টঙ্গীর তুরাগ নদীর তীরে আগামী ১৩ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমাকে সফল করতে গত শুক্রবার শতশত মুসল্লী স্বেচ্ছাশ্রমে ইজতেমা ময়দানের প্রস্তুতি কাজে যোগ দিয়েছেন। টঙ্গী-গাজীপুরসহ ঢাকা ও আশপাশের এলাকা থেকে স্কুল, মাদরাসা, ও কলেজের ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবিসহ নানা পেশার বিভিন্ন বয়সী মানুষ জুমাবারের বাড়তি নেকি লাভের আশায় ইজতেমার প্রস্তুতি কাজে যোগ দিতে ছুটে আসেন ময়দানে। ১৬০ একরেরও অধিক জায়গাব্যাপী বিশ^ ইজতেমার সুবিশাল প্যান্ডেল নির্মাণসহ সামগ্রিক প্রস্তুতির প্রায় দুই তৃতীয়াংশ কাজ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে বলে ইজতেমা আয়োজক কমিটি দাবি করছে।
গত শুক্রবার সকালে বিশ^ ইজতেমা ময়দানে গিয়ে দেখা যায় কেউ মাইকের হর্ণ বাঁধছেন, কেউ প্যান্ডেলের বাঁশ বাঁধছেন, কেউ চট সেলাই করছেন আবার কেউবা বাঁশের মাথায় চট টানাচ্ছেন। ময়দানের উত্তর প্রান্তে মোহন, সজল ও মনির হোসেন ওযু-গোসলখানা মেরামতের কাজ করছিলেন। পরিচয় জিজ্ঞাসার পর বললেন, আমরা পানির জামাতের সাথী। পানির জামাতের জিম্মাদার নারায়নগঞ্জের ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান। তাঁর নেতৃত্বে সমগ্র ইজতেমা ময়দানের ওযু-গোসলখানাগুলো সংস্কার করার কাজ প্রায় সমাপ্তির পথে বলে পানির জামাতের সাথীরা জানান।
ময়দানের পূর্ব প্রান্তে ঢাকার তাঁতিবাজারের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের ৪০ জনের একটি জামাত কামরুজ্জামানের নেতৃত্বে চটের সামিয়ানা টানানোর কাজে ব্যস্ত ছিলেন। মধ্যম বয়সি ব্যবসায়ী আবুল হোসেন কাজ করতে করতে আলাপকালে জানান, গতকালসহ চার জুমাবারেই তাঁরা নিজ খরচে এসে ইজতেমা ময়দানের প্রস্তুতি কাজে অংশগ্রহণ করেন। এই জামাতেরই সাথী নুরুল আমীন বলেন, দুনিয়ার ব্যবসার কাজতো সারাবছরই করি, গত শুক্রবার সপ্তাহের সর্বপেক্ষা উত্তম দিন। এই দিনে ইজতেমা ময়দানে এসেছি আখেরাতের ব্যবসায় বেশি লাভের আশায় কারণ, জুমাবারের কাজে নেকী বেশি। ইজতেমা ময়দানের প্রস্তুতি কাজে অংশগ্রহণকারি সকলেরই প্রায় একই কথা, তাঁরা একমাত্র আল্লাহকে রাজি-খুশি করাতে নিজ নিজ খরচে ময়দানে এসে কনকনে শীত উপেক্ষা করে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত পরিশ্রম করছেন।
১৩ জানুয়ারি থেকে তিন দিনব্যাপী অনুষ্ঠিতব্য প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমায় আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের জন্য সমগ্র ইজতেমা মাঠতে ৯১টি খিত্তায় বিভক্ত করে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। জেলাভিত্তিক অবস্থানের জন্য নির্ধারিত খিত্তাগুলো হচ্ছে- গাজীপুর (খিত্তা-১), টঙ্গী (খিত্তা-২, ৩ ও ৪), ঢাকা (খিত্তা-৫ থেকে ১৮ ও ২১, ২২, ২৫, ২৭, ২৮, ৩০), রাজশাহী (খিত্তা-১৯), চাঁপাইনবাবগঞ্জ (খিত্তা-২০), নাটোর (খিত্তা-২৩), নওগাঁ (খিত্তা-২৪), নড়াইল (খিত্তা-২৬), সিরাজগঞ্জ (খিত্তা-২৯), টাঙ্গাইল (খিত্তা-৩১), রংপুর (খিত্তা-৩২), গাইবান্ধা (খিত্তা-৩৩), লালমনিরহাট (খিত্তা-৩৪), মুন্সীগঞ্জ (খিত্তা-৩৫), যশোর (খিত্তা-৩৬), নীলফামারী (খিত্তা-৩৭), বগুড়া (খিত্তা-৩৮), জয়পুরহাট (খিত্তা-৩৯), নারায়ণগঞ্জ (খিত্তা-৪০), ফরিদপুর (খিত্তা-৪১), ভোলা (খিত্তা-৪২), নরসিংদী (খিত্তা-৪৩), সাতক্ষীরা (খিত্তা-৪৪), বাগেরহাট (খিত্তা-৪৫), কুষ্টিয়া (খিত্তা-৪৬), মেহেরপুর (খিত্তা-৪৭), চুয়াডাঙ্গা (খিত্তা-৪৮), ময়মনসিংহ (খিত্তা-৪৯, ৫১), শেরপুর (খিত্তা-৫০), জামালপুর (খিত্তা-৫২), গোপালগঞ্জ (খিত্তা-৫৩), কিশোরগঞ্জ (খিত্তা-৫৪), নেত্রকোনা (খিত্তা-৫৫), ঝালকাঠি (খিত্তা-৫৬), বান্দরবান (খিত্তা-৫৭), বরিশাল (খিত্তা-৫৮), পিরোজপুর (খিত্তা-৫৯), হবিগঞ্জ (খিত্তা-৬০), কক্সবাজার (খিত্তা-৬১), সিলেট (খিত্তা-৬২), সুনামগঞ্জ (খিত্তা-৬৩), ফেনী (খিত্তা-৬৪), নোয়াখালী (খিত্তা-৬৫), লক্ষ্মীপুর (খিত্তা-৬৬), চাঁদপুর (খিত্তা-৬৭), ব্রাহ্মণবাড়িয়া (খিত্তা-৬৮), খুলনা (খিত্তা-৬৯), পটুয়াখালী (খিত্তা-৭০), বরগুনা (খিত্তা-৭১), চট্টগ্রাম (খিত্তা-৭৪), কুমিল্লা (খিত্তা-৭৫), তুরাগ নদের পশ্চিমপাড় কাঁচাবাজারে মৌলভীবাজার (খিত্তা-৭৬), রাজবাড়ী (খিত্তা-৭৭), মাদারীপুর (খিত্তা-৭৮), শরীয়তপুর (খিত্তা-৭৯), মানিকগঞ্জ (খিত্তা-৮০, সাফা টাওয়ার), রাঙ্গামাটি (খিত্তা-৮১), খাগড়াছড়ি (খিত্তা-৮২), দিনাজপুর (খিত্তা-৮৩), পাবনা (খিত্তা-৮৪), ঠাকুরগাঁও (খিত্তা-৮৫), ঝিনাইদহ (খিত্তা-৮৭, যমুনা প্লট), মাগুরা (খিত্তা-৮৮, যমুনা প্লট), কুড়িগ্রাম (খিত্তা-৮৯, কামারপাড়া বেড়িবাঁধ বঙ্গবন্ধু মাঠ), পঞ্চগড়ের (খিত্তা-৯০) কামারপাড়া হাইস্কুল মাঠ-বধির স্কুল ভবন)।
এছাড়াও ময়দানের চারপাশে ১১ ও ১২ নম্বর খিত্তার কিয়দংশ, ৩২ ও ৩৭ নম্বর খিত্তার মাঝামাঝি ১২ নম্বর, ৭২, ৭৩, ৮৬ ও ৯১ নম্বর খিত্তাগুলো সংরক্ষিত হিসেবে রাখা হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির শীর্ষ মুরব্বি ডা. খান মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন।
এদিকে সার্বিক নিরাপত্তা নিয়ে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার মোল্যা নজরুল ইসলাম বলেন, ইজতেমার সার্বিক নিরাপত্তায় সাড়ে ৭ হাজার পুলিশ মোতায়েন থাকবে। সিসিটিভি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার ও রুফটপ থেকে পুরো ইজতেমা ময়দান পর্যবেক্ষণ করা হবে। এ ছাড়া বিশেষায়িত টিমসহ প্রতিটি খিত্তায় সাদা পোশাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। অগ্নি নির্বাপণের জন্য প্রতি খিত্তায় এবার দুটি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা হবে।
ইজতেমা ময়দানে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের নিরাপত্তায় পুরো ময়দানে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ ও র্যাবের পক্ষ থেকে প্রায় তিন শতাধিক ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে। সিসিটিভির মাধ্যমে কন্ট্রোল রুম থেকে পুরো ময়দানের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন টঙ্গী পশ্চিম থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. শাহ আলম।
উল্লেখ্য, আগামী ১৩ জানুয়ারি শুরু হয়ে ১৫ জানুয়ারি রোববার আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে প্রথম পর্বের বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে। মাঝে ৪ দিন বিরতি দিয়ে ২০ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয়ে ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মাধ্যমে এবারের বিশ্ব ইজতেমার পরিসমাপ্তি ঘটবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন