শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ধর্ম দর্শন

আয়েশা রা: এর সাথে বাল্যবিয়ে নিয়ে নবী স: কে কটূক্তি

অধ্যক্ষ মোঃ ইয়াছিন মজুমদার | প্রকাশের সময় : ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩, ১২:০০ এএম

সময়ের সাথে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বদলায়। একসময় সমাজে যা প্রচলিত ও স্বীকৃত ছিল পরবর্তীতে তা সমাজে নিষিদ্ধ হয়েছে এমন উদাহরণ অনেক। মাত্র কিছু দিন আগে ও আমাদের দেশে বাল্য বিয়ে প্রচলিত ছিল। আমাকে দিয়েই উদাহরণ শুরু করছি - আমার মা খালারা চার বোন। বড় খালার সাত বছর বয়সে, মেঝো খালার দশ বছর বয়সে, আমার আম্মার তেরো বছর বয়সে, ছোট খালার চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ে হয়। সকলে সাত আট সন্তানের জননী। মেঝো খালা ও আমার আম্মা এখনো জীবিত আছেন। আমাদের সাহিত্যে ও এ বিষয়টি সমাদৃত হয়ে ফুটে উঠেছে। কবি জসিম উদ্দিনের বিখ্যাত কবর কবিতার ছন্দ, " ঐখানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে, তিরিশ বছর ভিজিয়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে। এতটুকু তারে ঘরে এনেছিনু সোনার মত মুখ,পুতুলের বিয়ে ভেঙে যেতো বলে কাদিয়া ভাসাইতো বুক।" রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত হৈমন্তী গল্পে সহজ সরল পুত্র বধুকে প্রতিবেশীরা বয়স জিজ্ঞেস করলে সে আঠার বছর বললে শাশুড়ির কাছে তিরস্কৃত হতে হয় এবং আইবুড়ো বলা হয়। তৎসময়ে কোন বুদ্ধিজীবি এ কবিতা বা গল্পে পুতুল খেলার বয়সে বিয়ে করার কথা কবিতায় লিখায় জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে বা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিরুদ্ধে বাল্য বিয়ে উস্কে দেয়ার অভিযোগ তুলেনি , অথচ সাহিত্য মানব জীবনের দর্পণ। এবার ঐ সমসাময়িক কালের বা দু এক শতাব্দী আগে পিছের দু চারজন বিখ্যাত ব্যক্তির বিয়ের সময় কনের বয়স কত ছিল তা তুলে ধরছি - ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আট বছর বয়সী বালিকাকে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এগার বছর বয়সী বালিকাকে, বঙ্কিমচন্দ্র মাত্র পাঁচ বছর বয়সের বালিকাকে, জোতিন্দ্রনাথ ঠাকুর আট বছরের বালিকাকে, সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর সাত বছরের বালিকাকে বিয়ে করেন। যতটুকু জানি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স যখন তের বছর তখন তিন বছর বয়সের রেণু বেগম (ডাক নাম) এর সাথে বিয়ে হয় এবং বেগম মুজিবের বয়স যখন বারো বছর তখন তাদের ফুলশয্যা হয়। এতো এ উপমহাদেশের অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে মাত্র কয়েকটি। উন্নত বিশ্বের তৎকালীন অবস্থা একটু দেখুন - পর্তুগালের রাজা ভেনিস বারো বছর বয়সী সেন্ট এলিজাবেথকে, নরওয়ের ষষ্ঠ রাজা হাকোন দশ বছর বয়সী মার্গারেটকে , ইতালির রোমানোস চার বছর বয়সী বার্থা ইউডোকিয়াকে বিয়ে করেন। এবার দৃষ্টি দেই চৌদ্দশ বছর আগের সমাজের অবস্থার দিকে। তখন নারীদের নিরাপত্তা বলতে তেমন কিছু ছিল না। চোর ডাকাতেরা নারী শিশুকে চুরি ডাকাতি করে নিয়ে গিয়ে দাসি হিসেবে বিক্রি করে দিত, ধর্ষণ করতো। অকারণে শক্তিশালী গোত্র যুদ্ধ বাঁধিয়ে দুর্বল ও পরাজিত গোত্রের নারীদের দাসি করে রাখতো, ধর্ষণ করতো, বিক্রি করে দিতো। তাদের কোন অধিকার ছিল না। অনেক পিতা এ অবস্থায় নিরাপত্তাহীনতার কারণে ও সম্মান রক্ষা করতে কন্যাদের জীবন্ত কবর দিত। অবস্থার আলোকে যত দ্রুত সম্ভব বিয়ে দিয়ে স্বামীর গোত্র ও নিজেদের গোত্র মিলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে চেষ্টা করতো। ঐ সমাজে তখন নবী সঃ হজরত আয়েশা রাঃ কে ছয় বছর বয়সে বিয়ে করে এবং নয় বছর বয়সে ঘরে তোলেন বলে কোন কোন বর্ণনায় দেখা যায়, আবার বুখারী ও মুসলিমের বর্ণনা মতে আয়েশা রাঃ বদর ও উহুদ যুদ্ধে (সেবিকা হিসাবে) গিয়েছিলেন। নবী সঃ অপ্রাপ্তবয়ষ্কদের যুদ্ধক্ষেত্রে নিতেন না। আবার বুখারির বর্ণনামতে সূরা ক্বমর নাজিলের সময় আয়েশা রাঃ তরুনী ছিলেন, সূরা ক্বমর হিজরতের ০৮ বছর আগে নাজিল হয় সে হিসাবে বিয়ের সময় আয়েশা রাঃ বিয়ের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছরের মধ্যে এই ভাবে অনেক বিশুদ্ধ বর্ণনা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় নবী সঃ আয়েশা রাঃ কে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর বিয়ে করেন। চৌদ্দশ বছর আগের এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে যারা নবী সঃ বাল্য বিয়ে করেছেন বলে তার নিন্দা করে, কুৎসা রচনা করে, নবী সঃ কে অপমান করে তারা কি কখনো বর্তমান থেকে মাত্র কয়েক শতাব্দীর বিখ্যাত ব্যক্তি যারা বাল্য বিয়ে করেছিল তাদের বিষয়ে কখনো কি সামান্য আলোচনা ও করেছিল? না, তা করেনি। তাহলে তাদের উদ্দেশ্য কি তা স্পষ্ট। তাদের উদ্দেশ্য ইসলামের নবী মোহাম্মদ সঃ এর বিরুদ্ধাচরণ করে মিথ্যা কথা ছড়িয়ে ইসলামের ব্যপারে মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি করা। কারণ ইসলামের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বিশ্বে প্রতিদিন অনেক মানুষ ইসলাম গ্রহণ করছে। ইসলাম অন্যন্য অনেক ধর্মের মতো কোন আচার অনুষ্ঠান সর্বস্ব ধর্ম নয়। ইসলাম একটি পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা। ইসলাম একটি বিপ্লবের নাম, যে বিপ্লবের মাধ্যমে নবী সঃ এনেছিলেন বিরাট পরিবর্তন। এ পরিবর্তনের ফলে এখনো অনেকের স্বার্থে আঘাত লাগে। সংক্ষেপে সে পরিবর্তনের দু' একটি দিক তুলে ধরছি - যারা নারীকে বিবাহ ছাড়া, কোন দায়িত্ব গ্রহণ ছাড়া ভোগের বস্তু হিসেবে ব্যবহার করতে চায়,ভোগ শেষে বা বয়স বেড়ে গেলে ছুড়ে ফেলে দেয়। ইসলামের নবী তার এ অবস্থার বিরুদ্ধে বৈবাহিক জীবন যাপন ও দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা করেছেন। ভোগ বিলাসিদের গা জ্বালা করা তাতো অস্বাভাবিক নয়। মানুষকে ক্রীতদাস বানিয়ে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে যারা চায়, নবী সঃ ক্রীতদাসের অধিকার সংরক্ষণ আইন করে এবং কিছু সিষ্টেম করে ক্রীতদাস প্রথা শেষ করতে যে ভুমিকা রাখেন তাতে তাদের গাত্রদাহ অস্বাভাবিক নয়। তাদের সমাজে ও কিছু বিবেকবান লোক যারা ক্রীতদাস প্রথা অপছন্দ করতো তাদের প্রতি ও তারা অসন্তুষ্ট হয়,এমনকি নবী সঃ এর অনেক পরে এসে ও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ক্রীতদাস প্রথার বিরুদ্ধে বললে তারা তাকে গুলি করে হত্যা করে।পুঁজিপতিরা সম্পদের পাহাড় গড়ে নিজেরা বিত্তশালী থেকে বাকি সকল মানুষকে নিঃস্ব করে রাখতে চায়। মোহাম্মদ সঃ যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনীর সম্পদে গরিবের একটি অংশ নির্ধারণ করে দিয়ে ধনী দরিদ্রের বৈষম্য কমিয়ে আনায় পুঁজিপতিদের বিরুপতার শিকার হবেন এটা অস্বাভাবিক নয়। ইহুদিদের সুদের শোষণ থেকে মানবজাতিকে রক্ষা করতে তিনি সুদকে সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করেন।মদ নিষিদ্ধ করে মদ ও নারী নিয়ে ফুর্তিকারীদের জন্য বাঁধা হয়ে দাঁড়ান।জুয়া বন্ধ ঘোষণা করে জুয়াড়িদের গাত্রদাহের কারণ হন।মানুষ হয়ে মানুষের পুজা করার ও মানুষের সেবাদাসে পরিণত হওয়ার বিরুদ্ধে তিনি অবস্থান নেন। কোন কোন ধর্মগুরু নিজেরা মানুষকে পাপ মুক্ত করে স্বর্গে নেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে দুনিয়াবি সুবিধা ভোগ করেন। কিন্তু নবী সঃ পরকালীণ মুক্তির জন্য মানুষের নিজেদের সৎকর্মকে প্রাধান্য দেন,সুতরাং সুবিধাভোগীরা বিরুপ হবে এটা অস্বাভাবিক নয়। ধনী গরিব কালো সাদা উচ্চ বংশ নিম্ন বংশ সকলের অধিকার সমান ঘোষণা দিয়ে উচু জাত নিচু জাত, নিজেদেরকে কৌলিণ অন্যদেরকে অচ্ছুত গণ্যকারীদের বিরুপতার শিকার হবেন এটা স্বাভাবিক। এভাবে মানবতার ধর্ম ইসলামের বিরুদ্ধে অমানবতাকামীরা, নবী সঃ এর বিপ্লব ও ইসলামী আইন কানুন যাদের স্বার্থে আঘাত লেগেছে তারা ইসলাম ও ইসলামের নবী মোহাম্মদ সঃ এর বিরুদ্ধাচরণ সুযোগ পেলেই করতে চেষ্টা করেছে। তিনি জাহেলী যুগে ঐ সমাজে আল আমিন বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত ছিলেন, সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষায় তারা মোহাম্মদ সঃ কে বিশ্বস্ত ব্যাংক হিসাবে তাদের সম্পদ আমানত রাখতো। তিনি যখন সত্য প্রচার করা শুরু করেন,শোষণ মুক্ত সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন সমাজপতিদের স্বার্থে আঘাত লাগে স্বার্থপর সমাজপতিরা তাকে পাগল কবি বলতে দেরি করেনি। নর্তকী গায়িকা ভাড়া করে সমাজপতিরা তার অবমাননা ও নিন্দা শুরু করে। কিন্তু সত্যাগ্রহী সাধারণ মানুষ তার আহ্বানে সাড়া দিতে থাকে এক পর্যায়ে তার বিপ্লব সফল হয়, নিন্দাকারীরা ব্যর্থ হয়। মহানবী সঃ এর নিন্দাকারীদের শাস্তি যদি যে মুসলমান হয় মৃত্যু দন্ড, যদিও সে তওবা করে। তার তওবা পরকালে কাজে আসতে পারে দুনিয়ায় তার শাস্তি রহিত হবে না। যদি কোন অমুসলিম নবী সঃ এর নিন্দাকরে তার শাস্তি মৃত্যু দন্ড তবে যদি সে এর পর ইসলাম গ্রহন করে মৃত্যু দন্ড রহিত হবে। সত্য সন্ধানী বিবেকবান অন্য ধর্মের অনেক মানুষ ও নবী মোহাম্মদ সঃ এর আদর্শ ও তার চরিত্রের প্রশংসা করছে যেমন মাইকেল এইচ হার্ট তার দ্যা হানড্রেড নামক বইতে বিশ্বের একশত মনিষির জীবনী পর্যালোচনায় নবী মোহাম্মদ সঃ কে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ঘোষণা করেছে তবে মাঝে কিছু কুলাঙ্গার নবী সঃ এর বিরুদ্ধে কুৎসা রচনা করতে চেষ্টা করে। কৃষ্ণ প্রসাদ প্রতাব নামে এক লেখক ছমুপতি ছদ্মনামে রঙ্গিলা রাসুল নামে একটি বই লিখে, রাজাপাল নামে এক প্রকাশক তা প্রকাশ করে। মুসলমানরা ব্যাপক প্রতিবাদ করে। ইলমুদ্দীন নামে ১৯ বছরের এক যুবক যে তার পিতার সাথে দোকানে কাঠ মিস্ত্রির কাজ করতো, সে এক রুপি দিয়ে একটি ছোরা কিনে তা প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে প্রকাশক রাজাপালের লাইব্রেরিতে ঢুকে তাকে হত্যা করে। ইংরেজ আদালতে বিচারে ইলমুদ্দীনের ফাঁসি হয়। যা হোক নিন্দুকেরা নিন্দার চেষ্টা করলে ও কোটি কোটি মুসলমান নবী মোহাম্মদ সঃ কে তাদের জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসে। প্রতিদিন বিশ্বের শত শত মসজিদের মিনারায় মাইকে স্বগৌরবে উচ্চারিত হয় নবী মোহাম্মদ সঃ এর নাম। তার আদর্শ যুগ যুগ ধরে শ্রেষ্ঠত্বের আসনে আসীন থাকবে।


লেখকঃ অধ্যক্ষ, ফুলগাঁও ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা,লাকসাম , কুমিল্ল­া

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন