আলহাজ মাওলানা এরফান শাহ্ : বাল্যবিবাহ নিয়ে আমাদের দেশে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। বিশেষ করে নারী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এত বেশি সোচ্চার, দরদী ও উৎসাহী যা সন্দেহযুক্ত, রহস্যাবৃত ও রীতিমত বিরক্তিকর। পিতা-মাতা সন্তানের জন্মদাতা এবং সমস্ত দায়দায়িত্ব বহনকারী ও অভিভাবক । প্রবাদ আছে ঘুমিয়ে আছে শিশুর পিতা সব শিশুদের অন্তরে। যেখানে মা-বাবা নিজ প্রাণের চেয়ে সন্তানকে বেশি ভালবাসেন, সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে সদা-সর্বদা ব্যতিব্যস্ত, চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন থাকেন, সেখানে নারীবাদী ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো কোন অধিকারে সন্তানের বিষয়ে সম্মানিত পিতা-মাতাকে হয়রানি, অসম্মান ও আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চান? তাদের মায়াকান্না, অনাধিকার চর্চা ও অযাচিত হস্তক্ষেপ ভাল চোখে দেখে না সন্তানের পিতা-মাতা, অবিভাবক ও জনগণ। কথায় বলে মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি! নারীবাদীদের অতি উৎসাহী কর্মকা- দেখে আমরা পিতা-মাতারা মনে মনে হাসি।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহপাক বলেনঃ তোমরা সৎকাজ ও খোদাভীতিতে পরস্পর সহযোগিতা করো। সরকার ছেলেমেয়েদের বিয়ের বয়স যথাক্রমে একুশ ও আঠার নির্ধারণ করেছে। তবে মা-বাবা ইচ্ছা করলে প্রয়োজনে বিশেষ ব্যবস্থায় আগেও বিবাহ দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। মা-বাবার প্রতি এ সম্মান ও মর্যাদা তাদের পাওনা ও ন্যায্য অধিকার। যুগের চাহিদা, প্রয়োজনীয়তা ও বাস্তবতার নিরিখে সরকার একটি বাস্তবসম্মত, যথাযত ও যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এজন্য সরকারকে আন্তরিক অভিনন্দন, সাধুবাদ ও মোবারকবাদ জানাই। জন্ম, মৃত্যু ও বিয়ে মহান বিধাতার নিয়ন্ত্রিত মহিমা। কে, কখন, কোথায় জন্ম গ্রহণ করবে? কখন, কোথায়, কীভাবে মৃত্যু বরণ করবে? কখন বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছবে তা কারো ইচ্ছাধীন নয়। এটি একমাত্র বিধাতার বিধান, তার নিয়ন্ত্রাধীন ও ইচ্ছাধীন। অতএব যে বিষয়টি মানুষের নিয়ন্ত্রাধীন নয় তা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা কতটুকু যুক্তিযুক্ত ও বাস্তবসম্মত? কেউ কি তার জন্ম ও মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করতে পারবে? আল্লাহপাক জন্মের আগেই মৃত্যু নির্ধারণ করে রেখেছেন। জন্মের আগেই রিজিক নির্ধারণ করে রেখেছেন। জন্মের আগেই তার সঙ্গিনী নির্ধারণ করে রেখেছেন। এগুলো মহান রব ও সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি ও রহস্য। এ তিনটি বিষয় মানুষের ইখতিয়ার বহির্ভূত। এ গুলো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা মানে বিধাতার বিধানকে চ্যলেঞ্জ করা এবং বাস্তবতাকে অস্বীকার করা।
বিয়ের উপযুক্ত বয়স কোনটি? বয়ঃসন্ধিতে উপনীত হওয়ার পর একজন বালক ও বালিকা যখন শারীরিক আকাক্সক্ষী হয়, তবে সে সময়টিই তার বিয়ের বয়স বা সময়। এ শুভক্ষণটি কারো জন্য ১৪ বছরে হতে পারে, কারো জন্য ১৬ বছরে, কারো জন্য ১৮ বছরে, কারো সারা জীবনে নাও আসতে পারে। আবার স্থান, কাল ও পরিবেশভেদে রয়েছে এর ভিন্নতা। এক কথায় শরীর ও মনের উপযুক্ততাই বিয়ের বয়সের মাপকাঠি। এজন্য ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে বিবাহ কখনো ফরজ, কখনো ওয়াজিব, কখনো সুন্নাত আবার কখনো হারাম তথা নিষিদ্ধ। অতএব, সোনা, রূপা ও লোহা এক পাল্লায় ওজন করা হবে হঠকারী সিদ্ধান্ত। বিয়ের সময় হয়েছে কী না, বিয়ের জন্য শরীর ও মন প্রস্তুত কী না তা সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারে ব্যক্তি নিজেই। তবে অভিভাবকদের সতর্কতা ও সচেতনতা জরুরি। আর সবচেয়ে বড় কথা অভিভাবকরা তো এ সময়টা পার করেই বুড়ো হয়েছেন। অতএব তাদের নতুন করে বিবাহের গল্প শোনানোর কোনো মানে নেই। এখানে পিতা-মাতা ও অভিভাবকের সততা, দায়বদ্ধতা ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে হাস্যকর, অতিরঞ্জন ও বাড়াবাড়ি।
কথায় বলে, ভদ্রতার দাম নেই। এ কথাটি রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি বিভিন্ন নীতিতে যেমন সত্য, তেমনি বিয়ে নীতিতেও ততধিক বেশি সত্য বলে মনে হয়। যতক্ষণ না ছেলের বিরুদ্ধে ইভটিজিং আর পাশের বাড়ির চালে ঢিল মারার অভিযোগ আসছে ততক্ষণ অনেক অভিভাবক বুঝতেই চান না ছেলের বিয়ের বয়স হয়েছে। এক কথায় অনেক অভিভাবকের কাছে ছেলের বিয়ের উপযুক্ততার প্রমাণ হলো ইভটিজিং। অপরদিকে ছেলেটি ভদ্রভাবে লেখাপড়া করছে, লেখাপড়া শেষে চাকুরী করছে, মাথায় টাক পড়ে যাচ্ছে, চুল পেকে যাচ্ছে, তবুও ছেলেটির বিয়ের বয়স হয়নি, কারণ সে অতি ভদ্র। অবশ্য এ ক্ষেত্রে মেয়েরা অনেকটা ভাগ্যবতী। অতীতকাল থেকেই মেয়েদের উপার্জনে বাবা-মা অভ্যস্ত নয় বলে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর যতদ্রুত পারেন মেয়েকে পার করার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইদানীং হঠাৎ করেই অভিভাবকরা অতি আধুনিক হয়ে উঠেছেন! মেয়ে লেখাপড়া শেষে আয়রোজগারী না হওয়া পর্যন্ত বিয়ের চিন্তা করাকে তারা সেকেলে মনে করেন। মনে রাখা দরকার অবিবাহিত ছেলেমেয়ে যদি অনৈতিক কর্মে লিপ্ত হয়, তখন তার দায়ভার কিন্তু পিতা-মাতার উপর বর্তায়। ছেলেমেয়েদের অবৈধ প্রেম-ভালবাসা, লিভটুগেদার ও সমকামিতার মতো অনৈতিকতা, ধ্বংস ও অভিশাপের হাত থেকে রক্ষা করতে বৈধভাবে জৈবিক চাহিদা পূরণের জন্যই মহান রাব্বুল আলামিন বিবাহের নির্দেশ দিয়েছেন। প্রাপ্তবয়স্ক ও সামর্থ্যবান হলে কালবিলম্ব না করে বিবাহ করা প্রত্যেক মুসলমানের ঈমানি দায়িত্ব। বিয়ে শুধু জৈবিক চাহিদাই নয়, বরং একটি মহান ইবাদতও বটে। বিবাহ মানুষের জীবনকে পরিশীলিত, মার্জিত এবং পবিত্র করে তোলে। ইসলাম একদিকে যেমন কৌমার্য দ্বারা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তিকে দমন করার পক্ষপাতী নয়, ঠিক তেমনি এটি লাগামহীন অবিবেচক যৌন জীবনকেও অনুমোদন করে না। রাসূল (সাঃ) বলেন, “হে যুবসমাজ, তোমাদের মধ্যে যারা বিবাহ করতে সক্ষম তারা যেন বিবাহ করে, কারণ এটি চোখকে আকর্ষণপূর্ণ দৃষ্টি থেকে দূরে রাখে এবং যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষা করে। আর যারা বিবাহের সামর্থ্য রাখে না তারা যেন রোজা রাখে। যাতে এটি ঢাল হিসেবে তাকে রক্ষা করতে পারে। বিবাহ সহজ ও জরুরি একটি বিষয়কে আমরা জটিল ও গুরুত্বহীন মনে করছি। বিয়ে মানে এ নয় যে, জাগতিক সকল কাজকর্ম বন্ধ করে সারাক্ষণ এর পিছনে ছুটতে হবে, বরং বিবাহিত পুরুষরা যেমন চাকুরী, ব্যবসা ও কাজকর্ম করে, অনুরূপভাবে ছাত্র-ছাত্রীরা বিয়ে করলে তারাও তেমনি তাদের পড়ালেখা চালিয়ে যাবে। আর শিক্ষাজীবন ধ্বংসের হাতিয়ার অনৈতিক প্রেম-ভালবাসা থেকে বিবাহিত ছাত্র-ছাত্রীরা মুক্ত থাকায় স্বাভাবিকভাবে শিক্ষাক্ষেত্রে তারা আরো বেশী উৎসাহিত ও মনোযোগী হবে। বিবাহের প্রয়োজনীয়তা, উপকারিতা ও বাধ্যবাধকতা অনস্বীকার্য। এখানে জন্মদাতা ও অভিভাবকের ভূমিকা, দায়িত্ব ও আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হবে হাস্যকর। মা-বাবার উপর মাতাব্বরী, নজরদারি ও কর্তৃত্ব খাটানো হবে দৃষ্টিকটু, অনাধিকার চর্চা ও বাড়াবাড়ি। বিবাহের মাধ্যমে ঈমানের পরিপূর্ণতা অর্জন হয়। ইভটিজিং, ধর্ষণ ও ব্যাভিচারের মতো বড় বড় পাপসমূহ এবং মরণব্যাধি এইডস, গনোরিয়া ও যৌনরোগ থেকে নিরাপদ থাকা যায়। মানসিকভাবে দেহ ও মন সুস্থ থাকে। চরিত্রের উন্নতি ঘটে, বংশ পরম্পরা অব্যাহত থাকে। সুখময় সমাজ ও আদর্শ পরিবার গঠন সম্ভব হয়। সর্বোপরি ইহকালীন ও পরকালীন কল্যাণ লাভ হয়। আল্লাহ তাআলা প্রত্যেককে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে বিবাহ করার মাধ্যমে সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের তাওফিক দান করুন। আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন