শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিজরী

ইংরেজি নববর্ষ সংখ্যা

বছরটি সবার জন্য উপভোগ্য হোক

| প্রকাশের সময় : ১ জানুয়ারি, ২০১৭, ১২:০০ এএম

আবদুল আউয়াল ঠাকুর : কে কখন কবে আমাদের মধ্যে কিছু দিন-তারিখ ঠিক করে দিয়েছে এবং বলে দিয়েছে এভাবে একটা কিছু করতে হবে আমরা এখনো সেভাবেই ক্রমাগত নেচে যাচ্ছি। হতে পারে এক ধরনের আনন্দবোধও এর মধ্যে রয়েছে। নববর্ষ পালনের চেতনায় ভিন্নতা রয়েছে। স্বাধীন দেশের মানুষ দিবসটি উদযাপন করে নতুন প্রেরণালাভের আশায়। পরাধীন দেশের মানুষ পালন করে মুক্তির প্রতীক্ষায়। কারাগারের আসামিরা পালন করে একটু ভালো খাবারের প্রত্যাশায়। সবমিলে একটি দিবস পালনের মধ্যে মনের কিছু সুপ্ত গুপ্ত বাসনা থাকে। সে যে বাসনাই হোক আমরা প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে যে ইংরেজি নববর্ষ পালন করি তাতে দেখা যায় একদল লোক অপেক্ষায় থাকে উচ্ছৃঙ্খলতার আশায়। আরেক দল হয়তো মনে মনে ভাবে অন্তত একদিন ছুটি পাওয়া গেল এটাই কম কিসে? একটা প্রথামাফিক অনুষ্ঠান ছাড়া আর কিছুই নয়। নানা কারণে প্রত্যাশা প্রাপ্তির যোগ-বিয়োগ এখন আর হয় না। কোথাও না কোথাও একটা গোঁজামিল দিয়ে আমরা একটি বর্ষশেষ করি আবার আরেকটিতে পা রাখি। অবশ্য আমরা চাই বা না চাই এটাই স্বাভাবিক নিয়ম।
প্রাচীন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে পরিবর্তিত রূপই হচ্ছে ইংরেজি নববর্ষ। যিশু খ্রিস্ট অর্থাৎ খ্রিস্টান সম্প্রদায় যাকে তাদের ধর্মের প্রবর্তক বলে মনে করেন মুসলমানদের কাছে তিনি একজন নবী হযরত ঈসা (আ.)। তার জন্মের বছরকে ধরেই সৌর হিসাব পরিচালনা করে পূর্ব ও পরবর্তী সাল গননা করা হয়। বর্তমান বিশ্বে ব্রিটিশ উপনিবেশ-উত্তর বাস্তবতাতেও ইংরেজি সাল বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচিত। জাতিসংঘের গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকতার কারণে ইংরেজি সাল সারা বিশ্বে নয়া মাত্রিকতা দান করেছে। প্রতিটি নববর্ষই সংশ্লিষ্ট জাতিগোষ্ঠীর কাছে আলাদা গুরুত্ব বহন করে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নয় এবং ব্যাপক প্রচলন না থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর বহু আদিবাসী তাদের নিজস্ব দিনপঞ্জির প্রথম দিনটি নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে পালন করে থাকে। সঙ্গতভাবেই এ কথা বলা চলে, নববর্ষের দিনটি উদযাপনের মধ্য দিয়ে প্রকৃত ওই জাতির সাংস্কৃতিক চেতনারই প্রতিফলন ঘটে। নববর্ষ মূলত উদযাপনের মতোই একটি দিন। এ নিয়ে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে নানা ধরনের সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে উঠেছে। ইংরেজি নববর্ষ পালনের পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাথে প্রাচ্যে বিশেষ করে মুসলিম সংস্কৃতির সুনির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে। আনন্দের প্রতীক হিসেবে দিনটিকে উদযাপন করতে গিয়ে কোনো কোনো মহলে অন্যান্য অনুষ্ঠানের মধ্যে সীমাহীন মদ্যপানের সংস্কৃতিও যুক্ত হয়ে আছে। ব্রিটেনসহ অন্য দেশগুলোতে ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ৩১ ডিসেম্বর পরবর্তী প্রথম প্রহর থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়গুলো যাতে মদ্যপায়ীদের জন্য নির্বিঘœ থাকে তার সরকারি ব্যবস্থাপনা রয়েছে। অনুরূপভাবেই সাজানো হয় ট্রাফিক সিস্টেম। পাশ্চাত্যে মদ গ্রহণের বা পানের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে সামঞ্জস্য রেখেই উদযাপনের বিধানাবলী সাজানো হয়। মুসলিম রীতিতে মদ নিষিদ্ধ সুতরাং ইংরেজি নববর্ষ পালনে আলোচিত মদ্যপ সংস্কৃতি নিয়ে আমাদের সামাজিক বৈরিতা লক্ষ্যণীয়। আমাদের দেশেও পাশ্চাত্যের অনুকরণে ইংরেজি নববর্ষ পালনের এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে। সে কারণেই নববর্ষের আগের দিন থেকে জনস্বার্থে নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়। রাস্তার গতিপথ ঘোরাতে হয়, বিশেষ বিশেষ এলাকায় তল্লাশি চালানো হয়। কথিত অভিজাত এলাকার নাইটক্লাবগুলোর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হয়। কারণ যারা মদ্যপ ও ব্যভিচারী সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত অথবা আসক্ত তারা যাতে শান্তিপ্রিয় নাগরিকদের জন্য অন্তরায় না হতে পারে। তা সত্ত্বেও সব কিছু নিয়ন্ত্রণে থাকে এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই। বাস্তবতা হলো বছর কয়েক আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বাধন নামে এক মেয়ের যে বাজে অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়েছিল তার কথা এখনও ভুলে যাবার কোনো কারণ নেই। বাধনের ওপর যারা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল প্রকৃত অর্থে তাদের কোনো বিচার হয়নি। এ কথাও সত্যি, সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পূর্ব সতর্কতা অস্বীকার করে এড়িয়ে অথবা অবজ্ঞা করে যেসব তরুণ-তরুণী এবং বিশেষ শ্রেণি মধ্যরাতের চেতনায় বেরিয়ে পড়ে তাদের উন্মত্ততাকে নিয়ন্ত্রণ করা কার্যতই কঠিন। সামাজিক প্রতিপত্তি সুতার টান অথবা প্রভাব বলয়ের কারণেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাছে কার্যত অসহায় হয়ে পড়ে। প্রকৃত চিত্র হচ্ছে, এই  প্রবণতার সাথে যারা যুক্ত তারা সমাজের ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্রাংশেরই প্রতিনিধিত্ব করে। তা সত্ত্বেও এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতায় এরাই ‘বিশেষ’ অভিজাত শ্রেণি বলে স্বীকৃতি পেয়েছে। প্রকাশ্যে যাই বলা হোক না কেন, এদের স্পর্শ করা সহজ নয়। এর সাথে আন্তর্জাতিক বিশেষ সম্পর্কের  সূত্রও এড়িয়ে যাওয়া যাবে না।
সংস্কৃতিকে জীবন থেকে আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। প্রতিটি মানুষের মেধা মননে যে ধরনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে ব্যক্তিগত জীবনাচারেও এর প্রভাব থাকবে এটাই স্বাভাবিক। আমাদের সমাজে সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চার পথ কার্যত উন্মুক্ত নেই। সমাজে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চার কেন্দ্রগুলো মূলত সরকারি রোষের শিকার। সাংবিধানিকভাবে আল্লাহর ওপর গভীর আস্থা ও বিশ্বাস তুলে দেবার ফলে যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে সামগ্রিকভাবে তা সুস্থ সংস্কৃতি চর্চার বিপরীতে অবস্থান করছে। ধর্মীয় সংস্কৃতির বাইরেও আরেক প্রকার সুস্থ সাংস্কৃতিক চর্চা রয়েছে, তবে সে ক্ষেত্রেও বর্তমানে নানা অন্তরায় বিদ্যমান। সংস্কৃতি চর্চার সাথে মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির যে প্রসঙ্গ রয়েছে তার সাথে জাতীয় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের নিরবচ্ছিন্ন সম্পর্ক রয়েছে। পাশ্চাত্যে যে ধরনের সংস্কৃতি চালু রয়েছে সেগুলো রাষ্ট্রীয় আচারের অংশভুক্ত। আমাদের মতো দেশে কার্যত সংস্কৃতির কোনো সর্বসম্মত রূপরেখা নেই। পাশ্চাত্য দুনিয়া তাদের সংস্কৃতি চর্চার সাথে ধর্মীয় বিশ্বাসকে সমন্বিত করে নিয়েছে। তাদের এই বিশ্বাসজনিত সংস্কৃতিতে মূলত ভোগবাদী সংস্কৃতির সংক্রমণ চলছে। অধিকার কতটা স্বীকৃত এবং কতটা নয়, ভোগের সীমা কত এবং কতটা নয় এ ধারণায় প্রকৃত জবাবদিহিমূলক দর্শনের সাথে ভোগবাদ দর্শনের ভিন্নতা রয়েছে। একটি বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ে তুলতে যে আন্দোলন এবং লড়াই চলছে তার অন্তরায় হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে ভোগবাদ সংস্কৃতি। সীমা না মানার প্রবণতা কার্যতই পৃথিবীর সমস্ত জনগণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলছে। ধর্মকে তারা তাদের মতো করে সাজিয়ে নিয়েছে। খ্রিস্টানরা তাদের বিশ্বাসে তৃতত্ত্ব¡বাদী। আবার বহু দেব-দেবিতে যারা বিশ্বাস করে তারাও বহুত্ববাদী। একাত্ববাদ ও বহুত্ববাদের যে সংঘর্ষ তার প্রভাব ইংরেজি নববর্ষ পালনে দেশে দেশে পরিলক্ষিত হয়।
ভারত বর্ষ থেকে মুঘল শাসন ছিনতাই হওয়ার ফলে কৃষক বিপন্ন হলো। কৃষকের এই বিপন্নতার সুযোগ গ্রহণ করে ভূমির ওপর নতুন যে শ্রেণির অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো তারা ছিল মূলত ঐতিহ্য বিচ্যুত। এই নতুন শ্রেণির জন্ম দেয়ার মধ্য দিয়ে ইংরেজরা তাদের অনুবর্তী সংস্কৃতির বীজ বপন করেছিল। এই নতুন শ্রেণি জন্মসূত্রে ভারতীয় হলেও তাদের চিন্তা-মেধা-মননে পাশ্চাত্য সংস্কৃতি ইনজেক্ট করে দেয়া হয়েছিল। ফলে ভারতীয় প্রাচীন সংস্কৃতির সাথে সাংঘর্ষিকতা অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। এই নব্য সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে মুসলমানদের রুখে দিতে। মুসলমানদের জন্য মদ নিষিদ্ধ অথচ রাষ্ট্রীয়ভাবে মদ পানকে বৈধতা দানের মধ্য দিয়ে যে সংস্কৃতির সমর্থন করা হয়েছিল আজকের বাস্তবতায় তা গোটা সমাজকে গ্রাস করছে। এখন শুধু মদ নয়, মাদকও যুক্ত হয়েছে। সুবিধাভোগী ও উচ্চ শ্রেণি মিলেমিশে এমন এক মদ্যপ বাস্তবতা তৈরির প্রবণতার মধ্যে যুক্ত রয়েছে, যার নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর প্রাণান্ত অপচেষ্টা হয় ইংরেজি নববর্ষে।  
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন রাজনৈতিক আগ্রাসনের চেয়েও বিপজ্জনক। রাজনৈতিক আগ্রাসন মোকাবেলা সম্ভব। মোটিভেশন ছাড়া সাংস্কৃতিক আগ্রাসন মোকাবেলার অন্য কোনো অস্ত্র নেই। ইংরেজি নবর্বষ উদযাপনের যে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রবণতা তার সাথে শিক্ষা নীতির সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বোধ বিশ্বাস একাত্মবাদী হলেও আমাদের শিক্ষা কার্যক্রমে এই প্রবণতা যথাযথভাবে অনুসৃত হচ্ছে না বিধায় সংস্কৃতি চর্চাতেও তার বিরূপ প্রভাব লক্ষণীয়। এই আলোচনা অর্থ এই নয় যে, ইংরেজি ভাষা বা ওই ভাষার জনগোষ্ঠী যে ধরনের চর্চা করেন তাদের নিয়ে কোনো বিরূপতার বহিঃপ্রকাশ। শুধু এটুকু বলা যে, বর্ষবরণের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য সাংস্কৃতিক রীতি প্রাচ্যেও অন্ধ অনুসরণ-অনুকরণ করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। এক সময় মুসলমানরা যখন পৃথিবী শাসন করেছে তখন ইংরেজ বা অন্য ভাষাভাষী ও ধর্মীয় গোষ্ঠীর নাগরিকরা মুসলমানদের কাছ থেকে শিক্ষার আলো গ্রহণ করেছে। নিজেদের শিক্ষিত করেছে। আজকের দুনিয়াতে পাশ্চাত্য জগৎকে কোনো কোনো বিষয়ে অগ্রগামী বলে বিবেচনা করা হয়। পরস্পর পরস্পরকে জানাশোনার জানালা মূলত সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের মাধ্যমেই হয়ে থাকে। আর সে কারণেই গ্রহণ-বর্জনের বিষয়টি মাত্রার মধ্য থেকেই সম্পন্ন করতে হয়।
এবার ইংরেজি নববর্ষ যখন শুরু হচ্ছে তখন জাতীয় জীবনে ভিন্ন বাস্তবতা বিরাজ করছে। একটি জাতীয় নির্বাচনের আলোচনা তুঙ্গে উঠেছে। এ নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষ যাই থাকুক নির্বাচনের সময় যখনই হোক নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য করা যায় কীভাবে সে আলোচনাই এখন সর্বমহলে। আনন্দ তো সাংস্কৃতিক উৎসবের অংশ। একে উপভোগ করতে মনের যে অবস্থা প্রয়োজন তার জন্যই সুস্থ রাজনৈতিক বাস্তবতা অপরিহার্য। বছরের শুরুতে তাই প্রত্যাশাÑ বছরটি যেন সকলের জন্য উপভোগ্য হতে পারে সে ব্যাপারে সকলেই যতœবান হবেন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন