শামীম চৌধুরী : সমুদ্রের ঢেউয়ের উপর সার্ফিং কসরত দেখতে ফেডারেশনের আমন্ত্রণ রক্ষা না করে পারিনি। কক্সবাজারে জাতীয় সার্ফিংয়ে অংশ নিয়েছে এক দল ক্ষুদে সার্ফার। দিনে সার্ফিং বোটে রোমহর্ষক প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠা সেই সব ক্ষুদে সার্ফাররা রাতে সমুদ্র সৈকতের বিপণি কেন্দ্রে করেছে ভিড়। সেখানকার টং এর দোকানের সামনেও ফেরিওয়ালা, রিক্সাওয়ালাদের ভিড়। কিছুক্ষণ পর পর তাদের চিৎকার শুনে কৌতূহলী পর্যটকরাও সমুদ্র বিলাস থেকে নজর ঘুরিয়েছেন টিভি পর্দায়! কারণটা আর কিছুই নয়, মুস্তাফিজ। সানরাইজার্স হায়দারাবাদ খেলছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লীগে (আইপিএল), তার ঢেউটা এসে পড়েছে কক্সবাজারে। কক্সবাজার শুধু নয়, আইপিএল চলাকালে এ দৃশ্য ছিল দেশজুড়ে! ভাবুন তো! মুস্তাফিজুর রান আপ মার্কে, দিচ্ছেন দৌড়, সেই দিকেই চোখ পুরো বাংলাদেশের। সানরাইজার্স হায়দারাবাদের খেলার সূচিটাও যেন মুখস্থ সবার। বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকগুলোতে আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দারাবাদ পেয়েছে বিশেষ জায়গা, তা মুস্তাফিজুরের পাঠকপ্রিয়তার কারণেই। বাংলা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় কথা বলতে পারেন না, ভাব বিনিময়ে অভিব্যক্তিই যার সম্বলÑ সেই মুস্তাফিজের সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলতে টুকটাক বাংলা শিখতে হয়েছে ডেভিড ওয়ার্নার, ট্রেন্ট বোল্টদের! নিলামে ১ কোটি ৪০ লাখ রুপিতে সানরাইজার্স হায়দারাবাদে বিক্রি হয়ে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছেন মুস্তাফিজ আইপিএলের প্রাক আলোচনায়। অবিশ্বাস্য ইয়র্কার ডেলিভারিতে আন্দ্রে রাসেলকে ভূপাতিত করার দৃশ্যটা মুস্তাফিজুরকে রহস্য বোলারের খেতাব দিয়েছে। আইপিএলে মাঝারিমানের বাজেটে, মিডিওকার দল গড়ে যে দলটি সেরা চারে থাকতে পারলেই হতো সন্তুষ্টু সেই সানরাইজার্স হায়দারাবাদ আইপিএলে প্রথম শিরোপার স্বাদ পেয়েছে। ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যাটিং, ভুবনেশ্বরের বোলিংকে যতটা কৃতিত্ব দেয়া হয়েছে তাদের উপরে রাখতে হয়েছে মুস্তাফিজুরের ১৭টি উইকেটকে! আইপিএল সেরা উদীয়মানের পুরস্কার জিতে আইপিএল সেরা একাদশে মুস্তাফিজুরের নামটিও বাংলাদেশের জন্য কম গর্বের নয়। ভারতের ঘরোয়া আসরে করেছেন মুস্তাফিজুর পারফর্ম তা এত বেশি আলোড়ন তুলেছে যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের দেয়ালে পর্যন্ত ঠাঁই পেয়েছে সে ছবি!
২০১৫ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবির্ভাবে বছরজুড়ে ছিলেন এই বাঁ হাতি কাটার মাস্টার আলোচনায়। মাত্র ৯ ম্যাচে ২৬ উইকেটে আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলে জায়গা পাওয়া মুস্তাফিজুর সে বছর বাংলাদেশ থেকে শুগল সার্চে ছিলেন সবার উপরে। ২০১৬ সালেও বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে এই ক্রীড়াবিদ। বছরের শুরুতে এশিয়া কাপ টি-২০তে পাকিস্তান, শ্রীলংকাকে হারিয়ে বাংলাদেশের রানার্স আপে সাব্বিরের পাশে আলোচনায় মুস্তাফিজুরের নাম। ইনজুরি থেকে পুরোপুরি সেরে ওঠার আগে হাফ ফিট মুস্তাফিজুর প্রত্যাবর্তনেও ছড়িয়েছেন দ্যুতি! অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-২০ বিশ্বকাপে প্রত্যাবর্তন ম্যাচে বিস্ময় ডেলিভারিতে স্টিভেন স্মিথ, মিচেল মার্শকে যাদুকরী ডেলিভারি দেখে মুস্তাফিজুরকে ‘গড গিফটেড’ বলতে দ্বিধা করেননি ভারতের অভিজ্ঞ পেস বোলার আশিষ নেহরা। পরের ম্যাচে সেই বেঙ্গালুরুতে কাটার ভেল্কিতে প্রাণ দিয়েছেন রোহিত শর্মা, রবীন্দ্র জাদেজা! কোলকাতার ইডেন গার্ডেনসে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে কাঁটার যাদুর ঝাঁপিটা একটু বেশিই খুলেছিলেন মুস্তাফিজুর। তাতেই বাজিমাৎ। ৪-০-২২-৫ এ ২০১৬ টি-২০ বিশ্বকাপের সেরা বোলিং ফিগারের রেকর্ডেও বাংলাদেশকে এনেছেন আলোচনায়। মাত্র ৩ ম্যাচে ৯ উইকেটÑ তাতে টি-২০ বিশ্বকাপ সেরা একাদশে মুস্তাফিজুরকে না রেখে উপায় ছিল না আইসিসির।
আইপিএল হিরো ফিরেছেন ঢাকায় বীরবেশে। সাতক্ষীরার এই বীরকে বরণে হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পড়েছে গণ্যমান্যদের ভিড়। বীর বরণে ছুটে গেছেন ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী এবং বিসিবির শীর্ষস্থানীয়রা। বিমানবন্দরে তার অবতরণও সংবাদকর্মীদের আগ্রহের কেন্দ্রে। সেখান থেকে রাতে মামার বাসায় ছুটে যাওয়া, সকালে বিসিবি একাডেমি ভবনে ফিটনেস পরীক্ষা, সেখান থেকে সাতক্ষীরায় মায়ের কোলে চলে যাওয়ার খবরও গণমাধ্যমে বিশেষ জায়গা পেয়েছে বরাদ্দ। ইলিশ ভাজি, গরুর ভুনা গোশত, গাছে ঝুলে থাকা পাকা আমের স্বাদ নিতে ব্যাকুল হয়ে উঠেছেন মুস্তাফিজুরÑ বিদেশী গণমাধ্যমে পর্যন্ত হয়েছে মুখরোচক এমন নিউজ!
ইংলিশ কাউন্টি দল সাসেক্স নাছোড়বান্দা। মুস্তাফিজুরকে অন্তত একটি ম্যাচের জন্য হলেও চাই-ই-চাই। বিসিবিতে মেইলের পর মেইল করে, মে থেকে প্রতীক্ষা করতে করতে জুলাইয়ে মুস্তাফিজুরকে পেয়ে সে কি খুশি কাউন্টি ক্লাবটি! লন্ডন থেকে সড়কপথে সাসেক্সে যাত্রা, সংক্ষিপ্ত আনুষ্ঠানিকতায় মুস্তাফিজুরের জার্সি মিডিয়ার সামনে হাজিরেও ছিল কৌতূহল। বিশ্রামহীন ম্যাচে নেমে পড়ে কাউন্টির অভিষেকে ৪ উইকেটও কম কিসের? এই সাসেক্সে খেলতে পাঠানোর সিদ্ধান্তটাই হয়েছে বুমেরাং। ম্যাচে নামার আগে অনুশীলনের সময়ে বাঁ কাঁধে সেই যে পেলেন চোট, যে চোট ছিটকে ফেলেছে কাটার মাস্টারকে। মুখোমুখি হতে হয়েছে অস্ত্রোপচারের। লন্ডনের বুপা ক্রমওয়েল হাসপাতালে তার ভর্তি, অপারেশনকে ঘিরেও মিডিয়ার কৌতূহলের কমতি ছিল না। যে ছেলেটি শরীরে সুঁই ফোড়ানোকে পান ভয়Ñ সেই ছেলেটি অপারেশনের সময় না জানি কতটা ভয় পায়? এই ভয় কাটিয়ে সাহসের সঙ্গে অপারেশন টেবিলে যেন যেতে পারে ছেলেটি তার জন্য ঢাকা থেকে ছুটে গেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টেলিফোনে কথা বলে মায়ের ভূমিকায় হয়েছেন অবতীর্ণ। দিয়েছেন ছেলেটিকে সাহস।
কাঁধের টেলিস্কোপ সার্জারিতে ৫ মাস ছিলেন মাঠের বাইরে। এই সময়েও মুস্তাফিজুর ছিলেন আলোচনায়। পুনর্বাসন ক্যাম্প ঠিকঠাক মতো চলছে তো, মুস্তাফিজ বল গ্রিপ করতে কি পেরেছেন, ক’স্টেপে নিচ্ছেন রান আপ, সামর্থ্যরে কতটা পারছেন দিতেÑ পাঠক, দর্শক, সমর্থক, ভক্তদের এসব কৌতূহল মেটাতে হয়েছে মিডিয়াকে! যে ছেলেটি বছরের প্রথম ৫ মাস আলোচনার কেন্দ্রে, ক্রিকেটের বাইরে থেকেও আলোচনায় যিনি, তিনি প্রাপ্য স্বীকৃতি পেয়েছেন আইসিসির তরফ থেকে। ২০১৫ সালে আইসিসির বর্ষসেরা ক্যাটাগরিতে সেরা উদীয়মানে তাকে ভূষিত না করে বড় অন্যায় করা হয়েছে, সেই অপরাধবোধে ২০১৬ সালে আইসিসির বর্ষসেরা উদীয়মান ক্রিকেটারের পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে প্রথম কোন ক্রিকেটার হিসেবে আইসিসির সেরার স্বীকৃতি পেলেন মুস্তাফিজুর। বাংলাদেশ থেকে গুগল মার্চে ২০১৬-এর চতুর্থ সেরা মুস্তাফিজুরে বাংলাদেশের ক্রিকেট উঠলো আর ধাপ উপরে।
বছরটিতে আলো ছড়িয়েছেন তরুণ অফ স্পিনার মেহেদী হাসান মিরাজ দু’বার। বছরে শুরুতে আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো সেমিফাইনালে তোলার নায়ক মিরাজ অলরাউন্ড পারফরমেন্সে (২৪২ রান ও ১২ উইকেট) পেয়েছেন আসর সেরা ক্রিকেটারের পুরস্কার। আইসিসির কোন আসরে এটাই বাংলাদেশের কোন ক্রিকেটারের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। বছরের শেষ টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশের বর্ষসেরা উদীয়মানের পারফরমেন্সে। টেস্ট অভিষেকে ২ ম্যাচের সিরিজে ১৯ উইকেটে বিশ্বরেকর্ড, অভিষেক টেস্ট সিরিজে সিরিজ সেরার পুরস্কারেও মেহেদী রাঙা উৎসবে রঙিন হয়েছে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন। এমন সফল বছরে টি-২০ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরিতেও আলো ছড়িয়েছেন তামিম ইকবাল। দক্ষিণ এশিয় গেমসে নারী সাতারু শিলার ২টি স্বর্ণপদক জয় কিংবা নারী ভারোত্তলক সীমান্তর স্বর্ণ জয়, পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীতের সঙ্গে অঝোরে কান্নাও ছিল আলোচনায়। আলোচনায় ছিল কৃঞ্চা সানজিদাদের এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবলের সাফল্যগাথা। তবে সব আলোচনা ছাপিয়ে বছরে আলোচিত ক্রীড়াবিদ মুস্তাফিজ।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন