যশোরের ঐতিহ্যের প্রতীক মধুবৃক্ষ। খেজুর গাছকে বলা হয় মধুবৃক্ষ। ‘যশোরের যশ, খেজুরের রস’। শীতের আগমনী বার্তায় শুরু হয়েছে মধুবৃক্ষ পরিষ্কার করা। ডালপালা কেটে পরিষ্কার করার পরই দফায় দফায় চাচ দেয়া হচ্ছে। বসানো হয়েছে কঞ্চির নলি। যা দিয়ে খেজুর গাছ থেকে বেয়ে আসে সুমিষ্ট রস। কুয়াশার চাদর মোড়ানো এই শীতের সকালে যশোর জেলার মাঠে মাঠে এখনো খেজুরগাছ থেকে রস নামাতে ও বিকেলে গাছ কাটতে গাছিদের ব্যস্ত দেখা যায়। আর বাড়িতে বাড়িতে গাছি-বধূরা ক্লান্তিহীন সময় পার করছেন সেই রস জ্বালিয়ে গুড়-পাটালি তৈরির কাজে। এখনো যশোর জেলার গাঁয়ের পথ দিয়ে হাঁটলে গুড়ের ম ম গন্ধে মনপ্রাণ ভরে যায়।
রস সংগ্রহের প্রস্তুতি- খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহের জন্য কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ করতে হয়। অগ্রহায়ণ মাসে গাছগুলোকে রস সংগ্রহের উপযোগী করে তোলার জন্য গাছের পাতাসহ বাকল ধারালো দা দিয়ে চেঁচে পরিষ্কার করা হয়। স্থানীয় ভাষায় একে ‘গাছতোলা’ বলা হয়। সাত-আট দিন পর হালকাভাবে চেঁচে পরিষ্কার করতে হয়। একে বলা হয় ‘চাঁচদেয়া’। এর পর সপ্তাহখানেক পর চাঁচা অংশে বাঁশের নলি বসানো হয়। এর পর পালা করে সপ্তাহে এক দিন করে প্রতিটি গাছ কাটা হয়। গাছ কাটার দিন যে রস পাওয়া যায় তাকে জিড়ান রস বলে। গুণে ও মানে এই রস উৎকৃষ্ট এবং পরিমাণেও বেশি হয়। গাছ কাটার দ্বিতীয় দিনও রস পাওয়া যায় এই রসকে বলা হয় দোকাট। এই রসের স্বাদ জিড়ান রসের মতো নয় এবং পরিমাণেও কম হয়। তৃতীয় দিনের রসকে বলা হয় ঝরা। ঝরা রস দোকাটের চেয়েও কম হয় এবং অনেকটা টক স্বাদযুক্ত। একটি গাছ একবার কাটলে ছয় লিটার মতো রস পাওয়া। আবহাওয়া শীতার্ত ও আকাশ স্বচ্ছ থাকলে রস মিষ্টি ও পরিষ্কার হয়।
খেজুরের গুড় তৈরি পর্ব জিড়ান রস দ্রুত না জ্বালালে তা মজে গিয়ে দোকাট বা ঝরা রসের মতো হয়ে যায়। এই মজা রস এক শ্রেণীর মানুষ ‘তাড়ি’ হিসেবে পান করে। এলাকাবিশেষ এই মজা রস গবাদি পশুর স্বাস্থ্যবর্ধক পানীয় হিসেবে ব্যবহার করা হয়। রস মজে যাবার আগে জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতে পারলে তা অনেক দিন পর্যন্ত খাওয়ার উপযোগী থাকে।
রস থেকে গুড় তৈরি করতে কয়েকটি ধাপ পার করতে হয়। জিড়ান রসের গুড় দানাদার করতে হলে জ্বালানির পাত্রে ঝাকি (খেজুর গাছের ডাঁটা দিয়ে তৈরি গুড় ঘোটার লাঠি) দিয়ে অল্প জায়গায় কিছুক্ষণ ঘষলে ওই জায়গার গুড় শুকিয়ে গুঁড়ো হয়ে যায় এই প্রক্রিয়াকে ‘বীজমারা’ বলে। এই বীজ গুড়ের সাথে উত্তমরূপে মিশিয়ে দিলে গুড়ে দানা বাঁধে। এই গুড় দিয়েই তৈরি হয় রসালো সুস্বাদু পাটালি। নিকট অতীতে রস জ্বালানো হতো মাটির তৈরি মুখ খোলা বড় হাঁড়িতে। বর্তমানে হাঁড়ির স্থান দখল করেছে ধাতবপাত্র।
খাজুরার বিশেষ পাটালি : যশোরের খাজুরায় বিশেষ ধরনের পাটালি তৈরি হয়। এর দাম যেমন বেশি, দেশজুড়ে কদরও তেমনি। উপরিভাগ ঠনঠনে শক্ত অথচ ভেতরে রসালো এ পাটালি একমাত্র খাজুরাতেই তৈরি হয়। সাধারণ পাটালির চেয়ে দাম কেজিতে ৪০ থেকে ৫০ টাকা বেশি।
মো. মতিয়ার নামে খাজুরার এক গাছি জানান, এলাকার ১০ থেকে ১৫টি গ্রামের প্রায় ২০০ গাছির বাড়িতে এই পাটালি তৈরি হয়। তিনি নিজেই প্রতি সপ্তাহে এক হাজার টাকার পাটালি বিক্রি করেন।
বিভিন্ন পেশাজীবির কর্মসংস্থান : খেজুর গাছকে কেন্দ্র করে যশোর জেলায় সুদূর অতীতকাল মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ পেয়ে আসছে। কত মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে তার কোনো পরিসংখ্যান সরকারি বেসরকারি কোনো সংস্থার কাছে নেই। তবে এলাকাবাসীর ধারণা মতে এক লাখের বেশি গাছি পরিবারের কর্মসংস্থান হয়েছে। এ ছাড়া রস সংগ্রহের ঠিলা তৈরি কাজে যুক্ত আছে অনেক পাল পরিবার। কারণ মেটে ঠিলা ছাড়া ধাতব পদার্থ জাতীয় কিছু দিয়ে রস সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। এটা যেমন ব্যয়বহুল তেমনি চুরির ভয় রয়েছে। এ ছাড়া গাছি দা তৈরি, গাছে উঠতে দা বহন করার জন্য পাত্র (বাঁশের তৈরি ঠুঙ্গি) তৈরির কাজে নিয়োজিত হয় কামার ও মুচি। গুড় বাজারজাত করতে পরিবহন শ্রমিক এবং পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী মিলিয়ে লক্ষাধিক পরিবারের ভরণ-পোষণ খেজুরের রস-গুড়কে কেন্দ্র করে হয়।
লাভজনক কৃষিপণ্য : খেজুরের রস-গুড় যশোরের অন্যতম লাভজনক কৃষিপণ্য। এ কাজের ওপর নির্ভর করে এখনো জেলার লক্ষাধিক পরিবার। কৃষি বিভাগ ও গাছিদের দেয়া হিসাব থেকে এ তথ্য জানা গেছে। কিন্তু গাছির এই সংখ্যা ক্রমেই কমে যাচ্ছে। সেই সাথে কমছে গাছের সংখ্যা। অনেকে না জেনে খেজুর গাছ কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইট ভাটাকে দায়ী করেন। কিন্তু বিষয়টি তা নয়। বিভিন্ন গ্রামের গাছিদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, দিন বদলের হাওয়ায় গাছিদের ছেলেরা লেখাপড়া শিখে অন্য পেশায় যুক্ত হচ্ছে। গাছকাটা একটি শ্রমসাধ্য পেশা। এ কারণে এ পেশায় নতুন করে কেউ যুক্ত হচ্ছে না। বাপ-দাদার আমলে তাদের যে সব খেজুর গাছ ছিল তা বিক্রি করে দিচ্ছে। যেহেতু খেজুর গাছ দিয়ে জ্বালানি ছাড়া অন্য কিছু হয় না সেহেতু ভাটায় বিক্রি হচ্ছে।
বাণিজ্যিক সম্ভবনা : গাছিদের দেয়া হিসাবে জানা গেছে, ১০ কেজি রস জ্বালালে এক কেজি গুড় হয়। একটি গাছ থেকে মৌসুমে এক থেকে দেড় হাজার টাকার গুড় পাওয়া যায়। যদি কোনো গাছি এক পণ (৮০টি) গাছ রস সংগ্রহের জন্য কাটেন তাহলে তিনি এক মৌসুমে ৮০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ ২০ হাজার টাকার মতো আয় করতে পারেন। এই টাকা আয়ের জন্য পুঁজি হিসেবে তাকে বিনিয়োগ করতে হয় মাত্র দেড় হাজার টাকা। বিনিয়োগ খাতগুলো হলো, গাছ তোলা (রস সংগ্রহের জন্য উপযোগী করা), ভাড় বা ঠিলা (রস সংগ্রহের পাত্র) ও গাছি দা কেনা প্রভৃতি। রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতে জ্বালানি কিনতে হয় না। খেজুরের পাতা দিয়ে জ্বালানির চাহিদা পূরণ হয়।
ইতিহাস ফিরে দেখা : যশোর খেজুরে চিনির গৌরবময় ঐতিহ্যের অধিকারী। ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, এক সময় চিনি ছিল যশোরের প্রধান অর্থকরী পণ্য। সেটা ছিল খেজুরে চিনি। এই চিনি তৈরির এখানে কোনো মিল ছিল না। গাছিরা দেশি প্রযুক্তিতে খেজুরের গুড় থেকে ওই চিনি উৎপাদন করতো। এই উৎপাদনের কৌশল ছিল এমনÑ প্রথমে গুড় চুবড়ি বা পেতেতে (ঝুড়ি) রাখা হতো। পেতেগুলো নাদার (মাটির তৈরি বড় পাত্র) ওপর বসানো হতো। পেতে থেকে গুড়ের রস গলে নাদায় পড়তো। পেতেয় গুড় রাখার তৃতীয় দিন গুড়ের বেঁকি (রস গলার পর শক্ত অংশ) ভেঙে দিতো গাছিরা। এই ভাঙার কাজকে বলা হতো মুটানো। পরদিন ওই গুড়ের ওপর শেওলা দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। সব শেওলায় এ কাজ হতো না। কপোতাক্ষ নদে চিনি উৎপাদন করার উপযোগী এক প্রজাতির শেওলা জন্মায়, তার নাম পাটা শেওলা। গুড়ের ওপর এই শেওলা দেয়ার সাতদিন পর পেতের গুড়ের ওপরের অংশ সাদা হয়ে চিনি হয়ে যেতো। পরে তা কেটে তুলে নিয়ে আবার মুটিয়ে নতুন শেওলা দিয়ে ঢেকে দেয়া হতো। এভাবে ৪ থেকে ৫ বার করলে এক পেতের গুড় সব চিনি হয়ে যেতো। এই চিনিকে বলা হতো দলুয়া চিনি। এই চিনি সরস, সুস্বাদু ও চিকন দানাযুক্ত। ময়রাদের কাছে এই চিনি অত্যন্ত প্রিয় ছিল। মিষ্টি তৈরির কাজে এই চিনি বেশি ব্যবহৃত হতো। দলুয়া চিনির আবার শ্রেণী ভাগ ছিল। পেতের গুড় থেকে প্রথম যে চিনি তৈরি হতো তার নাম ছিল আখড়া। আর অপেক্ষাকৃত লাল চিনিকে বলা হতো চলতা। দ্বিতীয়বার প্রাপ্ত চিনিকে বলা হতো কুন্দ।
দলুয়া চিনি বেশি দিন শুকনো অবস্থায় রাখা যেতো না। ওই চিনি দ্রুত মেতে বা ভিজে উঠতো। এ জন্য দলুয়া চিনিকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য পাকা করে নেয়া হতো। পাকা করার প্রক্রিয়া ছিল এমন -দলুয়া চিনি কড়াইতে জ্বাল দিয়ে তার সাথে দুধ মেশালে ওই চিনির গাদ বা ময়লা বের হয়ে যেতো। পরে তা ছিদ্রযুক্ত পাত্রে রেখে আগের মতো পাটা শেওলার সাহায্যে চিনি করা হতো। এই প্রক্রিয়ায় অপেক্ষকৃত সাদা ও দানাযুক্ত যে চিনি তৈরি হতো তাকে বলা হতো দোবরা চিনি এবং লালচে চিনির নাম ছিল একবরা। পাকা চিনি তৈরির আর একটি প্রক্রিয়ার কথা জানা যায়। এ প্রক্রিয়াটি হলো, গুড় বস্তায় ভরে ঝুলিয়ে রাখা। বস্তার দুই পাশে দুটি বাঁশ দিয়ে চেপে বেধে গুড়ের রস নিংড়ানো হতো। এ ভাবে নিংড়ানোর পর শুকনো গুড়ে পানি মিশিয়ে জ্বাল দিয়ে দুধ মিশিয়ে গাদ তুলে ফেলে পাটা শেওলা ব্যবহার করা হতো। পরে ওই চিনি পিটিয়ে গুড়ো করে নিলে উৎকৃষ্ট চিনি হতো।
খাদ্য চাহিদা পূরণ : জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) নির্ধারিত মান অনুযায়ী জনপ্রতি বার্ষিক ১৩ কেজি চিনি বা ১৭ কেজি গুড় খাওয়া প্রয়োজন। কারণ মানুষের দেহের খাদ্যবলের যে ১৩ শতাংশ শর্করা থেকে আসা প্রয়োজন তা চিনি বা গুড় থেকে পূরণ করা সম্ভব। কিন্তু বাংলাদেশে চিনি বা গুড়ের মাথাপ্রতি ব্যবহার ছয় কেজিরও কম। এ ক্ষেত্রে যশোরে যে গুড় উৎপাদন হয় তা এই ঘাটতি পূরণে অনেকটা সহায়ক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন