দেশে দিন দিন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে অপরাধমূলক কর্মকা-ও বেড়ে চলেছে। এখন স্মার্টফোন দিয়ে মুহূর্তেই স্পর্শকাতর একটি বিষয়কে ভাইরাল করা সম্ভব। এই প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায় নেতিবাচক ও অপরাধমূলক কাজে।সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণে নতুন আইন প্রণয়নের চিন্তা করছে সরকার। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, লাইকির মতো অ্যাপের মাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচার ছড়ানো বেড়ে যাওয়ায় এই উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, তুরস্কে এরই মধ্যে এ ধরনের আইন রয়েছে। সর্বশেষ আইন অনুমোদন করেছে রাশিয়া। বাইরের এসংক্রান্ত আইনগুলো পর্যালোচনা করে বাংলাদেশেও তা প্রণয়ন হবে বলে দায়িত্বশীল সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে। প্রস্তাবিত আইনে বিদেশি সোশ্যাল প্ল্যাটফর্মগুলোর ডাটা সেন্টার বা শাখা অফিস বাংলাদেশে স্থাপনের বাধ্যবাধকতার বিধান রাখা হচ্ছে। এটি করা গেলে অপপ্রচারকারীদের খুব সহজেই শনাক্ত ও বিচারের আওতায় আনা সম্ভব হবে। বর্তমানে এমন কর্মকা- মনিটরিং করার সুযোগ থাকলেও প্রতিরোধব্যবস্থা প্রায় নেই।আর তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহ মানুষের পারস্পরিক যোগাযোগ সহজ করেছে। এখন পৃথিবীর এক প্রান্তের মানুষ অন্য প্রান্তের চেনাজানা আপনজন বা অপরিচিত কোনো মানুষের সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান ও তথ্যের বিনিময় করতে পারে খুব সহজেই। প্রযুক্তির এই উন্নয়ন মানুষের জীবনকে সহজ ও সাবলীল করেছে। গোটা মানবজাতিকে গতিশীল করেছে।
কিন্তু একই সঙ্গে তথ্যের অবাধ প্রবাহ মানুষকে বিভ্রান্তও করছে।মানুষ স্বার্থ হাসিলের জন্য সমাজে ভুল ও মিথ্যা কিংবা আংশিক মিথ্যা ছড়িয়ে দিচ্ছে।সমাজে ভয়ভীতি ও আতঙ্কের সৃষ্টি করছে।প্রযুক্তির উন্নয়নের সঙ্গে এই গুজব ও মিথ্যার সয়লাব প্রায় অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে দিন দিন। গুজবের এই ভয়াবহতা থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন কঠোর আইন, নৈতিক শিক্ষা ও সামাজিক সচেতনতা।গুজব শব্দটি বাংলা যার আরবি প্রতিশব্দ ইশায়াতুন। অর্থ রটনা বা মিথ্যা তথ্য ছড়ানো, যার কোন ভিত্তি নেই। জনসাধারণ সম্পর্কিত কোনো বিষয়, ঘটনা, তথ্য বা ব্যক্তি নিয়ে মুখে মুখে প্রচারিত অমূলক, বিকৃত ও বর্ণনা বা গল্পকে গুজব বলা হয়। সামাজিক বিজ্ঞানের ভাষায় গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি যার সত্যতা নিশ্চত বা উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। গুজব অনেক ক্ষেত্রে ‘ভুল তথ্য’ এবং ‘অসঙ্গত তথ্য’ বোঝাতেও ব্যবহৃত হয়। প্রতিনিয়ত গুজব শুনতে শুনতে আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। ফলে গুজব মাঝে মাঝে বিশ্বাসে পরিণত হওয়ার উপক্রম হয়ে উঠে। গুজবের কারণে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব-কলহের শেষ নেই। গুজব সৃষ্টি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিদ্বেষ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে যেমনিভাবে র্যাব-পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট তাদের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার ও কঠোর অবস্থানে। তেমনি গুজব প্রতিরোধে ইসালামেরও রয়েছে চমৎকার দৃষ্টিভঙ্গি ও অত্যন্ত শক্তিশালী অবস্থান। ইসলামে গুজবের কোনো স্থান নেই এবং এ বিষয়টি ইসলামে খুবই গর্হিত কাজ হিসেবে চিহ্নিত। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে গুজব তথা মিথ্যা অপপ্রচারের ব্যাপারে স্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। গুজব ছড়ানো ইসলামে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গুজব ছড়িয়ে যারা মানুষের নিরাপত্তা বিঘœত করে এবং সম্মানহানি করে তাদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধানও রয়েছে ইসলামে। গুজব ও অপপ্রচার সম্পর্কে কোরআন ও হাদিসে থেকে নি¤েœ আলোকপাত করা হলো..ইসলামের দৃষ্টিতে মানবজীবনের প্রতিটি মুহূর্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পরকালে মানুষকে তার প্রতিটি কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। সুতরাং একজন মুসলিম কল্যাণশূন্য কোনো কাজে লিপ্ত হবে না। আর যে কাজে নিজের ও সমাজের কোনো ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, তা থেকে অবশ্যই বিরত থাকবে। গুজব তেমনই একটি কাজ। গুজব মানেই ভিত্তিহীন কোনো কথার প্রচার। চাই তা মানুষ হাসানোর জন্য হোক বা মানুষের ভেতর ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য করা হোক। ইসলাম কোনো অবস্থায়ই গুজব ছড়ানোকে সমর্থন করে না। ইসলামের শিক্ষা হলো, মানুষ সর্বতোভাবেই তা পরিহার করবে। বরং প্রয়োজন ব্যতীত কোনো কথা সে বলবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে চুপ থাকে সে মুক্তি পায়। ’ (তিরমিজি, হাদিস: ২৫০১)
অনেকের মধ্যে নিজের বিশ্বাস প্রচারের প্রবণতা দেখা যায়, যারা প্রচারিত কোনো সংবাদ নিজের মত, মতবাদ ও দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে হলে তা যাচাইয়ের প্রয়োজন বোধ করে না। পাওয়ামাত্রই প্রচার শুরু করে। ইসলাম এই প্রবণতা পরিহারের নির্দেশ দিয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘সব শোনা কথা প্রচার ব্যক্তির মিথ্যাবাদী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস: ৪৯৯২)
হাদিসবিশারদরা এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলেছেন, কোনো কথা শুনেই প্রচারের প্রবণতা মানুষকে মিথ্যায় লিপ্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ায়। ফলে সে পৃথিবীতে লজ্জিত হয় এবং পরকালেও তার জন্য রয়েছে শাস্তির বিধান।
সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত অনেক সংবাদের সঙ্গে সামাজিক স্বার্থ জড়িত থাকে। এমন সংবাদের প্রচার মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে রক্ষা করে এবং কখনো কখনো বড় ধরনের বিপর্যয় থেকেও আত্মরক্ষার উপলক্ষ হয়। এমন জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট ব্যাপারেও ইসলামের নির্দেশনা হলো, সংবাদ প্রচারের আগে অবশ্যই তা যাচাই করে নিতে হবে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমাদের কাছে যদি কোনো ফাসেক ব্যক্তি কোনো সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তা যাচাই করো। অজ্ঞতাবশত কোনো গোষ্ঠীকে আক্রান্ত করার আগেই, (না হলে) তোমরা কৃতকর্মের জন্য লজ্জিত হবে। ’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত: ৬)
অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই, তার অনুসরণ কোরো না। নিশ্চয়ই কান, চোখ, অন্তরের প্রতিটি বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে। ’ (সুরা বনি ইসরাঈল, আয়াত : ৩৬)
যে নেতিবাচক সংবাদের সঙ্গে সমাজ, জাতি ও উম্মাহর স্বার্থের সম্পর্ক নেই—শুধু ব্যক্তিগত রাগ, ক্ষোভ ও অভিমান থেকে হয়ে থাকে, তা প্রচার করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা তা অপবাদের স্তরভুক্ত হবে। পবিত্র কোরআনে অপবাদের ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি রয়েছে। এমন নেতিবাচক সংবাদের যদি কোনো ভিত্তিও থেকে থাকে, তবে তা গিবত বা পরনিন্দা বিবেচিত হবে। শরিয়তে গিবতও জঘন্যতম অপরাধ। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা পরস্পরের দোষচর্চা কোরো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত খেতে পছন্দ করবে? নিশ্চয়ই তোমরা তা অপছন্দ করবে। তোমরা আল্লাহকে ভয় করো, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়ালু। ’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১২)
গুজব ছড়ানোর পেছনে প্রধান উদ্দেশ্য থাকে মানুষকে বিভ্রান্ত করা। তাদের আতঙ্কিত করা। মানুষের ভেতর বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করাকে কোরআনে মুনাফিকের বৈশিষ্ট্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘যদি তারা তোমাদের সঙ্গে বের হতো, তবে শুধু বিভ্রান্তিই বৃদ্ধি পেত। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য তারা তোমাদের ভেতর ছোটাছুটি করত। তোমাদের ভেতর তাদের কথা শোনার (বিশ্বাস করার) লোক রয়েছে। আল্লাহ অত্যাচারীদের সম্পর্কে অবগত আছেন। ’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৪৭)
সমাজে বা সামাজিক মাধ্যমে এমন আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে মুসলিম সমাজের উচিত তাতে আক্রান্ত না হওয়া। তার প্রসারে সহযোগিতা না করা। বরং যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণের মাধ্যমে তা সমাধানের চেষ্টা করা। পবিত্র কোরআনেও এমনটাই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘যখন তাদের কাছে নিরাপত্তা বা ভয়ের কোনো সংবাদ পৌঁছে, তখন তারা তা প্রচার করে। যদি তারা তা (সংবাদটি) রাসুল বা তাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তির দৃষ্টিগোচর করত, তবে তাদের (দায়িত্বপ্রাপ্ত) অনুসন্ধানকারীরা তার যথার্থতা নির্ণয় করতে পারত। তোমাদের প্রতি যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত না থাকত, তবে সামান্যসংখ্যক ব্যতীত সবাই শয়তানের অনুসরণ করত। ’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৮৩)
আর কোনো বিষয়ে ভিত্তিহীন তথ্য প্রচার করাই হচ্ছে অপপ্রচার। আমাদের সমাজে বিভিন্ন বিষয়ে অপপ্রচার মহামারীর আকার ধারণ করেছে। বর্তমানে এটা প্রতিপক্ষকে দমনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। কোনো ব্যক্তি অথবা কোনো প্রতিষ্ঠান কিংবা কোনো দলকে জনসাধারণের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করতে অপপ্রচারের বিকল্প নেই। ইসলামের দৃষ্টিতে কারও বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে তার সম্মানহানি করা জঘন্য পাপ। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো ভুল করে কিংবা কোনো পাপ করে অতঃপর কোনো নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি অপবাদ আরোপ করে, সে জঘন্য মিথ্যা ও প্রকাশ্য পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা নিসা : ১১২)
যারা কোনো কথা শোনামাত্র সত্যতা যাচাই না করেই মানুষের কাছে প্রচার করে বেড়ায়, রাসুলুল্লাহ (সা.) তাদেরকে মিথ্যাবাদী হিসেবে গণ্য করেছেন। মিথ্যা হলো সব পাপের মূল। আর মিথ্যা মানুষকে জাহান্নামের পথে টেনে নিয়ে যায়। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কোনো ব্যক্তির মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত হওয়ার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোনো কথা শোনামাত্রই (তার সত্যতা যাচাই না করেই) মানুষের কাছে বলে বেড়ায়।’ (আবু দাউদ : ৪৯৯২)
আলোচ্য আয়াত থেকে গুজব রটানো শয়তানের কাজ বলেই প্রমাণিত হয়। আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিসেও গুজবকে শয়তানের কাজ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘শয়তান মানুষের রূপ ধরে তাদের কাছে আসে এবং তাদের মিথ্যা কথা শোনায়। অতঃপর লোকজন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং তাদের কেউ বলে, আমি এমন এক ব্যক্তিকে এ কথা বলতে শুনেছি, যার চেহারা চিনি, কিন্তু নাম জানি না। ’ (সহিহ মুসলিম)
পরিশেষে বলতে চাই, বর্তমান আমরা দেখতে পাই সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কোন কিছু পোস্ট করল আর তার সত্যতা যাচাই না করেই সাথে সাথে হাজার হাজার শেয়ার আর লাখ লাখ লাইক হয়ে তা ভাইরালও হয়ে যায়। এরফলে যে দেশে কী ধরণের ক্ষতি হতে পারে তা আমরা একবারের জন্যও চিন্তা করি না। আসলে বিভিন্ন মিথ্যা সংবাদ ও গুজব ছড়িয়ে দেশের আইন-শৃঙ্খলা নষ্ট করা মারাত্মক অপরাধ আর এসব শয়তানের কাজ। যারা গুজব ছড়ায় তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিহত করতে হবে।আর মুসলমানের দায়িত্ব হলো, সমাজে কোনো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে তার প্রচার ও প্রসার থেকে বিরত থাকা। বাস্তবতা অনুসন্ধান করে নিজে সতর্ক হওয়া এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষকে তা অবগত করা। সর্বোপরি নিজের, পরিবারের, সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য মহান আল্লাহর দরবারে দোয়া করা।
লেখক- ইসলামী গবেষক ও কলাম লেখক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন