শামসুল হক শারেক : লবণ বাংলাদেশের একটি স্বনির্ভর খাত। দেশের দক্ষিণপূর্ব অঞ্চল কক্সবাজার জেলা ও চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালীতেই শুধু লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে। নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত সময় লবণ উৎপাদনের মৌসুম। প্রতিবছর এই সময়ের মধ্যে চাষিরা হাঁড়ভাঙা পরিশ্রম করে লাখ লাখ মে.টন লবণ উৎপাদন করে দেশকে লবণে স্বনির্ভর করে তোলে। লবণ সংশ্লিষ্টদের মতে দেশের উৎপাদিত লবণ বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব হলেও নীতিমালার অভাবে তা হচ্ছে। স্বতন্ত্র লবণ নীতিমালা না থাকার কারণে দেশের অন্যতম স্বনির্ভর লবণ খাতটি এখন হুমকির মুখে পড়েছে।
নানাভাবে খাদ্যজাত পণ্যে লবণের ব্যবহার আদিকাল থেকে হয়ে আসলেও আধুনিককালে পশু খাদ্যসহ বিভিন্ন ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রেডাক্টে লবণের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। এতে করে লবণের চাহিদাও বেড়েছে বহুগুণ। তাই লবণ উৎপাদনে আগের সেই সেকেলে পদ্ধতির পরিবর্তে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। অতীতে মাঠের কাদা লবণ ইন্ডাস্ট্রিতে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাওয়ার উপযোগী করা হত। এখন পলিথিন প্রযুক্তির মাধ্যমে মাঠেই উৎপাদিত হচ্ছে খাওয়ার উপযোগী ধবধবে সাদা লবণ।
অতীতে বৃটিশ আমলে বাড়ির আঙ্গিনায় বড় চুলা বানিয়ে সাগরের লবণাক্ত পানি সিদ্ধ করে লবণ তৈরি করা হত। পাকিস্তান আমলে সূর্যের তাপে মাঠে লবণ তৈরির চাষ শুরু হয়। এই প্রক্রিয়ায় লবণ চাষিদের অধিক শ্রমের ফল পাওয়া যেত কম। সম্প্রতি লবণ চাষে নতুন প্রযুক্তি পলিথিন পদ্ধতি যুক্ত হওয়ায় বাংলাদেশে লবণ উৎপাদনে বিপ্লব সাধন হয়। কিন্তু কেন যেন এই স্বনির্ভর লবণ খাতটি ক্রমান্বয়ে অবহেলার শিকার হচ্ছে। কমে যাচ্ছে লবণ চাষের জমি, চাষিরা হারাচ্ছে লবণ চাষে আগ্রহ। মহেশখালীর মাতারবাড়ি ও ধলঘাটায় ইতোমধ্যেই লবণ জমির বিশাল অংশ কয়লা বিদ্যুতের প্রকল্পের জন্য অধিগ্রহণ হয়ে গেছে। মহেশখালীর অন্যান্য এলাকাতেও অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
লবণ হচ্ছে একটি বিকল্পহীন পণ্য। দেশের রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে দীনমজুর পর্যন্ত লবণের স্বাদ গ্রহণ করে থাকেন। লবণ উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাতকরণের সাথে প্রত্যক্ষভাবে ৫লাখ এবং পরোক্ষভাবে ২৫ লাখ মানুষ জড়িত।
লবণ মৌসুম শুরু হয়েছে নভেম্বর থেকেই। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত মৌসুমের দেড় মাস চলে গেলেও ৬৩ হাজার একর জমির সিকি পরিমাণ জমিতেও চাষিরা নামতে পারেনি। ৬৩ হাজার একর লবণ জমিতে ৪০ হাজার চাষি লবণ উৎপাদনে নামার কথা থাকলেও নানা কারণে চাষিরা এখনো উৎপাদনে যেতে পারছে না। কক্সবাজার সদর, মহেশখালী ও টেকনাফের লবণ চাষ এলাকা সরে জমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, মোট লবণ জমির সিকি পরিমাণ জমিতেও এখনো লবণ চাষ শুরু হয়নি। তাই লবণ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন চলতি মৌসুমে লবণের ঘাটতির লক্ষণ মৌসুমের শুরুতেই দেখা যাচ্ছে।
মহেশখালীর ধলঘাট-মাতারবাড়িতে কয়লা বিদ্যুতের জন্য অধিকাংশ জমি অধিগ্রহণ করে নেয়ায় সেখানে লবণ চাষের কোন পরিবেশ নেই। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে বেড়িবাঁধ না থাকায় লবণ চাষ বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজার সদরের পোকখালী, চৌফলদ-ী এলাকার বিস্তীর্ণ লবণ জমি এখনো পড়ে রয়েছে। কিছু কিছু জমিতে চাষিরা মাঠ তৈরি করছে মাত্র। সেখানে এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় কয়েকজন লবণচাষিসহ স্থানীয় অধিবাসী কক্সবাজার সদরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান এড. সলিমুল্লাহ বাহাদুরের সাথে। তিনি জানান পোকখালী, গোমাতলী ও চৌফলদ-ীসহ কক্সবাজার সদরের বিস্তীর্ণ এলাকায় লবণচাষ পিছিয়ে যাওয়ার কারণ। গত বর্ষায় ওই এলাকার পশ্চিম দিকের বেড়িবাঁধের বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গেছে। ওইসব ভাঙা দিয়ে এখনো জোয়ারের পানি ঢুকে লবণ চাষের জমি তলিয়ে যায়। এতে করে ওই এলাকার বিস্তীর্ণ জমিতে লবণ চাষ পিছিয়ে গেছে। এছাড়াও গেল বছর লবণের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় এবছর লবণ জমির লাগিয়ত বাড়িয়ে দিয়েছে ভূমি মালিকরা। এই কারণে চড়া মূল্য দিয়ে জমি নিয়ে চাষিরা সাহস করে লবণ চাষে নামতে পারছে না।
টেকনাফের লবণ চাষি তারেক রশীদ জানান, বেড়িবাঁধ না থাকায় টেকনাফবাসীর ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ধান চাষ, লবণ চাষ তো দূরের কথা সেখানকার মানুষের ভিটে বাড়ি রক্ষা করাও দায় হয়ে পড়েছে।
মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধলঘাটায় কয়লা বিদ্যুতের জন্য জমি অধিগ্রহণ করায় লবণ জমি কমে গেছে বলেও জানা গেছে। একইভাবে কালারমারছড়া ও হোয়ানকে লবণ জমি অধিগ্রহণে প্রক্রিয়াধীন থাকায় সেখানেও লবণ চাষ ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়াও ওই এলাকায় সন্ত্রাসীরা অনেক লবণ জমি জবর দখল করে নেয়ার কারণেও লবণ চাষের জমি কমে গেছে বলে জানান, কালারমারছড়া ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আলহাজ্ব রূহুল কাদের বাবুল।
কক্সবাজার বিসিকের প্রকল্প পরিচালক আবছার উদ্দিন এ প্রসঙ্গে বলেন, ৬৩ হাজার একর লবণ চাষের জমির এক তৃতীয়াংশ জমি চাষের আওতায় না আসার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। কুতুবদিয়া এবং বাঁশখালীতে লবণ উৎপাদন শুরু হয়েছে। গত সপ্তাহে (ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়) সেখানে ২হাজার ৫৫০ মে.টন লবণ উৎপাদন হয়েছে। যেখানে বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি ঢুকছে যেমন কক্সবাজার সদরের পোকখালী, গোমাতলী ও চৌফলদ-ীতে এবং টেকনাফে শাহপরীর দ্বীপে এবং সাব্রাং এ লবণ চাষ পিছিয়ে গেছে। এছাড়াও যেখানে চিংড়ি চাষ হয়ে থাকে সেখানেও কিছু কিছু এলাকায় লবণ চাষ পিছিয়ে যাচ্ছে। মহেশখালীর মাতারবাড়ী ও ধলঘাটায় কয়লা বিদ্যুতের জন্য জমি অধিগ্রহণ করায় লবণ জমি কমে গেছে বলেও তিনি জানান। একইভাবে কালারমারছড়া ও হোয়ানকে লবণ জমি অধিগ্রহণে প্রক্রিয়াধীন থাকায় সেখানেও লবণ চাষ ব্যাহত হচ্ছে।
তবে গত বছর ১৫ লাখ ৫৫ হাজার মে.টন লবণ উৎপাদন হলেও চলতি মৌসুমে ১৫ লাখ ৫৫ হাজার মে.টন চাহিদার অনুকূলে ১৮ লাখ ৭৬ হাজার মে.টন লবণ উৎপাদনের টার্গেট নিয়ে বিসিক লবণ চাষিদের সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে বলেও আবছার উদ্দিন জানান।
বিসিক প্রকল্প পরিচালক আরো বলেন, ভারতের সাথে আমাদের লবণ উৎপাদনে কিছুটা তারতম্য রয়েছে। যেমন ভারতে লবণ উৎপাদনের সব জমিই সরকারি খাস জমি। ব্যক্তি মালিকানার কোন জমি নেই। সেখানে ডেনসিটি বা পানির ঘনত্ব বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি। তাই প্রতি একর জমিতে আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি লবণ উৎপাদন হয়ে থাকে সেখানে। সেখানে লবণ উৎপাদনে অনবরত ৬ মাস মৌসুম পাওয়া যায়।
আমাদের এখানে বলতে গেলে লবণ এলাকার সব জমিই ব্যক্তি মালিকানাধীন। ডেনসিটি বা পানির ঘনত্ব বাংলাদেশে ভারতের চেয়ে অনেক কম। এখানে লবণ উৎপাদনের মৌসুম ৬ মাস বলা হলেও আসলে ৩ মাসের বেশি পাওয়া যায় না। ঝড় বৃষ্টিতে লবণ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। এসব কারণে আমাদের দেশে লবণ উৎপাদন খরচ ভারতের চেয়ে বেশি হয়ে থাকে।
এছাড়াও ভারতে লবণ উৎপাদন, বিপণন, চাষিদের সুবিধা-অসুবিধা দেখাশুনার জন্য একটি স্বাধীন ‘লবণ কমিশন’ কাজ করে থাকে। অথচ লবণ একটি কৃষি পণ্য হওয়া সত্ত্বেও আমাদের দেশে এখনো লবণ কৃষি পণ্য না শিল্প পণ্য এ নিয়ে বিতর্ক থামেনি। তিনি লবণ সমস্যা ও লবণ চাষি সমস্যা দেখাশুনা ও উৎপাদন বিপণনে একটি স্বাধীন লবণ ‘গবেষণা সেল’ গঠনের প্রস্তাব জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন