পৃথিবীতে কেউ যদি কারো উপকার করে কিংবা কারো উপর অনুগ্রহ, দয়া ও অনুকম্পা করে, তাহলে তার নৈতিক দায়িত্ব হলো, সেই ব্যক্তির কথা স্মরণ রাখা। তার উপকারের কথা মনে রাখা। তাঁকে স্মরণ রাখার মাধ্যমে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তার অনুগত থাকা। আল্লাহ তাআলা আমাদের স্রষ্টা ও মালিক। আমাদের ওপর তার উপকারের কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। তিনি আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন। অনস্তিত্ব হতে অস্তিত্ব দান করেছেন। লালন-পালন করে প্রতিনিয়ত বাঁচিয়ে রাখছেন। প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের উপর অনুগ্রহ করে চলেছেন। এমন অনুকম্পাশীল সত্তার কথা স্মরণ করা ও তার উপকারের কথা মনে রাখা অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গে সঙ্গে তা মানুষের নৈতিক দায়িত্বও বটে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা ‘আল্লাহর স্মরণ : গুরুত্ব ও প্রাপ্তি’ সম্পর্কে আলোকপাত করছি।
স্মরণ রাখার ঐশী নির্দেশ: আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বিশ্বচরাচরের স্রষ্টা ও মালিক। তিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করে একে মানুষের বাসযোগ্য করেছেন। ফলে মানুষ পৃথিবীর বুকে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারে। জীবন যাপন করতে সক্ষম হয়। এই পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য করার অপরিহার্য দাবি হলো মানুষ তাঁর স্রষ্টা ও পালনকর্তা মহান আল্লাহকে সব সময় স্মরণ রাখবে। আপন স্রষ্টা ও মালিককে ভুলে যাওয়ার অন্যায় ও অকৃতজ্ঞতা হতে বিরত থাকবে। তাই মহান আল্লাহ ঈমানদার বান্দাদেরকে তার কথা স্মরণ রাখার নির্দেশ দিয়ে পবিত্র কুরআন শরিফে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ করো এবং সকাল বিকাল আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা করো।’ (সুরা আহযাব, আয়াত : ৪১-৪২) অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেছেন, আপনি এমন লোকদের সঙ্গে অবস্থান করুন যারা আমাকে আহ্বান করে। আমার কথা স্মরণ করে। আমার জিকির করে। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আপনি নিজেকে তাদের সংসর্গে আবদ্ধ রাখুন যারা সকাল ও সন্ধ্যায় তাদের পালনকর্তাকে তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে আহবান করে এবং আপনি পার্থিব জীবনের সৌন্দর্য কামনা করে তাদের থেকে নিজের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেবেন না। যার মনকে আমার স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি, যে নিজের প্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং যার কার্য কলাপ হচ্ছে সীমা অতিক্রম করা, আপনি তার অনুগত্য করবেন না।’ (সুরা কাহফ, আয়াত : ২৮)
আল্লাহ স্মরণ রাখবেন: পৃথিবীর নিয়ম হলো যদি বড় কোন ব্যক্তি বা ক্ষমতাধর কোন মানুষ সাধারণ কোন ব্যক্তির কথা স্মরণ করে বা মনে রাখে, তাহলে সে অত্যন্ত খুশি হয়। একজন ঈমানদারের জন্য এর চেয়ে বড় খুশির বিষয় আর হতে পারে না যে, নভোম-ল ও ভূ-ম-লের স্রষ্টা মহান আল্লাহ তাঁকে স্মরণ করবেন এবং তার কথা মনে রাখবেন। আল্লাহ তাআলা এমন বান্দাদের কথা স্মরণ রাখেন যারা তার কথা স্মরণ রাখে বা জিকির করে। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কুরআন শরিফে ইরশাদ হয়েছে, ‘সুতরাং তোমরা আমাকে স্মরণ কর, আমিও তোমাদের স্মরণ রাখবো এবং আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর; অকৃতজ্ঞ হয়ো না।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ১৫২)
যদি কিছু লোক একত্রিত হয়ে কোন মজলিসে আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করে, তাহলে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ফেরেশতাদের মজলিসে এমন লোকদের কথা আলোচনা করেন। হজরত আবু সাঈদ খুদরি রা. বলেন, হজরত মুআবিয়া রা. মাসজিদে একটি ‘হালকা’র উদ্দেশে বের হলেন। অতঃপর তিনি বললেন, কীসে তোমাদেরকে এখানে বসিয়েছে? তোমরা এখানে বসেছ কেন? তারা বলল, আমরা আল্লাহর জিকির করতে বসেছি। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! এছাড়া আর কোন বিষয় তোমাদেরকে বসায় নি? তোমরা কি শুধু এ জন্যই বসেছ? তারা বলল, আল্লাহর শপথ! এছাড়া অন্য কোন বিষয় আমাদেরকে বসায়নি। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে অপবাদ দেওয়ার উদ্দেশে শপথ প্রার্থনা করি নি। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দৃষ্টিতে আমার যে সম্মান ছিল সে অনুযায়ী আমার চেয়ে কম হাদিস বর্ণনাকারী কেউ নেই। একবার রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সহাবাদের একটি ‘হালকা’র নিকটে গিয়ে বললেন, কীসে তোমাদের বসিয়েছে? তারা বলল, আমরা বসেছি আল্লাহর স্মরণ ও তাঁর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য। যেহেতু তিনি আমাদেরকে ইসলামের দিকে পথ দেখিয়েছেন এবং আমাদের উপর তিনি অনুগ্রহ করেছেন। তিনি বললেন, আল্লাহর শপথ! তোমাদেরকে কি শুধু এ বিষয়ই বসিয়েছে? তারা বলল, আল্লাহর শপথ! আমাদেরকে একমাত্র ঐ বিষয় বসিয়েছে। তিনি বললেন, আমি তোমাদেরকে অপবাদ দেওয়ার জন্যে শপথ করতে বলিনি; বরং আমার নিকট জিবরাঈল আলাইহিস সালাম এসে আমাকে অবহিত করেছেন, আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ফেরেশতাগণের নিকট তোমাদের মর্যাদা সম্পর্কে আলোচনা করছেন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৬৭৫০)
সৃষ্টিকুল আল্লাহকে স্মরণ করে: এই মহাবিশ্বে কত সৃষ্টি রয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান নেই। চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, তরুলতা, সাগর, মহাসাগর ও খাল-বিল সহ এমন কোনো সৃষ্টি নেই যা আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করে না। বিশ্বের প্রতিটি সৃষ্টি আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের কথা স্মরণ করে। এ ব্যাপারে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, ‘নভোম-ল ও ভূ-ম-লে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ঘোষণা করে। তিনি পরাক্রান্ত প্রজ্ঞাময়।’ (সুরা সফ, আয়াত : ০১) সৃষ্টিকুল আল্লাহকে স্মরণ করে মর্মে পবিত্র কুরআন শরিফের অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, ‘রাজ্যাধিপতি পবিত্র পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময় আল্লাহর পবিত্রতা ঘোষণা করে যা কিছু আছে নভোম-লে ও যা কিছু আছে ভূম-লে।’ (সুরা জুমআ, আয়াত : ১)
সাফল্য লাভ: পৃথিবীর নিয়ম হলো যদি কেউ প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী বা উচ্চতম কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে সম্পর্ক রাখে, তার কথা স্মরণ করে, তার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলে, তাহলে সেই ব্যক্তি প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রী বা উচ্চতম কর্মকর্তার আনুকূল্য লাভ করতে পারে। ঠিক তেমনিভাবে যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করে ও তার কথা মনে রাখে, তাহলে আল্লাহ তাআলাও তাকে আনুকূল্য প্রদান করেন। তার জন্য সফলতা লাভের পথসমূহ উন্মুক্ত করে দেন। মহান আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় সাফল্য লাভ করবে সে, যে শুদ্ধ হয় ও তার পালনকর্তার নাম স্মরণ করে, অতঃপর নামাজ আদায় করে।’ (সুরা আলা, আয়াত : ১৪-১৫) মহান আল্লাহকে স্মরণ করা সাফল্য লাভের উপায় মর্মে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হে ঈমানদারগণ, তোমরা যখন কোন বাহিনীর সাথে সংঘাতে লিপ্ত হও, তখন সুদৃঢ় থাক এবং আল্লাহকে অধিক পরিমাণে স্মরণ কর যাতে তোমরা উদ্দ্যেশ্য লাভে সফল হতে পার।’ (সুরা আনফাল, আয়াত : ৪৫)
পুণ্যলাভ: ইহকালের লাভ ও উপকারিতার কথা শুনলে আমরা অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে উঠি। সেই উপকার কীভাবে অর্জন করা যায় তার চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ি। অথচ ইহকালের জীবন ক্ষণিকের আর পরকালের জীবন অনন্ত কালের। পরকালীন জীবনের একমাত্র পাথেয় হলো পুণ্য। আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করার মাধ্যমে এই পাথেয় খুব সহজেই অর্জন করা যায়। হজরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, দুটি বাণী রয়েছে যেগুলো দয়াময় আল্লাহর কাছে অতি প্রিয়। উচ্চারণে খুবই সহজ এবং আমলের পাল্লায় অত্যন্ত ভারী। (বাণী দুটি হচ্ছে) সুবহানাল্লাহি ওয়া বিহামদিহি সুবহানাল্লাহিল আজিম। অর্থাৎ,আমরা আল্লাহ তাআলার প্রশংসাসহ তার পবিত্রতা ঘোষণা করছি। মহান আল্লাহ অতীব পবিত্র।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৭৫৬৩) অন্য আরেকটি হাদিসে আল্লাহর জিকিরের মাধ্যমে অতিশয় পুণ্য লাভের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ‘হজরত আমর ইবনু শুআইব রহ. পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদা থেকে বর্ণনা করেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি সকালে এবং সন্ধ্যায় একশত বার সুবহানাল্লাহ বলে, সে একশতবার হজ আদায় কারীর অনুরূপ। আর যে ব্যক্তি সকাল এবং সন্ধ্যায় একশতবার আলহামদুলিল্লাহ বলে, সে আল্লাহর পথে একশত ঘোড়া দানকারীর মতো অথবা তিনি বলেছেন একশত জিহাদে অংশগ্রহণকারীর মতো। আর যে ব্যক্তি সকালে এবং সন্ধ্যায় একশতবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলে সে হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালামের বংশের একশত দাস আজাদকারীর মতো। আর যে ব্যক্তি সকালে এবং সন্ধ্যায় একশতবার আল্লাহু আকবার বলে সেই দিনের মধ্যে তার চেয়ে আর কেউ অধিক কিছু আমল উপস্থাপন করতে পারবে না। তবে যে ব্যক্তি তার অনুরূপ সংখ্যায় পড়েছে অথবা তার চেয়ে অধিক সংখ্যায় পড়েছে সে ছাড়া।’ (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৭১)
অন্তরের প্রশান্তি লাভ: বিভিন্ন সময় মানুষের অন্তর অস্থির থাকে। আপদ বিপদ, বালা-মুসিবত ও সমস্যা-সংকটে বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতায় মানুষ ভোগে। কোন ভাবেই সে স্থির হতে পারে না। বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরণাপন্ন হয়েও তার অন্তর প্রশান্ত হয় না। এমন অস্থির চিত্তকে স্থির করা এবং অশান্ত চিত্তকে প্রশান্ত করার মহৌষধ হলো আল্লাহ তাআলার স্মরণ ও জিকির। যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ তাআলার কথা স্মরণ করে বা তার জিকির করে, তাহলে তার অন্তর প্রশান্ত হবে মর্মে পবিত্র কুরআনে এসেছে, ‘যারা বিশ্বাস স্থাপন করে এবং তাদের অন্তর আল্লাহর জিকির দ্বারা শান্তি লাভ করে; জেনে রাখ, আল্লাহর জিকির দ্বারাই অন্তরসমূহ শান্তি পায়।’ ( সুরা রাদ, আয়াত : ২৮)
স্মরণ না করার পরিণাম: যেসব লোক আল্লাহ তাআলাকে স্মরণ করে ও তার জিকির করে তিনি তাদের অন্তরে সঠিক বোধ-বিবেচনা গচ্ছিত করে দেন। পক্ষান্তরে যেসব লোক আল্লাহ তাআলাকে ভুলে যায় এবং তার স্মরণ হতে মুখ ফিরিয়ে নেয় আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দেন। ফলে এসব লোক কোন্ কাজে তাদের কল্যাণ রয়েছে এবং কোন্ কাজে অকল্যাণ রয়েছে তা বুঝতে সক্ষম হয় না। তারা এমন সব কাজ আঞ্জাম দেয় যেগুলো নিজেদের জন্য মন্দ পরিণতি ডেকে আনে। আল্লাহর স্মরণ হতে উদাসীন হওয়ার কারণে মহান আল্লাহ তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দেন। এ সম্পর্কে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে আল্লাহ তাআলা উল্লেখ করেন, ‘তোমরা তাদের মত হয়ো না, যারা আল্লাহ তাআলাকে ভুলে গেছে। ফলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে আত্মবিস্মৃত করে দিয়েছেন। তারাই অবাধ্য।’ (সুরা হাশর, আয়াত : ১৯)
লেখক : শিক্ষক, জামিয়া ইসলামিয়া ইসলামবাগ, চকবাজার, ঢাকা-১২১১
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন