আওয়ামী লীগ সব সময় ইসলামের সেবক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদরাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও ইজতেমা মাঠের জায়গা দেয়ার পাশাপাশি দেশে ঘোড়দৌড় ও জুয়া খেলা এবং মদ খাওয়া বন্ধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশকে ওআইসির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। গতকাল গণভবন থেকে সারা দেশে ভার্চুয়ালি ৫০টি মডেল মসজিদের উদ্বোধনকালে এ সব কথা বলেন। দেশে ইসলামী সংস্কৃতি লালন ও বিকাশে কাজ করার আহŸান জানিয়ে তিনি বলেন, মসজিদে ইসলামী মূল্যবোধের চর্চা হবে, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান আরো বাড়বে, ইসলামী সংস্কৃতি লালন ও বিকাশের আরো সুযোগ থাকবে এবং ইসলাম ধর্মকে আরো উন্নতভাবে পালনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনকালে দেশের প্রায় ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৩টি মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিনদের অনুক‚লে ৫ হাজার টাকা হারে ১২২ কোটি ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা তার সরকার অনুদান হিসেবে দিয়েছে। পাশাপাশি করোনাকালীন কওমী মাদরাসার আয়ের পথ রূদ্ধ হওয়ায় দেশের ১৩ হাজার ৯৪৪টি কওমী মাদরাসায় ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছে। এর আগে ’৯৬ সালে ২১ বছর পর প্রথম সরকারে এসেই ইমাম-মুয়াজ্জিনদের জন্য ‘সীড মানি’ দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। তিনি বলেন, আমি এটুকুই চাই আমাদের দেশে সত্যিকারের ইসলামের জ্ঞানচর্চা হোক। কেননা আমরা ২৭ হাজার ৮৩২টি মসজিদ পাঠাগার স্থাপন করেছি তাছাড়া মসজিদ পাঠাগার স¤প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে আরো ২ হাজার ৫০০টি নতুন পাঠাগার স্থাপনে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ২ লাখ ১২ হাজার ৬৪৭ জন ইমামকে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, ৯৫ হাজার ৮৫ জনকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ৩৪ হাজার ৩২৩ জন ইমামকে অন্যান্য প্রশিক্ষণ এবং ৩ হাজার ৬১৩ জন ইমামকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী মসজিদ উদ্বোধন করতে পারায় মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে শোকরিয়া আদায় করেন এবং সূরা তওবার ১৮ নম্বর আয়াতের বাংলা তরজমা উচ্চারণ করে বলেন, আমি এটুকুই বলবো আমাদের এই ধর্ম নিয়ে কেউ যেন আর কোনো রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে না পারে। আমাদের আলেম ওলামাগণ হচ্ছে ‘ওরাসাতুল আম্বিয়া’। মানুষ মসজিদের ইমাম, খাদেম এবং আলেম-ওলামাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে দেখে। আমাদের সমাজে যেসব অসঙ্গতি রয়েছে যে বাল্যবিবাহ, মাদকাসক্তি, নারীর প্রতি সহিংসতা, গৃহকর্মী ও অধীনস্থদের নির্যাতন, খাদ্যে ভেজাল এবং দুর্নীতি ইত্যাদি দূরীকরণে ইমাম ও খতিব সাহেবগণকে আমার অনুরোধ থাকবে আপনারা যখন মসজিদে কোনো বয়ান দেন বা জুমার নামাজে খুৎবা পড়েন সে সময় এই বিষয়গুলো থেকে মানুষ যাতে বিরত থাকে সে বিষয়গুলো আপনারা মানুষের সামনে তুলে ধরবেন এবং এর বিপরীতে সঠিক মানবিক গুণগুলো যাতে উঠে আসে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন। তাছাড়া, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ-মাদক এগুলো আমাদের সমাজকে, এক একটা পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্থ করছে। এই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ থেকে যেন প্রত্যেকের ছেলে-মেয়েরা বিরত থাকে, এটা যে ইসলাম ধর্মের প্রতি কোনো সম্মান নয় বরং ইসলামের বদনাম হয় সেই বিষয়টার দিকে সকলে যাতে সচেতন হয়। নিজেদের সন্ততির দিকে নিজেরা যেমন তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও তাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। আপনাদের ছেলে-মেয়ে কোথায় যায় এবং কার সঙ্গে মেলামেশা করে, জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসের সঙ্গে যেন কোনোভাবে সম্পৃক্ত না হয়। এসব বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও আপনারা অবদান রাখতে পারেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এই মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো থেকে জনগণ ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করবে; যা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও নারী নির্যাতন বন্ধে ব্যাপক অবদান রাখার পাশাপাশি ধর্মের নামে বিভ্রান্তি দূর করতে সহায়তা করবে। আমরা মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছি। কারণ, এতে ইসলামের নামে কেউ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।
শেখ হাসিনা বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বর্তমান সরকার চলে বলেই ইসলাম ধর্ম এবং শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয়; দীর্ঘদিনের দাবিপূরণ করে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়েছে; ইসলামিক আরবি বিশ^বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে। তাছাড়া প্রতিটি উপজেলা ও জেলা সদরে একটি করে মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ যেন মানুষকে বিপথে নিতে না পারে, প্রকৃত ইসলামের মূল্যবোধ সম্পর্কে মানুষের মাঝে যেন সচেতনতার সৃষ্টি হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রেখেই এই মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প আমরা গ্রহণ করি এবং নির্বাচনী ইশতেহারেও সেটার ঘোষণা দেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ হচ্ছে মুসল্লীদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দ্বীনি দাওয়াতি কার্যক্রমের সুবিধাদি সৃষ্টি করা, সন্ত্রাস- জঙ্গিবাদ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, সরকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার নীতি নির্ধারণের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাধীনভাবে ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধের প্রসার ঘটানো। এছাড়া, এখানে একটি লাইব্রেরিও থাকবে। কেননা ইসলাম ধর্মের ভাতৃত্ব এবং সাম্যের প্রচার এবং প্রসারও-এর একটি অন্যতম লক্ষ্য।
শেখ হাসিনা বলেন, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত মসজিদগুলোতে ওজু ও নামাজের জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে। এছাড়া হাজীদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণা কেন্দ্র ও ইসলামিক লাইব্রেরি, অটিজম কর্নার, দাফনের আগে আচার, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও কুরআন শিক্ষার ব্যবস্থা, ইসলামী সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের জন্য সম্মেলন কক্ষ ও থাকবে। ইসলামিক দাওয়াত, ইসলামী বই বিক্রয় কেন্দ্র, দেশি-বিদেশি অতিথিদের জন্য বোর্ডিং সুবিধাও এখানে থাকছে।
দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫০টি মসজিদ উদ্বোধনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত ৯৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৫৬৪টির মধ্যে ১০০টি মসজিদ উদ্বোধন করলেন। তিনি এর আগে ২০২১ সালের ১০ জুন প্রথম ধাপে ৫০টি মসজিদ উদ্বোধন করেছিলেন। আগামী ফেব্রæয়ারির শেষে তৃতীয় ধাপে আরো ৫০টি মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চালু করা হবে।
ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান বক্তব্য দেন।
৫০টি মসজিদ : ভাঙ্গা উপজেলা ও ফরিদপুরের নগরকান্দা, গাজীপুরের কাপাসিয়া, গোপালগঞ্জের সদর উপজেলা, সদর উপজেলা ও কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, ঘিওর উপজেলা ও মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া, সদর উপজেলা ও নরসিংদীর মনোহরদী, গোয়ালন্দ উপজেলা মডেল মসজিদ রাজবাড়ি, জেলা সদর শরীয়তপুর ও ভেদরগঞ্জ উপজেলা, ধুনট উপজেলা ও বগুড়ার নন্দীগ্রাম, নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলা, নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলা, ভাঙ্গুড়া ও সুজানগর উপজেলা পাবনা, সিরাজগঞ্জের কাজীপুর, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন, রংপুরের কাউনিয়া ও গঙ্গাচরা ঠাকুরগাঁওয়ের সদর উপজেলা, শেরপুরের সদর উপজেলা, পিরোজপুরের সদর উপজেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলা ও কশবা, খাগড়াছড়ির সদর উপজেলা ও মানিকছড়ি, কুমিল্লার চান্দিনা ও চৌদ্দগ্রাম, খুলনার রূপসা, খোকসা ও ভেড়ামারা কুষ্টিয়া। জেলা সদর ও গাংনী মেহেরপুর, সাতক্ষীরার দেবহাটা, সিলেটের গোয়াইনঘাট, জেলা সদর ও সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুর, হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট।
৩ মাসে প্রধানমন্ত্রীর তিন সফর
আগামী তিন মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তিনটি বিদেশ সফর নিয়ে প্রস্তুতি চলছে। ফেব্রæয়ারি মাসে আলজেরিয়া, মার্চ মাসে কাতার এবং এপ্রিল মাসে জাপান সফর নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সফরের প্রস্তুতি হিসেবে আমরা দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছি।
আলজেরিয়ায় দ্বিপক্ষীয় সফরে আমন্ত্রণ করা হয়েছে জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় ন্যাম শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের সরব উপস্থিতির একটি ভালো সূচনা হয়েছিল ওই দেশে। দীর্ঘদিন পরে আমন্ত্রণ জানানো হলে যাওয়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী সম্মতি জ্ঞাপন করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ওই দেশের সরকারের সঙ্গে আমরা একটি সম্ভাব্য তারিখ নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি।
এদিকে আরেক কর্মকর্তা বলেন, মার্চ মাসের ৫ থেকে ৯ তারিখ দোহায় পঞ্চম এলডিসি শীর্ষ সম্মেলন হবে এবং সেখানে প্রধানমন্ত্রী অংশ নেবেন। ২০১১ সালে ইস্তান্বুলে অনুষ্ঠিত চতুর্থ এলডিসি সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী যোগ দিয়েছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, আগামী ২০২৬-এ বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে যাবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ হওয়া দেশগুলোর উন্নয়ন যাত্রা মসৃণ করার ক্ষেত্রে একটি দিকনির্দেশনা যেন থাকে, সেটির জন্য এই সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ।
গত বছরের নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান সফর স্থগিত হয়। ওই সফর এবার এপ্রিলে করার জন্য দুই দেশের সরকার আলোচনা করছে বলে জানিয়েছে আরেকটি সূত্র। তার দাবি, ইতোমধ্যে জাপান থেকে একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ ঘুরে গেছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সম্ভাব্য জাপান সফর নিয়ে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন