মেট্রোরেলের পর বাংলাদেশও পাতাল রেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। নিত্য যানজট থেকে মুক্তি পেতে রাজধানীর ঢাকার মানুষের এটাই এখন স্বপ্ন। যানজটের নগরী ঢাকাকে একটু স্বস্তি দিতে ইতোমধ্যেই নেয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। রাজধানীর যানজট নিরসন করে নগরবাসীকে একটু সাচ্ছন্দ্যে চলাচলের জন্য একাধিক ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হলেও শতভাগ উপকার পাননি সাধারণ মানুষ। বরং এখন যানজট নিরসনের জন্য নির্মিত ফ্লাইওভারের কয়েকটিতে নিয়মিতই যানজট লেগে থাকে। এছাড়ার এসব ফ্লাইওভারের নিচের রাস্তাতেও যানজট এখন নিত্যসঙ্গী।
বাংলাদেশ এবার পাতাল মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করতে যাচ্ছে। আনুষ্ঠানিকভাবে আজ এমআরটি লাইন-১-এর নির্মাণকাজ উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মেট্রোরেলটির পাতাল অংশ পড়েছে বিমানবন্দর, খিলক্ষেত, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ, কমলাপুরের মধ্যে। এ রুটের বিদ্যমান সড়কের নিচ দিয়ে তৈরি হবে পাতাল রেলপথ। এর বেশির ভাগই মাটির ১০ থেকে ৩০ মিটার নিচ দিয়ে যাবে। তবে সবচেয়ে গভীরতম অংশ হবে মালিবাগ-রাজারবাগের মধ্যবর্তী এলাকা। এ অংশে মাটির ৭০ মিটার নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন।
এবার হবে দ্বিতীয় মেট্রোরেল, যা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রেললাইন মাটির নিচে নির্মিত হবে। এটিই মেট্রোরেলের প্রথম পাতাল যাত্রা। মাটির নিচ দিয়ে চলবে বলে এটি পাতালরেল নামে পরিচিতি পাচ্ছে। ২ ফেব্রæয়ারি এই পাতালরেল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় বেলা ১১টায় এর উদ্বোধন হবে। পাতালরেল হচ্ছে ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি-১) প্রকল্পের আওতায়। এটি বাস্তবায়ন করবে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল)।
এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জে মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে ডিএমটিসিএল। এই প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এরমধ্যে জাপানি ঋণ ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। আর বাকি অর্থ সরকারি তহবিল থেকে মেটানো হবে।
প্রকল্প সূত্র জানায়, দ্বিতীয় মেট্রোরেল হবে উড়াল ও পাতাল পথের সমন্বয়ে। দুটি রুটে ৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এমআরটি লাইন-১ নির্মাণ হবে। এর মধ্যে বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত- এই রুটে মাটির নিচ দিয়ে চলবে রেল। এটি ১৯ দশমিক ৮৭ কিলোমিটার দীর্ঘ রুট। এই রুটে স্টেশন হবে মোট ১২টি। এগুলো হলো- বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর।
আর পূর্বাচল রুটে নতুন বাজার স্টেশনটি হবে পাতালে। এরপর নতুন বাজার থেকে পূর্বাচলের নারায়ণগঞ্জের পিতলগঞ্জ পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটার হবে উড়ালপথে। এ রুটে আবার স্টেশন হবে নয়টি। এগুলো হলো- নতুন বাজার, যমুনা ফিউচার পার্ক, বসুন্ধরা, পুলিশ অফিসার্স হাউজিং সোসাইটি, মাস্তুল, পূর্বাচল পশ্চিম, পূর্বাচল সেন্টার, পূর্বাচল পূর্ব, পূর্বাচল টার্মিনাল ও পিতলগঞ্জ ডিপো। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। এটি নির্মাণ হলে দৈনিক আট লাখ যাত্রী চলাচল করতে পারবে।
এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার রাজধানীর এলিফ্যান্ট রোডে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের সভা কক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির এমডি এমএএন সিদ্দিক। তিনি বলেন, ২ ফেব্রæয়ারি পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্প এলাকায় প্রধানমন্ত্রী এই কাজের উদ্বোধন করবেন। এ উপলক্ষে রূপগঞ্জ জমতা উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন রাজউকের কমার্শিয়াল প্লট মাঠে সভা হবে। রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জ মৌজায় ৮৮ দশমিক ৭১ একর ভ‚মিতে ডিপো হবে। এখাতে ব্যয় হবে ৬০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বিমানবন্দর রুট ও পূর্বাচল রুটে চলাচলকারী সব মেট্রো ট্রেন এই ডিপোর সুবিধা ব্যবহার করতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, পিতলগঞ্জে মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণ হবে। এর মধ্য দিয়ে পাতাল রেলের নির্মাণ কাজ শুরু হবে। এমআরটি-১ প্রকল্প দুটি অংশে বাস্তবায়িত হবে। একটি অংশ হবে পাতাল ও অপরটি হবে উড়াল। দুটি অংশের মূল ডিপো নির্মাণের কাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি সই হয়েছে।
৩১ দশমিক ২৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে মেট্রোরেলটি বাস্তবায়নে খরচ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর সিংহভাগই অর্থাৎ ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দিচ্ছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। দেশের যোগাযোগ অবকাঠামো খাতে টাকার অংকে এটিই হতে যাচ্ছে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। লাইনটি অবশ্য দুটি অংশে বিভক্ত। একটি অংশ বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত, যাকে বলা হবে বিমানবন্দর রুট। দ্বিতীয় অংশ নতুন বাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো, যার নাম হবে পূর্বাচল রুট।
বিমানবন্দর রুটের মোট দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৮৭২ কিলোমিটার। আর এ রুটেই দেশের প্রথম পাতাল বা আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল নির্মাণ হতে যাচ্ছে। মোট পাতাল স্টেশন হবে ১২টি। সেগুলো হলো বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুন বাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল পূর্ব, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ ও কমলাপুর। অন্যদিকে পূর্বাচল রুটের মোট দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৩৬৯ কিলোমিটার। এর পুরোটাই হবে উড়াল এবং স্টেশন সংখ্যা ৯। যদিও নর্দ্দা ও নতুন বাজার স্টেশন দুটি বিমানবন্দর রুটের অংশ হিসেবে হবে পাতালে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রফেসর ড. শামছুল হক বলেন, আমাদের বিজ্ঞান ভিত্তিক উন্নয়ন পরিকল্পনা করতে হবে। যানজট নিয়ন্ত্রণে রাজউকসহ অন্যদের নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা করা উচিত। পাতাল রেল পরিবহন ব্যবস্থার পুর্ণঙ্গ রূপ না। ঢাকায় গণপরিবহনে সমন্বয় আনতে হবে। পাতাল রেলে ব্যয় বেশি, আলো সমস্যাসহ নানা সমস্যা থাকে। ঢাকার যানজট থেকে মুক্তির জন্য সাবওয়ে বা পাতালরেল হলো খন্ডিত উন্নয়ন। এককভাবে শুধু পাতাল রেল হলেই যানজট নিরসন হবে না। এই শহরের যানজট মুক্ত করতে হলে গণপরিবহন, সিগন্যালসহ সামগ্রিকভাবে উন্নয়ন করতে হবে। তবে এগুলো যেন বৃত্তাকার রেলপথ, মেট্রোরেলসহ অন্য প্রকল্পের সঙ্গে সাংঘর্ষিক না হয়, সেদিকে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন