিকরাও বসে থাকবে না, তাদের সাহিত্যও গর্জে উঠবে সার্বক্ষণিক, পারমাণবিক বোমার মতো, সবখানে। আধুনিক বাঙালী কবিরাও বসে নেই। প্রতিবাদের হাতিয়ার নিয়ে বসে আছে তারাও। আশি, নব্বই ও শূন্য দশকের অনেক প্রতিভাবান কবি গর্জে উঠছেন স্বৈরাচার, নৈরাজ্য ও সমাজের পরতে পরতে ঘাপটি মেরে থাকা সমুদয় অপশক্তির বিরুদ্ধে, এটা বড়ই আশার কথা।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন