নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা আসার পর থেকে গত ১৪ বছরে সরকার যেসব উন্নয়ন করেছে তা সকল জেলায় প্রচারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন এবং নির্বাচনের আগের সরকারের বিরুদ্ধে অপ্রচার বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া, জেলা প্রশাসকদের খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ওপর জোর দেওয়া এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা গ্রহণসহ ২৫টি নির্দেশনা বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশের কোনও জায়গায় যাতে কোনও ধরনের অপ্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করা না হয় সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে জেলা প্রশাসকদের প্রতি নির্দেশনা দেয়া হয়। গতকাল মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের শাপলা হলে জেলা প্রশাসক সম্মেলন-২০২৩ উদ্বোধনকালে তিনি এসব নির্দেশনা দেন। অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। স্বাগত বক্তব্য দেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন। ৪ জন বিভাগীয় কমিশনার এবং ২১জন ডিসি বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে স্থানীয় প্রশাসনের সার্বিক উন্নয়নের উপর একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। এ সময় দেশের সকল উন্নয়ন প্রকল্পের জমি অধিগ্রহণে ডিসিদের বিরুদ্ধে হয়রানীমুলক মামলা করা হচ্ছে জানিয়ে ডিসিরা এসব মামলার বিষয় প্রতিকারের দাবি জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কোভিড-১৯ কালীন এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট অর্থনৈতিক মন্দায় সারাবিশ্ব এখন হিমশিম খাচ্ছে। অনেক উন্নত দেশও অর্থনৈতিক মন্দার দেশ হিসেবে নিজেদের ঘোষণা দিয়েছে। কাজেই আমাদের যেন সেটা করতে না হয়, সেজন্যই আমরা কৃচ্ছ্র সাধনের ঘোষণা দিয়েছি, অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলেছি এবং এই ব্যাপারেও আপনারা সচেতন থাকবেন। তিনি বলেন, ডিসিদের বিবেচনা করতে হবে, যখনই কোনও প্রকল্প নেওয়া হয়, সেটা ওই এলাকার জন্য কতটুকু কার্যকর। এতে মানুষ কতটুকু লাভবান হবে এবং অপচয় কতটুকু বন্ধ করা যায়, সেদিকে আপনাদের নজরদারি থাকা উচিত। যত্রতত্র শুধু পয়সা খরচের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করা আমি পছন্দ করি না।
সারা দেশে ইভিএম কার্যকরী করতে ৮ হাজার কোটি টাকা প্রয়োজন হওয়ায় পরিকল্পনা কমিশন থেকে সেটা বাদ দেওয়ায় ‘বিরোধী দলের ব্যঙ্গোক্তি ও বাংলাদেশের আর্থিক সংকট’ এর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আর্থিক সংকট অবশ্যই সারা বিশ্বে আছে, আমাদেরও আছে। কিন্তু এমন পর্যায়ে নাই যে, আমরা চলতে পারবো না। আমাদের অগ্রাধিকার আমাদেরই বিবেচনা করতে হবে। মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা এবং চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করাই আমাদের অগ্রাধিকার। তিনি বলেন, মানুষের কল্যাণের কথা বিবেচনা করে আমাদের কৃষি উৎপাদন যাতে বাড়ে সেজন্য যা খরচ লাগে আমরা করবো। অন্য দেশ যা করেনি আমরা বিনামূল্যে ভ্যাকসিন দেয়ার জন্য হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছি। আমি আমাদের জেলা প্রশাসকদের একটা কথাই বলবো আমি (ক্ষমতায়) আসার পর আমাদের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে এই যে জনমুখী বা জনগণের পাশে দাঁড়ানোর বা জনগণকে সেবা দেওয়ার যে একটা আন্তরিকতা থাকা উচিত সে আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়েছে, এই পরিবর্তন আমি দেখেছি আপনাদের মাঝে। আর সেটা যদি না হতো বাংলাদেশের উন্নয়নের যতটুকু কাজ আমরা করতে পেরেছি বা সফলতা পেয়েছি সেটা সম্ভব হতো না। কারণ, আমরা জনপ্রতিনিধিরা একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যই ক্ষমতায় আসি।
প্রধানমন্ত্রী আপনাদের জনগণের সেবক হতে হবে। আমরাও যে জনপ্রতিনিধি হিসেবে যতটুকু সুযোগ-সুবিধা পাই বা আপনারা সরকারি আমলা হিসেবে যে সুযোগ-সুবিধা পান এগুলোর অবদান কিন্তু জনগনের। কারণ, জনগণের অর্থ এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকাতেই সবকিছু চলে। এর জন্য আমরা একেবারে তৃণমূল থেকে জনগণকে শক্তিশালী করে আনতে চাই। ‘আমার গ্রাম আমার শহর’ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রত্যেকটি গ্রামের মানুষকে শহরের সুবিধা দিয়ে দিতে চাই। এতে শহরমুখী প্রবণতা কমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে অর্থনৈতিক প্রাণ চাঞ্চল্য বৃদ্ধি পাবে।
ডিসিদের ২৫ দফা নির্দেশনা প্রধানমন্ত্রীর। এ গুলো হচ্ছে, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পতিত জমিতে ফসল ফলাতে হবে। কোনও জমি যেন অনাবাদি না থাকে সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। নিজেরা বিদ্যুৎ ও জ্বালানি ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে এবং জনগণকে এ ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। সরকারি অফিসগুলোতে সাধারণ মানুষ যেন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নির্বিঘেœ যথাযথ সেবা পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। সেবা প্রত্যাশীদের সন্তুষ্টি অর্জনই যেন হয় সরকারি কর্মচারীদের ব্রত। সরকারি তহবিল ব্যবহারে কৃচ্ছ্র সাধন করতে হবে। এসডিজি স্থানীয়করণের আওতায় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রাগুলো অর্জনে তৎপরতা জোরদার করতে হবে। দেশে একজনও ভূমিহীন ও গৃহহীন থাকবে না। গৃহহীনদের জন্য গৃহনির্মাণ, ভূমিহীনদের কৃষি খাসজমি বন্দোবস্তসহ সব সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে যেন প্রকৃত অসহায়, দুস্থ ও সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক শ্রেণির মানুষ সুযোগ পায় তা নিশ্চিত করতে হবে। জমি ও ঘর প্রদানের পাশাপাশি কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোর পাঠদান কার্যক্রমের মানোন্নয়নে উদ্যোগী হতে হবে। অপেক্ষাকৃত দুর্গম এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্রগুলো যেন কার্যকর থাকে তা প্রতিনিয়ত তত্ত¡াবধান করতে হবে। শিশু-কিশোরদের শারীরিক-মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে তাদের জন্য প্রত্যেক এলাকায় সৃজনশীল চর্চা, সাংস্কৃতিক কর্মকাÐ ও ক্রীড়া সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। নাগরিকদের সুস্থ জীবনাচারের জন্য জেলা ও উপজেলায় পার্ক, খেলার মাঠ প্রভৃতির সংরক্ষণ এবং নতুন পার্ক ও খেলার মাঠ তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে।
পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে উচ্চ প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন দক্ষ শ্রমশক্তি গড়ে তুলতে কাজ করতে হবে। সরকারি দফতরগুলোর ওয়েবসাইট নিয়মিত হালনাগাদ করতে হবে। নিজ নিজ জেলার সরকারের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সাফল্য ওয়েবসাইটে তুলে ধরতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি ও ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কাজ করতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার, গুজব ইত্যাদি রোধে উদ্যোগ নিতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির যেন কোনোভাবেই অবনতি না হয়, সেদিকে নজরদারি জোরদার করতে হবে। মিথ্যা গুজব ছড়িয়ে কেউ যেন স¤প্রদায়িক স¤প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। মাদক, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস দূর করতে হবে। নিরীহ ধর্মপ্রাণ মানুষ যাতে জঙ্গিবাদে জড়িত না হয় সে জন্য সচেতনতা তৈরির উদ্যোগ নিতে হবে। যুব সমাজকে মাদক, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ থেকে মুক্ত রাখতে হবে। বাল্যবিবাহ, ইভটিজিং, খাদ্যে ভেজাল, নকল পণ্য তৈরি ইত্যাদি অপরাধ প্রতিরোধে নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে, কৃত্রিম সঙ্কট রোধকল্পে ও পণ্যমূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সরকারি জমি, নদী, বনভূমি, পাহাড়, প্রাকৃতিক জলাশয় প্রভৃতি রক্ষায় কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণের উদ্দেশে নতুন সরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপনে ভবনের ঊর্ধ্বমুখী স¤প্রসারণকে প্রাধান্য দিতে হবে। নিয়মিত নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নাব্যতা বৃদ্ধি করতে হবে। ¯øুইচগেট বা অন্য কোনও কারণে যেন জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। বিশেষ করে পানিবদ্ধতার জন্য যেন উৎপাদন ব্যাহত না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বজ্রপাত প্রবণ এলাকায় তালগাছ রোপণ করতে হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং রক্ষণাবেক্ষণে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন পর্যটন স্পট গড়ে তুলতে হবে জেলার নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা এবং জেলাভিত্তিক বিখ্যাত পণ্যসমূহের প্রচার, বিপণন এবং ব্র্যান্ডিং করতে হবে। জনস্বার্থকে সবকিছুর ঊর্ধ্বে রেখে সেবার মনোভাব নিয়ে যেন সরকারি দফতরগুলো পরিচালিত হয়, সে লক্ষ্যে মনিটরিং জোরদার করতে হবে। জেলার সকল সরকারি দফতরের কার্যক্রমগুলো যথাযথ সমন্বয়ের মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে আপনাদের ব্রতী হতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন