অব্যবস্থাপনার আরেক নাম ই-টিকিটিং : সরকারের বেঁধে দেয়া কিলোমিটারের বদলে যাত্রীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে : হয়রানি থামেনি বরং মনিটরিং না থাকায় গণপরিবহণ মালিক-শ্রমিকদের অভিনব প্রতারণায় পড়ছেন যাত্রীরা
রাজধানী ঢাকা ও আশপাশের জেলাগুলোতে চলাচল করা গণপরিবহণে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য থেকে যাত্রীদের মুক্তির বার্তা নিয়ে এসেছিল ই-টিকিটিং ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার ফলে কাউন্টারে একটি পোজ মেশিনের মাধ্যমে যাত্রীরা টিকিট কেটে গাড়িতে উঠছেন। ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় ৩০টি কোম্পানির ১ হাজার ৬৪৩টি বাসে ই-টিকিটিং চালু করা হয়। পরবর্তীতে আরো দুই দফায় মিলে বর্তমানে রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় ৯৭টি কোম্পানির আরো কিছু বাস ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করা হয়। বর্তমানে রাজধানী ঢাকায় ৫ হাজার ৬৫০টি বাস চলাচল করে। তবে ৩ হাজার ৩০৭টি বাস ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় চলছে। যাত্রীদের পটেক কাটা ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধে ই-টিকিটিং চালু হলেও ভাড়া আদায়ে নৈরাজ্য কমছে না। বরং ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় যাত্রীদের অতিরিক্ত ভাড়া দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। দূরত্ব অনুযায়ী ভাড়া আদায় করার কথা থাকলেও যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। মূলত পরিবহণ কন্টাক্টররা দূরত্ব অনুযায়ী ইচ্ছামতো ভাড়া আদায় করছেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ই-টিকিটিং এ সরকারের বেঁধে দেয়া কিলোমিটারের ভাড়া অনুযায়ী ভাড়া আদায় করার কথা। কিন্তু পরিবহণ মালিকরা দূরত্ব না মেপে শুধু এলাকা ভেদে ভাড়া আদায় করছে।
একটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষার্থী সোহান হোসেন গতকাল শুক্রবার ‘ট্রান্স সিলভা’ বাসে সায়েন্সল্যাব থেকে পল্টন পর্যন্ত ই-টিকিটিং এর মাধ্যমে যাতায়াত করেছেন ১০ টাকা ভাড়া দিয়ে। শিক্ষার্থী হওয়ায় অন্যদিন অর্ধেক ভাড়া ৫ টাকা দিয়ে এ রুটে যাতায়াত করার কথা। কিন্তু অন্যবাসে তাকে এই দূরত্বের ভাড়া ১৫ টাকা গুনতে হয়। তিনি বলেন, ই-টিকিটিং কার্যত যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা। আমাকে বেশি ভাড়া দিতেই হচ্ছে। অন্যান্য বাসে একই চিত্র। আগারগাঁও থেকে যাত্রাবাড়ী পর্যন্ত ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৩০ টাকা; আবার আগারগাঁও থেকে মতিঝিলের ভাড়াও ৩০ টাকা নেয়া হচ্ছে।
জানতে চাইলে সেভ দ্য রোডের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান মোমিন মেহেদী বলেন, শুধু ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালু করলেই হবে না। সেই সঙ্গে কঠোর মনিটরিং করা প্রয়োজন। শুধু নির্দিষ্টি ঘটনার সময় করলে গণপরিবহণের সুফল পাওয়া যাবে না। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, সড়কে ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় ফিরলে যাত্রীদের থেকে যে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়া হতো সেটা থাকার কথা নয়। এটি খুবই ভালো উদ্যোগ হলেও মনিটরিং করতে হবে।
গত কয়েকদিন অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, রাজধানীতে ই-টিকিটিংয়ে অব্যবস্থাপনায় চলছে গণপরিবহণ। কাগজে-কলমে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা থাকলেও বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। বাস্তবে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা মানছেন না বেশিরভাগ গণপরিবহণের চালক ও সহকারীরা। তারা আগের মতোই ভাড়া নিচ্ছেন। গলায় মেশিন ঝোলানো থাকলেও টিকিট ছাড়াই যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায় করা হয়। টিকিটের জন্য যাত্রীরা চাপ দিলে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করে পোজ মেশিনের সাহায্যে কম ভাড়ার টিকিট দেয়া হয়। এমন অভিযোগ করছেন সাধারণ যাত্রীরা।
ভাড়া আদায় নিয়ে যাত্রী ও বাসের হেলপার ও কর্মচারীদের সাথে বাগবিতÐা নিত্যদিনের ব্যাপার। কথা কাটাকাটি এক পর্যায়ে মারামারির মতো ঘটনা ঘটে। আর যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যাত্রী উঠানোর দৃশ্য নিত্যচিত্র হয়ে গেছে। ই-টিকিটিংয়ের নামে যাত্রী ঠকানোর নতুন ফাঁদ শুরু হয়েছে। তবে এই পদ্ধতি চালুর ফলে ভাড়া নৈরাজ্য এখনো থামছে না বলে মনে করছেন সাধারণ যাত্রীরা। তারা বলছেন, ই-টিকিটিংয়ের মাধ্যমে ভাড়া নৈরাজ্য থামছে না বরং বেশি ভাড়া আদায়ের একটি নতুন মাধ্যম হয়েছে এই ই-টিকিটিং সিস্টেম। এতে সাধারণ যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। যথাযথ নজরদারি না থাকলে এটি কাজে আসবে না বলেও জানান তারা। এছাড়াও ভাড়া আদায়ে মানা হচ্ছে না বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) নির্ধারিত তালিকা। ওয়েবিল প্রথা বাতিল করার কথা থাকলেও এখনো তা চলছে। এ কারণে যাত্রী ভাড়া বাড়ছে। কোনো কোনো এলাকায় ওয়েবিলের নামে চেকাররা গাড়ি থেকে টাকা আদায় করছেন। এতে রাস্তার মোড়ে মোড়ে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। ভোগান্তি বাড়ছে সাধারণ যাত্রীদের।
বাস মালিক সমিতির নেতারা বলছেন, অনেক চেষ্টার পরও অতিরিক্ত ভাড়া আদায় আমরা থামাতে পারিনি। যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের টাকা মালিকরা পান না। সেটা চালক-হেলপারের পকেটে ঢুকে যায়। এ জন্য ই-টিকিটং ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে সংগঠন কাজ করছে। ই-টিকিটিং ব্যবস্থা মজবুত হলে যেমন অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ হবে, তেমনি চুরিও বন্ধ হবে। যেখানে-সেখানে বাস দাঁড়াবে না। একই সঙ্গে বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতাও বন্ধ হবে।
ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় ৯৭টি কোম্পানির অধীনে ৫ হাজার ৬৫০টি বাস চলাচল করে বলে জানান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহণ মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ। তিনি বলেন, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে তারা গত বছরের ১৩ নভেম্বর প্রথম দফায় ৩০টি কোম্পানির ১ হাজার ৬৪৩টি বাসে ই-টিকিটিং চালু করেছিলেন। দ্বিতীয় দফায় চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ১১টি কোম্পানির ৭১৭টি বাসে এ ব্যবস্থা চালু করা হয়। তৃতীয় পর্বে ১৩টি পরিবহণ কোম্পানির ৯৪৭টি বাসে এ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দিলেন। ই-টিকিটিং পদ্ধতি কার্যকর করা অনেক কঠিন বলে দাবি করেন পরিবহণ মালিক সমিতির এই নেতা। তিনি বলেন, এটি বাস্তবায়ন করার জন্য সমিতির পক্ষ থেকে তারা অনেকগুলো দল রাস্তায় নামিয়েছেন। অনিয়ম বন্ধে ৯ জন স্পেশাল চেকার নিয়োগ দিয়েছেন। আরও ১০ জন নিয়োগ দেবেন। তবে ভাড়া নিয়ে অনিয়ম দূর করতে আরও সময় লাগবে।
এনায়েত উল্যাহ বলেন, এই কাজ তো শুরু করেছি যাত্রীদের সুবিধার জন্য, তারা যাতে ন্যায্য ভাড়া থেকে বঞ্চিত না হন। গেটলক ও সিটিং সার্ভিস বন্ধের মতো ই-টিকিটিংও একসময় কার্যকর হবে। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে কি না, আমরা কাজ করছি কি না, সেটা দেখার বিষয়। আমরা আরও ১০টা লোক নিয়োগ দিচ্ছি। নিজেরা মাঠে যাচ্ছি। আমরা তো বসে নেই। আমরা চাই যাত্রীরাও যেন টিকিট ছাড়া ভাড়া না দেন।
চালকের সহকারীরা ই-টিকিটিং পদ্ধতিতে ভাড়া কাটেন না। তারা বেশি ভাড়া আদায় করছেন। এ অভিযোগের বিষয়ে পরিবহণ মালিক সমিতির এই নেতা বলেন, এখানে আর্থিক বিষয় জড়িত। কাজেই এটা তো বুঝতে পারছেন। তাই তো চেকার বসিয়েছি।
তিনি বলেন, দূরত্ব অনুযায়ী কিলোমিটার উল্লেখ করে ভাড়ার চার্ট তৈরির কার্যক্রম চলছে। ভাড়ার চার্ট পেলে ডিভাইসে কিলোমিটার উল্লেখ করে দেবো। আগে চালু হওয়া ই-টিকিটিং ব্যবস্থা এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। এখনো ইচ্ছেমতো ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, তাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। যাত্রীরাও যেন টিকিট ছাড়া ভাড়া না দেন।
শিকড় পরিবহণে রাজধানীর আগারগাঁও থেকে টিকাটুলির ভাড়া নেয়া হয় ৩০ টাকা। কিন্তু আগারগাঁও থেকে যাত্রাবাড়ীর ভাড়াও ৩০ টাকা পাঁচ টাকা কম নিতে বললে শুরু হয় বাগবিতন্ডা। এমন পরিস্থিতিতে ৩০ টাকা দিয়েই টিকাটুলিতে নামতে হয় চাকরিজীবী নাজিমকে। নাজিম আরও বলেন, সারা রাস্তায় কোথাও পোজ মেশিনে ভাড়া আদায় করতে দেখিনি। আগের মতোই সবার কাছ থেকে টাকা নিচ্ছে। এরপর গুলিস্তান বঙ্গভবনের কাছে আসতেই ওয়েবিল দেখার জন্য থামানো হয় বাস। পূর্ব থেকে দাঁড়িয়ে থাকা লোক ওয়েবিল চেক করে বাস ছেড়ে দেয়। এতে করে রাস্তায় সব বাসের জটলা সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, রাজধানীর বাসগুলো এখন যেভাবে চলছে এই পরিস্থিতিতে ই-টিকিটিং ব্যবস্থা টিকবে না। চালকরা আয় করবেন আর মালিক বাস ইজারা (লিজ) দিয়ে সব টাকা নিয়ে নেবেন, এমনটা শ্রমিকরা হতে দেবেন না। এ জন্য পরিবহণ শ্রমিকদের আগে মাসিক বেতনের আওতায় আনতে হবে। বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ফর্মুলা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে সড়ক ও বাস ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরবে। তখনই ই-টিকিটিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, আমাদের কাছেও অভিযোগ আছে, কোনো কোনো রুটে আগের ওয়েবিলের মতোই বাড়তি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে ই-টিকিটিংয়ে। প্রতিটি টিকিটে টিকিট প্রদানকারী বাসের নাম, বাসের নিবন্ধন নাম্বার, যাত্রা ও গন্তব্যের নাম, দূরত্ব, ভাড়ার অঙ্ক, ভ্রমণ তারিখ ও অভিযোগ কেন্দ্রের নাম্বারগুলো থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে প্রদত্ত ই-টিকিটিং ব্যবস্থায় এসব পূর্ণাঙ্গ তথ্য নেই। কোন কোন টিকিটে শুধু ভাড়ার অঙ্ক লেখা রয়েছে। যাত্রা ও গন্তব্যের নাম, বাসের নাম ও নম্বর নেই, ফলে এসব টিকিট দিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হলে যাত্রীদের প্রতিকার পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন