শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ধর্ম দর্শন

দাওয়াত ও তাবলীগ : গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

মুফতি ইমামুদ্দীন সুলতান | প্রকাশের সময় : ২৬ জানুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

আল্লাহ তায়ালা মানুষ আর জীন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদাত করার জন্য। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে: “আমি মানুষ আর জীনজাতি সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদত করার জন্য” এবং আল্লাহ তায়ালা এই ইবাদতের রূপরেখা ও একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে নাযিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আল্লাহর এই শাশ্বত বিধান যথাযতভাবে মেনে চলার মধ্যেই উভয় জাহানের কল্যাণ নিহিত এবং চির শান্তি -মুক্তির ঠিকানা। এই অনুভূতি সবার হৃদয়ে জাগিয়ে তুলতে দাওয়াতের গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে লক্ষাধিক নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন। তাঁরা পৃথিবীতে এসে এই গুরু দায়িত্ব পালন করেছেন। হযরত আদম আ. থেকে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ সা. পর্যন্ত সকলের মিশন ছিল এক ও অভিন্ন। পথভোলা মানুষগুলোর দ্বারে দ্বারে গিয়ে সত্যের বাণী পৌঁছে দেয়া। ইসলামেই রয়েছে চির শান্তি সফলতা এই অনুভূতি জাগিয়ে তোলা। রাসুল সা. জীবনের দীর্ঘ ২৩ বছর এই মিশন নিয়েই মানুষদের দাওয়াত দিয়েছেন। উম্মতের আত্মভোলা মানুষগুলোর জন্য এতটা হতাশা ও আফসোস প্রকাশ করতেন যেন তিনি প্রাণ বিনাশ করে দিবেন। আল্লাহ বলেন: “অতঃপর যদি তারা এই মর্যাদাপূর্ণ বাণীর উপর ঈমান না আনে তাহলে আপনি তাদের জন্য দুঃখে আত্মা বিনাশ করে ফেলবেন?”। ( সূরা কাহাফ-৭)

স্বজাতির আধ্যাত্মিক মঙ্গলের জন্য রাসুল সা. এর উদ্বেগ উৎকণ্ঠার একটি জোরাল প্রমাণ এই আয়াত। আত্মভোলা মানুষগুলো যখন রাসুলের দাওয়াত গ্রহণ না করে সে ঐশী বাণী ও শিক্ষার বিরোধিতা এবং প্রত্যাখ্যান করেতো তখন এর মর্মযন্ত্রণা তাঁকে প্রায় মৃত্যুর নিকটবর্তী করে দিত। কিন্তু নবুয়তের ধারাবাহিকতা সর্বশেষ নবী মুহাম্মদ সা. এর মাধ্যমে পূর্ণতা লাভ করে। পৃথিবীতে আর কোন নবী আসবেন না। তাই দাওয়াতের এই গুরু দায়িত্ব রাসুল সা. এই উম্মতের উপর অর্পণ করেছেন। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলে কারীম সা. বলেন: ‘হে লোক সকল! তোমরা যারা উপস্থিত আছ তাদের দায়িত্ব হচ্ছে অনুপস্থিতদের এ বাণী পৌঁছে দেয়া’। (বুখারী-৪৪০৬)

অন্য হাদিসে রাসুল বলেন: আমার একটি বাণী হলেও তোমরা পৌঁছে দাও। (বুখারী-৩৪৬১) রাসুলের এই বাণী বাস্তবায়নে সাহাবায়ে কেরাম পৃথিবীর দিক দিগন্তে ছড়িয়ে পড়েন এবং মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে মহাসত্যের এ বাণী পৌঁছে দেন। তাইতো দেখা যায় লক্ষাধিক সাহাবায়ে কেরামদের মধ্য থেকে মাত্র অল্প সংাখ্যক সাহাবীর কবর মক্কা মাদিনায় পাওয়া যায়। আর বাকী সাহাবীদের কবর পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত। দাওয়াতের কাজে যে যেখানে ইন্তেকাল করেছেন তাঁকে সেখানেই দাফন করে দেয়া হয়। সাহাবায়ে কেরামের এই ত্যাগ ও কুরবানীর মাধ্যমেই সুদূর আরব থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ইসলামের আলো পৌঁছেছে। সাহাবায়ে কেরামের পর তাবেঈন তাবে তাবেঈন এবং তৎপরবর্তী মুখলেছ বান্দাগণ বিভিন্ন উপায়ে নানা পদ্ধতিতে এই দাওয়াত ও তাবলীগের আঞ্জাম দেন। তাবলীগ অর্থ হচ্ছে পোঁছে দেয়া। ইসলামের বাণী মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া। সৎ কাজের আদেশ করা অসৎ কাজ থেকে বাধা প্রদান করা। এই উম্মতে মুহাম্মদীর বৈশিষ্ট ও শ্রেষ্টত্যের কারণ হচ্ছে এই দাওয়াত। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে: “তোমরা শ্রেষ্ঠ উম্মত। তোমাদের মানুষের কল্যাণে সৃষ্টি করা হয়েছে। তোমরা মানুষদের সৎ কাজের আদেশ করবে এবং অন্যায়মূলক কাজ থেকে বাধা প্রদান করবে। এবং আল্লাহ উপর ইমান আনবে”।(আলে ইমরান- ১১০)

এই আয়াতে দাওয়াত ও তাবীলগকেই উম্মতে মুহাম্মদীর শ্রেষ্ঠত্যের কারণ বর্ণনা করেছেন। এবং এই দাওয়াতের প্রতি আল্লাহ তায়ালা নির্দেশও দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হচ্ছে: আর তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল থাকা উচিত যারা মানুষকে কল্যাণের পথে আহবান করবে। আর সৎ কাজের আদেশ করবে আর অন্যায় কাজে বাধা দিবে। তারাই হলো সফলকাম। (সূরা আল ইমরান-১০৪) অন্য আয়াতে আল্লাহ তায়ালা দাঈদের উৎসাহ ও প্রেরণা দিয়ে বলেন: “সে ব্যক্তির চেয়ে আর কার কথা উত্তম হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর পথে দাওয়াত দেয় এবং নিজে সৎ কাজ করে আর বলে আমি মুসলামনদের অন্তর্ভূক্ত”। (সূরা হা-মীম সিজদাহ-৩৩)

দাওয়াতের মাধ্যমেই আজ পুরো বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মহাসত্যের এই বাণী পৌঁছেছ। আলোকিত হয়েছে সারা বিশ^। দাওয়াতের মাধ্যমেই চৌদ্দশত বছরের আগের সেই মক্কার ইসলাম পৃথিবী বিস্তৃত এবং এখনো অক্ষুন্ন। এই দাওয়াতের শিক্ষা হচ্ছে সৃষ্টিকে ¯্রষ্টার আনুগত্যের প্রতি মনোনিবেশ করা এবং খালেকের সাথে মাখলুকের পরিচয় করে দেয়ার মাধ্যমে আত্মভোলা মানুষগুলোকে সঠিক পথের দিশা দেয়া। এই দায়িত্ব আমার আপনার এবং উম্মতে মুহাম্মদী সকলের। তাছাড়া একজন মুসলিমের দায়িত্ব কেবল নিজেকে শরীয়তের অনুসারী বানানোর দ্বারাই শেষ হয়ে যায় না; বরং তার পরিবার,প্রতিবেশি এবং সমাজের মানুষগুলোকেও শরীয়তের অনুসারী করে তোলার জন্য চেষ্টা করা এবং তাদেরকে কল্যাণের দিকে দাওয়াত দেয়াও তার দায়িত্ব। অন্যথায় শুধু নিজে শরীয়তের বিধান পালন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা যাবে না। সামগ্রিক আযাবে সেও পাকড়াও হবে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা সামগ্রিক আযাব থেকে সতর্ক করে ইরশাদ করেন, ‘আর তোমরা এমন ফাসাদ থেকে বেঁচে থাক যা বিশেষতঃ শুধু তাদের উপর পতিত হবে না যারা তোমাদের মধ্যে জালেম এবং জেনে রেখ যে, আল্লাহর আযাব অত্যন্ত কঠোর। (সূরা আনফাল-২৫) অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে,‘হে ঈমানদানগণ! নিজেদেরকে এবং তোমাদের পরিবারবর্গকে রক্ষা কর সে আগুন থেকে যার ইন্দন হবে মানুষ ও পাথর তাতে নিয়োজিত আছে পাষাণ হৃদয়,কঠোরস্বভাব ফেরেশতাগণ। আল্লাহ তায়ালা যা আদেশ করেন তা অমান্য করে না এবং করতে আদেশ করা হয় তাই করে। (সুরা তাহরীম-৬) তাই সামগ্রিক আযাব থেকে বাঁচতে হলে শুধু নিজেই আমল করা যথেষ্ট নয়; পাশাপাশি পথভোলা মানুষগুলোকেও আল্লাহর পথে নিয়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। দাওয়াত দিতে হবে। হাদিস শরীফে বিষয়টিকে খুব সুন্দর একটি দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝানো হয়েছে। নু‘মান ইবনু বাশীর (রাঃ) হতে বর্ণিত। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে মহান আল্লাহর নির্ধারিত সীমার মধ্যে প্রতিষ্ঠিত থাকে এবং যে সীমা লঙ্ঘন করে, তাদের দৃষ্টান্ত সেই যাত্রীদলের মতো, যারা লটারীর মাধ্যমে এক নৌযানে নিজেদের স্থান নির্ধারণ করে নিল। তাদেও কেউ স্থান পেল উপর তলায় আর কেউ নীচ তলায় (পানির ব্যবস্থা ছিল উপর তলায়) কাজেই নীচের তলার লোকেরা পানি সংগ্রহ কালে উপর তলার লোকদের ডিঙ্গিয়ে যেত। তখন নীচ তলার লোকেরা বলল, উপর তলার লোকেদের কষ্ট না দিয়ে আমরা যদি নিজেদের অংশে একটি ছিদ্র করে নেই (তবে ভালো হয়) এমতাবস্থায় তারা যদি এদেরকে আপন মর্জির উপর ছেড়ে দেয় তাহলে সবাই ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যদি তারা এদের হাত ধরে রাখে (বিরত রাখে) তবে তারা এবং সকলেই রক্ষা পাবে। (বুখারী-২৪৯৩) আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এই গুরু দায়িত্ব পালন করে শ্রেষ্ঠত্যের গুণ অর্জন করার তাওফিক দিন।


মুহাদ্দিস-জামিয়া ইমদাদিয়া আরাবিয়া শেখেরচর,নরসিংদী

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন