ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক : সারা বিশ্বে অস্থিরতা, হানাহানি, কাটাকাটি চলছেই। এটা কখনও কম, কখনও বেশি। মানুষের স্বভাবের বৈশিষ্ট্য এটা। মানুষ সৃষ্টির পূর্বে আল্লাহকে ফেরেশতারা বলেছিলেন, “আপনি কি সেখানে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন যে অশান্তি ঘটাবে ও রক্তপাত করবে?” (কোরআন, ২ সূরা, ৩০ আয়াত)। শুধু মানুষে মানুষে রক্তপাত নয়, মুসলমান মুসলমানেও রক্তপাত ঘটবে।
আধুনিক যুগে এসে একটা বড় অঘটন হলো খ্রিস্ট শাসকদের সাহায্যে মুসলিম বিশ্বে কৃত্রিম ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠা। এ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে হাগানাহ ও ইরগুন নামের দুই ইহুদি সন্ত্রাসী সংগঠনের সন্ত্রাসের মাধ্যমে, অথচ যখন সারা ইউরোপে খ্রিস্টানরা ইহুদিদের ওপর চরম নির্যাতন চালাচ্ছিল তখন মুসলমানরা নির্যাতিত ইহুদিদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়েছিল। এটা হয়েছিল উত্তর আফ্রিকা তথা স্পেন-পর্তুগালে মুসলিম শাসনে এবং পরবর্তীতে ওসমানী তুর্কি আমলে। অথচ এই মেহমান ইহুদিরা এখন আরবদের ও তুকিীদের ওপর অনৈতিক আক্রমণ চালাচ্ছে। এদিকে ইসরাইল ও পাশ্চাত্য ফিলিস্তিনিদের মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বেশ কিছু চুক্তি স্বাক্ষর করে এখন ইসরাইল ও ফিলিস্তিন দুই রাষ্ট্রনীতি থেকে সরে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নব-নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তো জেরুজালেমকে ইসরাইলি রাজধানী হিসেবে নির্বাচনকালীন ঘোষণা দিয়েছেন। এমনকি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাস তেলআবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিতে ওয়াদা করেছেন। ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণভাবে লোপাট
করতে ইসরাইল ও তার ধাত্রীরা দৃঢ় পণ করেছে। তাহলে সন্ত্রাস কীভাবে উবে যাবে। আর ফিলিস্তিনিদের মুক্তিযুদ্ধকে কীভাবে সন্ত্রাস বলা যাবে? এটা তো মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা যুদ্ধ।
যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানে মুসলমানরা আতঙ্কিত। তার আবার শরীরে জার্মানরক্ত। জার্মানি আবার শুধু হিটলারের দুর্গ ছিল না, মধ্যযুগের বেশিরভাগ ক্রুসেডার ছিল ফ্রাঙ্ক জাতির, যারা মূলত জার্মান। লক্ষণ দেখে বোঝা যাচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নব্য নেতার হাতে মুসলিম বিশ্বের জন্য আরও বড় দুর্দিন আসছে। ফিলিস্তিনবাসীর জন্যও। অবশ্য সব মার্কিন সরকার ইসরাইল তোষণ নীতি নিয়ে চলে ইহুদিদের অর্থ ও মিডিয়ার দৌরাত্ম্যে। মার্কিন মানবতাবাদী ইহুদি বুদ্ধিজীবী প্রফেসর নোয়াম চমস্কি এক সাক্ষাৎকারে ইন্ডিয়ার ফ্রন্টলাইন পত্রিকাকে বলেন, ইসরাইলের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র এবং দেশটি অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তিতে (এনপিটি) স্বাক্ষর দিতে অস্বীকার করেছে। ...মধ্যপ্রাচ্যে একটি পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত এলাকা গড়ে তুলতে পারার মধ্যেই রয়েছে ইরান কারো জন্য হুমকি কি-না সেই প্রশ্নের সহজ সরল উত্তর। আর এই মহান কাজটি বারবার যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতায় বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তার ক্লায়েন্ট ইসরাইলকে রক্ষা করতে গিয়ে।
চমস্কি আরও বলেন, পনের বছর আগে মার্কিন সরকার সমর্থক প্রভাবশালী জার্নাল ফরেন অ্যাফেয়ার্সে বিখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক স্যামুয়েল হান্টিংটন সতর্ক করে বলেছিলেন, বিশ্বের বেশির ভাগ অংশের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ‘একটি দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রে পরিণত হতে যাচ্ছে।’ বাকি বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রকে একক বৃহত্তম বাহ্যিক হুমকি বলে বিবেচনা করবে। কিছু দিনের মধ্যে তার সাথে সুর মেলান আমেরিকান পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট রবার্ট জার্ভিস। তার মতে, বিশ্বের বেশির ভাগ দেশের দৃষ্টিতে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র হলো প্রধান দুর্বৃত্ত রাষ্ট্র। বিশ্বব্যাপী জনমতের এই মতামতের প্রতি সমর্থন দেখা গেছে। পশ্চিমা বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় জরিপ সংস্থা উহন গলআপ-এর জরিপে দেখা যায়, বিশ্বের শান্তির প্রতি সবচেয়ে বড় হুমকি হলো যুক্তরাষ্ট্র। চমস্কির মূল্যায়নে আমরা প্রমাণ যোগ করতে পারি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক মিসরে গণতন্ত্র হত্যা, আর তুরস্কে গণতন্ত্র হত্যায় মাওলনা গুলেনকে দিয়ে কু করার প্রচেষ্টায়।
এদিকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সিরিয়ার আলেপ্পো শহরে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের হুমকি দেন গত বছর (২০১৫)-এর ডিসেম্বরের মাঝে। তিনি রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, রুশ ডুবোজাহাজের নতুন ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থায় পারমাণবিক অস্ত্র যুক্ত করা হতে পারে। মুসলমানরা যেন সবার প্রহার করার বউ বিশেষ। এদিকে শেষ পর্যন্ত পুতিনেরই জয় হলো আলেপ্পোতে। এর জন্য দায়ী সুন্নির আরব রাষ্ট্রগুলো ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য। যে কারণে যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্য সোভিয়েত ইউনিয়নকে আফগানিস্তানে সহ্য করেনি। সেই একই কারণে রাশিয়া পাশ্চাত্যকে সিরিয়াতে সহ্য করেনি। সিরিয়ার শিয়া আসাদ সরকারের পেছনে রয়েছে ইরানসহ সমগ্র শিয়া বিশ্ব ও সিরিয়া ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র রাশিয়া। এ জন্য সবচেয়ে ভালো হতো আলোচনার মাধ্যমে সিরীয় সুন্নিদের অধিকারের গ্যারান্টি প্রতিষ্ঠা করে আসাদ সরকারকে মেনে নেওয়া। সুন্নি আরব তথা পাশ্চাত্য এই ইস্যুতে পররাষ্ট্র ও সামরিক নীতিতে মার খেল। মুসলমান মুসলমানে হানাহানি বাড়ল।
পাশ্চাত্যের কালো চেহারাটা কানাডাতে সম্প্রতি সাদা হয়েছে অক্টোবর ২০১৫ কনজারভেটিভ পার্টির নয় বছরের শাসনের অবসানে ও লিবারেল পার্টির জাস্টিন ট্রুডোর বিজয়ে। কনজারভেটিভ পার্টি ইসরাইলের পক্ষে একতরফা নীতি নেয়, নিকাব-হিজাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। জাস্টিন ট্রুডোকে বিজয়ের পর দেখা গেল হিজাব পরা মহিলাদের সাথে সেলফি তুলতে, হিন্দুদের সঙ্গে নাচতে এবং মুসলিমদের সঙ্গে খেতে। শিখদের ভাষা পাঞ্জাবি এখন কানাডার পার্লামেন্টে তৃতীয় ভাষা ইংরেজি ও ফ্রেন্সের পরে। ৩৩৮ সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টে ১৯ জন ইন্ডিয়ান কানাডীয় নির্বাচিত হয়েছেন, যাদের বেশির ভাগ শিখ। ট্রুডোর ২৮ সদস্যের মন্ত্রিসভায় কমপক্ষে ১১ ভাষাভাষী মন্ত্রী রয়েছেন, যারা বলেন ইংরেজি, ফরাসি, ফার্সি, দারি (আফগানিস্তানের প্রধান ভাষা), আরবি, পাঞ্জাবি, হিন্দি, ইউক্রেনিয়ান, পোলিশ ও ইতালীয়। ইন্ডিয়ার অধিকৃত কাশ্মীর ও মিয়ানমারের আরাকান রাখাইনে মুসলিম দলন চলছে। এ ছাড়া মুসলমানদের পারসনাল তথা তালাকের আইনে বিজেপি সরকার হাত দিতে চায়। এ নিয়ে মুসলিম প্রতিক্রিয়া নেগেটিড। মিয়ানমারের বৌদ্ধরা ও সরকার মুসলমান বিতাড়নে যে ন্যাক্কারজনক সন্ত্রাস করছে তা বৌদ্ধ সমাজের জন্য কলঙ্ক ও ধর্মে কালো দাগবিশেষ। গৌতম বুদ্ধ জীবিত হয়ে ফিরে এলে তিনি এ অবস্থা দেখে হতবাক হতেন। মুসলমানরা সেই সাহাবাদের আমল থেকে আরাকানে বাস করছে। কীভাবে তাদেরকে বৌদ্ধ সরকার বিতাড়িত করতে পারে?
বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া সম্পর্ক সীমান্ত ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছুটা ভালো হলেও বাংলাদেশ দিয়েছেই বেশি। অথচ পানির অভাবে নদী শুকে যাচ্ছে। ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাড়াহুড়ো করে সব ধরনের ট্রানজিট প্রদান পরবর্তীতে পররাষ্ট্রীয়, প্রতিরক্ষা, আইনশৃঙ্খলা ও অন্যান্য প্রকারের জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। এ ব্যাপারে ধাপে ধাপে, ধীরে ধীরে এগোনো কৌশলিক দিক দিয়ে বিবেচিত হওয়া উচিত। চুক্তি সই করে ফিরে আসা কঠিনতর হবে। এখন তো বঙ্গবন্ধু নেই যে সাত দফা দেশবিরোধী চুক্তি বাতিলের মতো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে। ট্রানজিট বন্দর সংক্রান্ত চুক্তিগুলো দ্বিপাক্ষিক বা উপ-আঞ্চলিকভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে, সার্কের মাধ্যমে বহুপাক্ষিক হতে পারলে ছোট রাষ্ট্রগুলোর লেভারেজ বৃদ্ধি পেত। সম্পর্ক যত উন্নতই হোক সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি। ইন্ডিয়াতে রপ্তানি আশানুরূপ বৃদ্ধি পায়নি।
জার্মানির ড. সিগফ্রিড ও উলফ (আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দক্ষিণ এশীয় ইনস্টিটিউটের (গবেষক) মন্তব্য করেছেন যে, বিএনপি ও ইসলামী দলগুলোর ঝোঁক রয়েছে ইসলামী চরমপন্থার প্রতি। ফলে দেশে বহুত্ববাদী ও উদার মূল্যবোধ ও ভাবধারা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ছে। উল্লেখ্য, জার্মানি হিটলারের দেশ এবং প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ। সেখানে রয়েছে খ্রিস্টান ডেমোক্রেটিক পার্টি। জার্মানি কর্তৃক ইহুদি গণহত্যা বিশ্বরেকর্ড। তারা পোল্যান্ডে অসিটজ ও বুরেকিনুতে গ্যাস চ্যাম্বার বসিয়েছিল যা আমার স্ত্রী ও আমি দেখে এসেছি। জার্মানরা ছিল অন্যতম ক্রুসেডার। (ইউরোপের ত্রিশ বর্ষব্যাপী ক্যাথলিক প্রটেনটান্ট যুদ্ধ ক্ষেত্রে দেশের অর্ধেক মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়)- এর মূল কেন্দ্র ছিল জার্মানি। জার্মানির উচিত নিজের কুৎসিত চেহারাই পরিষ্কার করা। আর এক জার্মান যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এসে মুসলিম দলনের নীলনকশা আঁকছেন। সামনের দিনগুলোতে অস্থিরতা বৃদ্ধির সমূহসম্ভাবনা পাশ্চাত্য ও তাদের মিত্রদের অবিবেচনাপ্রসূত নীতির কারণে। এমনি তারা তাদের ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেন নীতির কারণে সন্ত্রাসবাদকে বিশ্বময় ছড়িয়ে দিয়েছে। মুসলিম বিশ্বে সন্ত্রাস পশ্চিমা আমদানি। বাংলাদেশে ফিলিস্তিনি চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ইউসুফ এস রামাদান জাতীয় প্রেসক্লাবে বলেন, “জোর দিয়ে বলতে চাই, বাংলাদেশের সন্ত্রাসী কা-ের মূলে রয়েছে ইসরাইল ও তার দোসররা, যারা শান্তিপ্রিয় মানুষের জন্য ত্রাস ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি করে।”
লেখক : ইতিহাসবিদ, গবেষক ও কলাম লেখক
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন